ওসি’র নজর প্রাইভেট কারে দারোগা চান ফ্রিজ দিশাহারা ইকবাল
ওসি’র নজর প্রাইভেট কারের দিকে। আর দারোগা চান ফ্রিজ। তাদের আবদার অপূর্ণ রাখাতেই বিপদ পিছু ছাড়ছে না ইকবালের। এক গাড়ি আর ফ্রিজের জন্য তার সব ব্যবসা-বাণিজ্য এখন লাটে। বারবার মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েও নিষ্কৃতি মিলেনি। চেষ্টা চলছে একটির বদলে আরও চারটি গাড়ি কেড়ে নেয়ার। মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে চরম সর্বনাশ করার হুমকি তো আছেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার সিংগারবিল বাজারের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মো. ইকবাল হোসেন। ৯ বছর সৌদি প্রবাসে কাটিয়ে দেশে ফিরে শুরু করেন বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য। সেখানকার ইভা রেন্ট এ কার, ইভা ইলেকট্রনিক্স, ইভা ফ্যাশন গ্যালারির মালিক তিনি। এসব ব্যবসা-বাণিজ্যই এখন কাল হয়েছে তার। সন্দেহ- আড়ালে মাদক পরিবহনে জড়িত তিনি। প্রাইভেট কার, নোয়া ও হায়েস মডেলের মাইক্রো মিলিয়ে ৫টি গাড়ি নিয়ে তার রেন্টে এ কারের ব্যবসা। এসব গাড়ি সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক পরিবহনের কাজে ব্যবহার হয়- এই অভিযোগে তার পিছে লাগে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। ইকবাল হোসেন জানান, সুমন নামে তার একজন ড্রাইভার ছিল। সে চোরাচালানের পণ্য পরিবহন করতো। এটি জানার পরই তিনি তাকে বের করে দেন। কিন্তু এরপরও তার রক্ষা নেই। ইকবাল বলেন, আমি মাদক ব্যবসা করি, আমাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো হবে বলে ১০ লাখ টাকা দাবি করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর আমি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে নিষ্কৃতি পাই। গত ২০শে জানুয়ারি ডিবি অফিসে গিয়ে ওসি’র হাতেই এই টাকা দিই। এর কিছুদিন পর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই নূরুল আমিন আমার ওয়ালটনের শোরুমে এসে একটি ফ্রিজ দাবি করে। আমি তখন তাকে বলি এখন দোকানে মাল নেই, মাল এলে নিয়েন। মাল আসার পর নূরুল আমিন আরেকদিন দোকানে এসে ১৩ সিএফটি’র একটি ফ্রিজ পছন্দ করেন। যার দাম ৩৫ হাজার টাকা। তখন আমি তাকে বলি আমি ৮ শতাংশ কমিশন পাই। সেটি বাদ দিয়ে যা মূল্য হয় আপনি তা দিয়ে দেবেন। নূরুল আমিন তখন আমাকে বলে পুরোটাই আমাকে গিফট করতে হবে। পরে আমি আর তাকে ফ্রিজটি দেইনি। এরপর গত ১লা মে এসআই নূরুল আমিন আমাকে ফোন করে জানান, আমার একটি গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে। আমি যেন ৫ হাজার টাকা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পৈরতলা যাই। এর কয়েক মিনিট পরই ফোন করে আমার কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করে। তখন আমাকে বলা হয় আমার গাড়িতে গাঁজা পাওয়া গেছে। টাকা না দিলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। তখন আমি বিষয়টি আমার এলাকার বাসিন্দা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিন ভাইকে জানাই। তিনি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১ লাখ টাকায় রফাদফা করেন। এই টাকা জসিম ভাইয়ের ভাগ্নে আল-আমিনের মাধ্যমে পাঠানো হয়। আল-আমিন টাকা নিয়ে ডিবি’র বলে দেয়া স্থানে শহরের দাতিয়ারায় টিভি রিলে কেন্দ্রের কাছে যাওয়ার পর এসআই নূরুল আমিন ওসিকে সঙ্গে নিয়ে এসে টাকা নিয়ে যান। আর আল-আমিনকে আধা ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি খালি করে দিয়ে দেবেন বলে সেখানে অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু এর মধ্যে এক ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পর আল-আমিন তার মামাকে ফোনে আবার বিষয়টি জানান। জসিম খোঁজ নেয়ার জন্যে ফোন করলে জানতে পারেন ডিবি’র ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাস এসআই নূরুল আমিন ইকবালের বাড়িতে অবস্থান করছেন। ইকবাল জানান, ওসি আকুল চন্দ্র বিশ্বাস তার বাড়ির ভেতর গ্যারেজে ঢুকেই টয়োটা প্রিমিও নতুন প্রাইভেটকারটির দিকে চোখ ফেলেন। গাড়িটিতে উঠে বসেন। বলেন, এই প্রাইভেটকারটিই আমার চাই। তখন আমি তাকে বলি কি কারণে আপনি গাড়ি নিয়ে যাবেন। নিয়ে যাবো, কারও শক্তি থাকলে যেন আটকায়। এরপর সে সব গাড়ির চাবি আমার কাছে চায়। বলে গাড়িগুলো তল্লাশি করতে হবে। এরপর আমি ইউপি চেয়ারম্যানকে ফোন করে সেখানে আনাই এবং তার সামনে গাড়ির চাবি ওসি’র কাছে দিই। চাবি দিয়ে গাড়িগুলো খুলে তল্লাশি করে কোন কিছুই পাননি। এরপর গাড়িগুলো তালা দিয়ে চাবি চেয়ারম্যানের জিম্মায় রাখেন। এ বিষয়ে সিংগারবিল ইউপি চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, আমার সামনে সব ক’টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। কোন গাড়িতে কোন কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর ওসি আমাকে বলেন, তিনি সব গাড়ি নিয়ে যাবেন। তখন আমি প্রতিবাদ করি। বলি, আপনি এসব গাড়ি কোন কারণে নেবেন? তখন তিনি আমাকে বলেন, এসপি’র নির্দেশ আছে। এখন আমি বিপদে পড়েছি। আমাকে ওসি-দারোগা ফোন করে বলে গাড়িগুলো পৌঁছে দিতে। আবার বলে তারা এসে নিয়ে যাবে। তিনি বলেন, সব গাড়ি নিতে আপত্তি করার পর ওসি প্রাইভেট কারটি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এর দিকেই তার নজর বেশি। ইকবালের মালিকানাধীন ঢাকা মেট্রো-গ-২৩-৯২১৯ নম্বর প্রোভক্স প্রাইভেট কারটি ১লা মে বিশ্বরোডে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের দাবি এতে ২০ কেজি গাঁজা পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় গাড়ির চালক জাকির হোসেনকে আটক করা হয়। পরে ১ লাখ টাকায় আটক গাড়ি ও চালককে ছেড়ে দেয়ার রফাদফা হয়। এই টাকা হাতে নিয়ে মাদকসহ ড্রাইভারকে চালান দেয়া হয়। গাড়িটি আটক করা হয়। এরপর ইকবালের বাড়িতে গিয়ে অন্যান্য গাড়িতে তল্লাশি এবং এগুলো ডিবি অফিসে নিয়ে আসার চেষ্টা নিয়ে কথা উঠেছে। ইকবাল জানিয়েছেন তাকে হুমকি দেয়া হচ্ছে প্রাইভেটকার না দিলে অন্যান্য গাড়ি চলতে দেয়া হবে না। তার বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দেয়া হবে। ইকবাল জানান, ঘটনার পর থেকেই আতঙ্কে রয়েছেন তিনি ও তার পরিবার। তার ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। ৭টি গাড়ির চাবি নিয়ে যাওয়ায় এসব গাড়ি চলতে পারছে না। বিয়ে অনুষ্ঠানের জন্য গাড়ি আগাম ভাড়া দেয়া ছিল। সেখানেও যেতে পারেনি। চালক-হেলপারসহ গাড়ির ১৫/২০ জন স্টাফ বেকার। তাছাড়া সব ক’টি গাড়ি কেনা হয়েছে ব্যাংক ঋণে। গাড়ি না চলায় তার আমদানি বন্ধ। ইকবাল বলেন, গাড়ির আমদানির টাকায় আমি ব্যাংকের কিস্ত্তি দিই। এখন তা-ও দিতে পারছি না। আমার ওয়ালটন ফ্রিজের শোরুমেও মাল উঠান না ভয়ে। যদি আবার ফ্রিজগুলো নিয়ে যায়। ইকবালের মোট ১৮টি সিএনজি ছিল। এগুলোর মধ্যে ৩টি রেখে ১৫টি বিক্রি করে দেন। সিএনজি বিক্রির টাকা এবং ব্যাংক ঋণে ৫টি প্রাইভেটকার-মাইক্রো, একটি ট্রাক ও ট্রাক্টর কেনেন। এসব গাড়ির মধ্যে হায়েস মাইক্রো চট্ট মেট্রো-চ-১১-৪৯৯১ ও ঢাকা মেট্রো-চ-১৩-৫৯০৪, নোয়া মাইক্রো ঢাকা মেট্রো-চ-৫৪-১১৯৫,অনটেস্টে থাকা প্রিমিও প্রাইভেট কার, ৩টি সিএনজি’র চাবি চেয়ারম্যানের হাতে রাখা আছে ডিবি’র। ইকবালের পিতার নাম কাহ্হার মিয়া। সিংগারবিল মধ্যপাড়ায় তার বাড়ি। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সৌদি আরবে ছিলেন ইকবাল। এ বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আকুল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ক্রাইমে জড়িয়ে পড়লে বাঁচার জন্য কত কথাই বলে। এসব ঠিক না। আমরা অভিযান চালিয়ে গাড়ির সিলিন্ডারে গাঁজা ফিটিং অবস্থায় পাই। এ সময় ১ জনকে আটক করি। আরেকজন পালিয়ে যায়। আটককৃত ব্যক্তি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে এর মালিক ইকবাল বলে জানিয়েছে। আমরা তার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিলাম বাড়িতে আর কোন মাল রিজার্ভ আছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু কোন কিছু পাইনি।