রুচিশীল বক্তব্য বনাম কুরুচিপূর্ণ ভাষণ : মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন

মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন
মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দীন

স্বাধীনতার পর বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন করা হলে শেখ মুজিবুর রহমানকে অবৈধ প্রধানমন্ত্রী বলার সুযোগ কারো থাকত না। ইতিহাসের শিক্ষা হলো যখন কোনো দেশে কোনো ধরনের বিপ্লব সংঘটিত হয়, বিপ্লব-উত্তরকালে সেই বিপ্লবে অংশ নেয়া শক্তিগুলোকে নিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করা হয়। আমাদের দেশেও শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে ফিরে আসার পর তাকে প্রধান করে যেসব দল ও শক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছে তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার ঐতিহাসিক প্রয়োজন ছিল। পরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করে গণভোটের মাধ্যমে তা পাস করিয়ে সেই সংবিধানের ভিত্তিতে সরকার গঠন করা যেত; কিন্তু আমাদের দেশে ’৭২ সালে জাতীয় সরকার গঠনের পরিবর্তে পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে ’৭০ সালে নির্বাচিত প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের সদস্যদের নিয়ে এক দিকে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি গঠন করা হয় অন্য দিকে তাদের দিয়েই শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগের একদলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। এ নিয়ে তখনি প্রশ্ন উঠেছিল। জাতীয় সরকার গঠনের দাবিতে সবাই ছিল সোচ্চার। আজকে সংসদে দাঁড়িয়ে তৎকালীন রক্ষী বাহিনীর প্রধানÑ যে বাহিনী আমাদের সামরিক বাহিনীর একটি সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে গঠন করা হয়েছিল, তোফায়েল আহমেদ যে ভাষায় সংসদে বক্তব্য রেখেছেন, বক্তব্য রাখার সময় তার চেহারা ও বক্তব্য যদি উনি আয়নায় দেখতেন লজ্জায় তার মাথা হেঁট হয়ে যেত, এটা আমার দৃঢ়বিশ্বাস। শেখ সাহেবের মর্মান্তিক ঘটনার রাতে রক্ষী বাহিনীর প্রধান হিসেবে সমান্তরাল বাহিনী গঠন করে রক্ষা করতে পারলেন না শেখ মুজিবুর রহমানকে। এখন আওয়ামী লীগের সুসময়ে ওনাদের বক্তব্য মানুষের কাছে তিরস্কৃত। ১৫ আগস্টের কালরাতে যিনি সামরিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনিও বস্তুত নীরব ও নিষ্ক্রিয় ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষার কোনো পদক্ষেপও নিলেন না। অথচ তাকে দেখা গেল শেখ মুজিবতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সংসদে অংশ নিতে, এর তীব্র সমালোচনা করে শেখ সেলিম সংসদে বক্তব্য রাখার পর কোনো এক ঐশী শক্তির টানে উনি হয়ে গেলেন নীরব। আমরা যারা হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না, গণতন্ত্রই যেখানে আমাদের রাজনীতির মূলমন্ত্র সেখানে আমাদের ঠিকানা হচ্ছে বাংলাদেশ। এর বাইরে আমাদের নেই কোনো ঠিকানা বা প্রভু। যেখানে এ দেশের মাটি ও মানুষ নিয়ে আমরা যারা রাজনীতি করি যখন শুনি আমার বন্ধুবর প্রবীণ আওয়ামী নেতা নাসিম ও অন্যরা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটাক্ষ করলে আইন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ ’৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর আবদুল মালেক উকিল লন্ডনে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ফেরাউনের রাজত্বের অবসান হয়েছে।’ অনুরোধ করব তোফায়েলকে এ ব্যাপারে তার বক্তব্য তাদের বিতর্কিত সংসদে শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে দেশের জনগণ। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। সেখানে বাকস্বাধীনতা হননের যে ইতিহাস আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করতে চলেছে এটা জাতির জন্য আদৌ শুভ নয়। গণতন্ত্রের আদি মর্মবাণী হচ্ছে সব মত ও পথের মহামিলনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা। ইতিহাসের কোনো সত্য কথা বলার যেমন অধিকার রয়েছে, তেমনি তার প্রতিবাদ বা কঠোর সমালোচনারও সুযোগ রয়েছে। সত্য বলা যদি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায় তাহলে একটি জাতির ইতিহাস ও গণতন্ত্রের বিকাশ আগামী প্রজন্ম বঞ্চিত হবে তাদের জানার অধিকার থেকে আর সমালোচনা হতে হবে রুচিসম্মত। রুচিবিবর্জিত বক্তব্য কোনো অবস্থাতেই গণতন্ত্রের সহায়ক হিসেবে কাজ করে না।

আমি এখানে একটি ঘটনা উদ্ধৃত করতে চাইÑ ‘১৯৭৩ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নন্দীরহাটে মরহুম ডা: ক্যাপ্টেন শামসুল ইসলামের খামারবাড়ির পুকুরঘাটে শীতের ভোর রৌদ্রে আলাপচারিতা অবস্থায় একজন উপস্থিত রাজনৈতিক কর্মী যখন মরহুম সবুর খানের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে তার ভূমিকার কথা বলছিলেন হঠাৎ করে মওলানা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘জানো যার (সবুর খান) এক পা মাটিতে আর এক পা কবরে তিনি এখনো জনগণের কথা বলেন তার বিরুদ্ধে এই ধরনের বক্তব্য আমি সহ্য করব না। সে দিন সেখানে আমি এবং মরহুম অলি আহাদের কয়েকজন দলীয় নেতাসহ মরহুম অ্যাডভোকেট শফিকুল ইসলাম চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। এই ঘটনার অবতারণা এই জন্যই করলাম রাজনীতির অঙ্গনে হৃদয়ের বিশালতা যেখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে চির স্মরণীয় করে রাখে সেখানে রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণমনা ও রুচিহীন বক্তব্য রাজনীতির অঙ্গনে তাদের রাজনীতির আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত করে। রাজনীতির এই অমোঘ বিধান এক দিকে যেমন ঐতিহাসিক ও আশাব্যঞ্জক অন্য দিকে বড় করুণ ও বেদনাদায়ক। কাউকে তাচ্ছিল্য করে মূর্খ ও বালক বলে সম্বোধন করে আমার দৃঢ়বিশ্বাস সম্বোধনকারীর বিবেকের তাড়নায় বিনিদ্ররজনী কাটাতে হয়েছে যদিও তিনি নেত্রীর কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য অনেক সত্য-মিথ্যা রুচিহীন বক্তব্য রেখে নিজের ভূমিকা সম্পর্কে বেমালুম নীরব ছিলেন।
তারেক রহমান ইতিহাসের সত্য অধ্যায়টুকু তুলে ধরেছেন মাত্র। তিনি তো আরো একটি সত্য বক্তব্য রাখতে পারতেন যে উনার বাবা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি।
তিনি কোনো অধ্যাদেশ মূলে রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হননি বা তার বাবা সংবিধান সংশোধন করে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি পদে থাকার ব্যবস্থাও করেননি। তারেক রহমানের বর্তমান বয়স ৪৯, এপর্যায়ে শুধু মস্তিষ্কবিকৃত ব্যক্তি ছাড়া কেউ এ বয়সের কাউকে বালক বলতে পারে না। ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের মহানায়কের কাছে অনুরোধ করব কাচের ঘরে বাস করে কাউকে ঢিল ছুড়তে নেই, আর যদি ঢিল ছোড়েন তাহলে পাটকেলটিও কপালে জুটবে। আর যদি মনে করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধীদলীয় নেতার বাড়ির ফটকে বালুর ট্রাক দিয়ে আটকে রেখে প্রায় সারা দেশে ৬৫ হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে নিক্ষেপ করে ৫ জানুয়ারির জন্ম নেয়া অবৈধ সংসদে বিনাভোটে সংসদ সদস্য ও পরে মন্ত্রী হয়ে ভুলে যাবেন না জনগণই সঠিক সময়ে সঠিক জবাব দেবে, খান খান হয়ে যাবে স্বপ্নের সংসদ যা হচ্ছে ইতিহাসের অমোঘ পরিণতি। মনে রাখবেন শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, জেনারেল ওসমানী ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কেউ কারো সমান্তরাল নন, যার যার অবদানের নিরিখে তার তার প্রাপ্তি ও অবস্থান ইতিহাসই ঠিক করে রেখেছে আগামী প্রজন্মের জন্য। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনার ভয় দেখিয়ে যেমন মত প্রকাশের অধিকার খর্ব করা যায় না তেমনি আইন ও মামলার ভয় দেখিয়ে সমালোচনাও বন্ধ করা যাবে না। ভুলে গেলে চলবে না, ইতিহাস বড়ই নির্মম। যারা গণতন্ত্রের লেবাসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাসীন হয়ে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, তাদের বিদায় বড়ই করুণ ও বেদনাদায়ক এটাই ইতিহাসের অমোঘ বিধান।
আজ যারা নিজের দলকে ত্যাগ করে নৌকার যাত্রী হয়ে যে ধরনের বিকৃত রুচিহীন বক্তব্য রাখছেন তারা কি বেমালুম ভুলে গেছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কলমের খোঁচায় তাদের দণ্ডাদেশ মওকুফ হয়েছিল।
সংসদে দাঁড়িয়ে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে উদ্দেশ করে অত্যন্ত উত্তেজিত ও কর্কশকণ্ঠে বলছিলেন, ‘ওরে আহাম্মক, লেখাপড়া জানিস না, তোর বাপ আমাদের স্যার স্যার বলতে মুখের ফেনা তুলে ফেলত।’ সংসদে দাঁড়িয়ে তোফায়েল ভাই যখন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে গালি দিচ্ছিলেন তখন ওনার সারা শরীর রাগে কাঁপছিল। আমার মনে হচ্ছিল উনি তারেক রহমানকে কাছে পেলে সংসদ নেতা আওয়ামী লীগ প্রধান দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন জয় করার জন্য তাকে পিষে ফেলতেন; কারণ এই তোফায়েল সাহেবরাই ওয়ান ইলেভেনের পর সংস্কারপন্থী হয়ে ওয়ান ইলেভেনের সময় সংবাদ সম্মেলন করে সংস্কারের যেই প্রস্তাব জাতির সামনে উত্থাপন করেছিলেন ওনাদের সেই ভূমিকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দিয়েছিল।
রুচিশীল বক্তব্য যতটুকু ক্ষুরধার হয়, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য ততটুকুই আত্মঘাতী হয়। আপনি কি জনগণের নির্বাচিত সংসদে বক্তব্য রাখছেন, না এক ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলনের ভোটারহীন নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি বিতর্কিত সংসদে বক্তব্য রাখছেন। আপনার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সাথে আপনার সংসদে দেয়া বক্তব্যের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছি না, দুষ্ট লোকেরা বলে এটাই নাকি আপনাদের আসল চেহারা।

যদি ওয়ান ইলেভেনের সরকার টিকে যেত তাহলে আজকে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া তো দূরের কথা, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের মতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা মামলার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে কমপক্ষে ১০৪ বছর জেল হতো। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দলের সংস্কারবাদী নেতা তোফায়েল আহমেদসহ অন্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ÔI Will forgive but I will not forget.Õ তোফায়েল আহমেদ সংসদে দাঁড়িয়ে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রুচিহীন বক্তব্যের মাধ্যমে তার নেত্রীকে খুশি এবং ÔI will not forgetÕ-এর শঙ্কা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি নিকৃষ্ট অপচেষ্টা। কেননা যেই বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনসমৃদ্ধ ৬৯-এর গণ-আন্দোলনের একজন নেতার মুখ থেকে এ ধরনের ভাষা জাতি কোনো দিন আশা করে না। তোফায়েল ওই ধরনের বক্তব্য রেখে যাদের খুশি ও মন জয় করতে চেয়েছেন তারা হলেন সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য। তারাও মুচকি মুচকি হেসেছেন তোফায়েলের এই ভূমিকায়। অপর দিকে এই দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এই ধরনের ভাষা প্রয়োগে ব্যথিত হয়েছে দেশের জনগণ বিশেষ করে জিয়ার সমর্থকেরা। আর আসল চেহারা প্রকাশ পেয়েছে আওয়ামী নেতাদের। একজন অভিজ্ঞ সংসদ সদস্য হিসেবে তোফায়েল আহমেদের জানার কথা, যার বিরুদ্ধে বক্তব্য রেখেছেন তিনি সংসদে উপস্থিত নন এবং সংসদে থেকে তার বক্তব্যের জবাব যিনি দিতে পারবেন না তার বিরুদ্ধে একতরফা বক্তব্য রাখা সংসদীয় রীতি-নীতির বিরুদ্ধ।

লেখক:সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সাবেক মন্ত্রী, মেয়র ও রাষ্ট্রদূত।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend