র্যাবের অপারেশন জানতো পুলিশ
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত গুম-খুনের ঘটনাটির সঙ্গে র্যাব সদস্যদের সম্পৃক্ততার কথা প্রথম থেকেই জানতো পুলিশ। অপহরণের আগে আদালত চত্বরে র্যাব সদস্যকে আটক করার পর সেখানে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা ধরে নিয়ে ছিলেন র্যাব কোন অপারেশন চালাতে সেখানে অবস্থান নিয়েছে। এ জন্য পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর আটক র্যাব সদস্যকে ছেড়ে দেয়া হয়। অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, অপহরণ ঘটনার পরপরই জেলা পুলিশ জানতে পারে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাদের পাঁচ সহযোগীকে র্যাব হেফাজতে নিয়ে গেছে। এ জন্য প্রথম দু’দিন পুলিশ নজরুলসহ অন্যদের উদ্ধারে তেমন কোন তৎপরতা দেখায়নি। তবে ঘটনার দু’দিন পেরিয়ে গেলেও র্যাব যখন বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকে তখন টনক নড়ে পুলিশের। তখনই তারা বুঝতে পারে এই সাত জনকে জীবিত উদ্ধার করা আর সম্ভব নয়। এ জন্য নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায় টহল পুলিশদের সতর্ক করে দেয়া হয়। অপরদিকে অপহরণের ঘণ্টা দুয়েক আগে আদালত চত্বরে নজরুলকে অনুসরণকারী সাদা পোশাকের র্যাবের এক সদস্যের বিষয়ে খোঁজ করতে থাকে পুলিশ। অস্ত্রসহ সাদা পোশাকে আটক হওয়া ওই র্যাব সদস্য সম্পর্কে জানতে পুলিশের দুই কনস্টেবল ওমর হাওলাদার ও রফিক ইসলামকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। দুই কনস্টেবল র্যাব সদস্যকে আটকের পুরো কাহিনী কর্মকর্তাদের কাছে খুলে বলেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম দিন থেকে র্যাব যে নজরুলসহ অন্যদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা জানার কথা স্বীকার করেছেন। জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, মামলার তদন্ত চলছে। যারাই জড়িত হোক তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নজরুল চেয়ারম্যান যে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তা তারা আগে থেকেই জানতেন। গোয়েন্দা তথ্য ছিল নজরুলকে গ্রেপ্তারের জন্য র্যাব মরিয়া হয়ে খুঁজছে। কিন্তু নজরুল আত্মগোপনে থাকায় তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষে র্যাব সদস্যরা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারে ২৭শে এপ্রিল নজরুল আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিতে আসবেন। এর আগে তিনি উচ্চ আদালত থেকে নেয়া জামিনে ছিলেন। জেলা বিশেষ শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, আদালতে নজরুলের উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা একটি বার্তা পান যে আদালত থেকে বেরোনোর পথে নজরুলকে র্যাব আটক করতে পারে। আদালত চত্বরে র্যাবের একাধিক সদস্যের উপস্থিতির কথাও জানানো হয়। পরে এক পর্যায়ে আদালত চত্বর থেকেই র্যাবের সাদা পোশাকের এক সদস্যকে অস্ত্রসহ আটক করে নজরুলের অনুসারীরা। তাকে কোর্ট পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হলে জানা যায় সে র্যাব সদস্য। কিন্তু তার সঙ্গে কোন পরিচয়পত্র ছিল না। কোমরে শুধু সরকারি পিস্তলটি ছিল। পরে তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডাকা হয় র্যাবের আরেক সদস্যকে। তিনি আদালত প্রাঙ্গণের সামনে র্যাব লেখা জ্যাকেট পরা ছিলেন। তার নাম মোস্তফা কামাল। দাড়িওয়ালা এই র্যাব সদস্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের সদস্য। পরে তাকে ডেকে নিয়ে সাদা পোশাকের ওই র্যাব সদস্যের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর ছেড়ে দেয়া হয়। গতকাল সাদা পোশাকের র্যাব সদস্যকে আটককারী দুই পুলিশ কনস্টেবল ওমর হাওলাদার ও রফিক ইসলামের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কনস্টেবল ওমর হাওলাদার বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। তবে এক র্যাব সদস্যকে আটকের কথা স্বীকার করেন তিনি। বলেন, যা বলার পুলিশ সুপারকে বলেছি। একই ভাষ্য অপর পুলিশ কনস্টেবল রফিক ইসলামের। তিনি বলেন, এটা তো এখন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে। তিনি বলেন, র্যাব সদস্য নিশ্চিত হওয়ার পর আমরা তাকে ছেড়ে দেই। র্যাব সদস্য তাকে জানায় আদালত থেকে একজনকে ধরার জন্য তারা এসেছেন। পরে সাবেক পুলিশ সুপার বিষয়টি জানতে চাইলে তাকে সব খুলে বলেন।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত একজন পুলিশ সুপার বলেন, ঘটনার পরপরই এই সাত জনকে যে র্যাব তুলে নিয়েছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর পুলিশ উদ্ধার অভিযান বন্ধ রাখে। এ কারণে পরিবারের পক্ষ থেকে যে নূর হোসেনের প্রতি অভিযোগ করা হচ্ছিল তাতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কারণ তারা তখন পর্যন্ত জানতেন র্যাব যেহেতু তুলে নিয়েছে সেহেতু নূর হোসেনকে গ্রেপ্তার করা উচিত হবে না। দু’-একদিনের মধ্যে হয়তো র্যাব তাদের কোন মামলায় গ্রেপ্তার বা কোন আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে হস্তান্তর করবে। এ জন্যই প্রথম দিকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু যখন প্রথম দিন গাজীপুরে নজরুলের গাড়ি ও গুলশানের নিকেতনে চন্দন সরকারের গাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় তখন শঙ্কা নিয়ে নিখোঁজদের সন্ধানে নামে পুলিশ।
র্যাবের তদন্ত কমিটির ঘটনাস্থল পরিদর্শন: নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত হত্যা ঘটনায় র্যাবের তদন্তকারী টিম গতকাল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা পরিদর্শন করেছেন। র্যাব সূত্র জানায়, র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আফতাব উদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে একটি দল গতকাল সকালে প্রথমে লাশ উদ্ধারের স্থলবন্দর উপজেলার মদনগঞ্জ ও চর ধলেশ্বরী এলাকা পরিদর্শন করেন। পরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের লামাপাড়া এলাকায় অপহরণ হওয়ার স্থান পরিদর্শন শেষে র্যাব-১১ সদর দপ্তর ও নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্পে যান। এ সময় তদন্ত কমিটির সদস্যরা র্যাব-১১ সদর দপ্তর ও নারায়ণগঞ্জ শহর ক্যাম্পের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন। উল্লেখ্য, প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ সাত খুনের ঘটনায় র্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পরে গত ৫ই মে র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডিআইজি আফতাব উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে চার সদস্যের এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
নজরুলের সন্তানদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ: আলোচিত সাত হত্যাকা-ের এজাহারভুক্ত প্রধান আসামি নূর হোসেনসহ কাউকেই গ্রেপ্তার করতে না পারায় আতঙ্কে রয়েছে নজরুলের পরিবার। বাসায় পুলিশি পাহারা বসানো হলেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। ইতিমধ্যে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলামকে বেশ কয়েকবার হুমকি দেয়া হয়েছে। আতঙ্কে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে হত্যাকা-ের শিকার নজরুল ইসলামের তিন সন্তান। তাদের আশঙ্কা, স্কুলে যাতায়াতের পথে তাদের কাউকে অপহরণ করে হত্যা করা হতে পারে। নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, স্বামীর লাশ পাওয়ার পর দু’দিন হুমকি এসেছিল। তবে এখন হুমকি না এলেও চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। মামলার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ওদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি। সেলিনা ইসলাম জানান, তাদের তিন সন্তান। বড় ছেলে তরিকুল ইসলাম নাঈম কলকাতার একটি মিশন কলেজে এইচএসসি পড়ছে। দ্বিতীয় ছেলে ফাহিম ঢাকার আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। ছোট মেয়ে তানহা ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত র্যাব কর্মকত্যাদের শুধু চাকরিচ্যুত করলেই হবে না, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনতে হবে। একই দাবি জানান নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, শুধু চাকরি গেলেই হবে না। হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তাদের বিচারের মুখোমুখি করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আলোচিত এ ঘটনায় প্রশাসনিক অনেক কর্মকর্তাকে বদলি করা হলেও দলীয়ভাবে খুনি নূর হোসেন ও অন্যদের বিরুদ্ধেও কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নূর হোসেন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। আসামি হাজী ইয়াসিন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে দলীয় কোন ব্যবস্থা না নেয়াটা আসলে দুঃখজনক।