লাশ ডোবাতে ব্যবহার করা হয় রেশনের বস্তা? সেদিন যা ঘটেছিল

Nazrul+Islamবন্দর গুদারাঘাট থেকে হঠাৎ উধাও নৌকা দুটি। প্রায় চার বছর ধরে এগুলো এ ঘাটেই বাঁধা ছিল। গতকাল বুধবার সকালে সেখানে এগুলো আর দেখা যায়নি। নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে এ নৌকাগুলো ছিল আতঙ্কের। মাঝেমধ্যে রাতের বেলা চোখবাঁধা লোককে তোলা হতো এসব নৌকায়।

বন্দর এলাকার মানুষের ধারণা, নারায়ণগঞ্জের ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যার পর ইটবাঁধা লাশগুলো নদীতে ডোবাতে এ নৌকা দুটিই ব্যবহার করা হয়েছিল। সে কারণেই এগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নৌকা দুটি সরকারি বাহিনীর লোকজন ব্যবহার করতেন।

এদিকে লাশের সুরতহালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, লাশের সঙ্গে যে বস্তায় ইট বাঁধা ছিল, সেই বস্তাগুলো সরকারি রেশনের জন্য ব্যবহার করা। বস্তায় সরকারি রেশনের সিলও রয়েছে। আর ওই বস্তায় যে ইটগুলো ভরা ছিল, সেই একই ধরনের ইট পাওয়া গেছে একটি বাহিনীর কার্যালয়ের পাশের নির্মাণাধীন ভবনে।

নারায়ণগঞ্জের ১ নম্বর বন্দর গুদারাঘাটে পাশাপাশি বাঁধা আছে বিভিন্ন সংস্থার নৌকা। পুলিশেরও তিনটি নৌকা আছে। একই সারিতে ছিল র‌্যাবের দুটি বড় নৌকা। নৌকা চলাচলের জন্য সেখানে ছোট একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষও আছে। গতকাল সকালে সেটিও বন্ধ দেখা যায়। বন্দরের ইজারাদার ইকবাল জানান, নিয়ন্ত্রণকক্ষটি ২৪ ঘণ্টা খোলা ছিল। এখন নৌকাও নেই, কক্ষও বন্ধ।

র‌্যাবের নৌকার খোঁজ করতে শহরের ভেতরের কার্যালয়ে এলে সেখান থেকে জানানো হয়, ওই কার্যালয়ে কোনো কর্মকর্তা নেই। তিন কর্মকর্তা চাকরি হারানোর পর সব কর্মকর্তা এখন ঢাকায়। নারায়ণগঞ্জ শহরে এখন বলতে গেলে র‌্যাবের কোনো কার্যক্রম নেই।

র‌্যাবের কার্যক্রম আপাতত না থাকলেও এ বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। নিহত নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম গতকাল  অভিযোগ করেন, র‌্যাব তাঁর স্বামীকে অপহরণ করেছে। কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলতে নূর হোসেনের সহায়তা নিয়েছে। লাশের ধরন দেখে তিনি এ ধারণা করেন বলে জানান। এ কথা বলার সময় স্থানীয় সাংবাদিকেরাও উপস্থিত ছিলেন।

নজরুলের জীবনযাপন সম্পর্কে সেলিনা ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসী নূর হোসেন দেড় মাস আগে নজরুলকে হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন। এ হুমকির পর থেকে নজরুল খুব ভয়ে ভয়ে চলতেন। নজরুল তাঁকে বলতেন, র‌্যাব-পুলিশ নূর হোসেনের কেনা। প্রাণের ভয়ে তিনি মিজমিজির বাসা ছেড়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। দেড় মাস ধরে ঢাকাতেই ছিলেন। মামলার হাজিরার জন্য ২৭ এপ্রিল তিনি নারায়ণগঞ্জে আদালতে এসেছিলেন। আসার আগের দিন শামীম ওসমানকে তিনি বলেছিলেন, ‘ভাই, একটু দেইখেন।’

সেলিনা জানালেন, নজরুল ১৭-১৮ জনের দল নিয়ে চলতেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে তাঁর লোক থাকতেন। প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর তাঁরা যোগাযোগ রাখতেন। ওই দিন আদালতে তাঁর সঙ্গে এসব লোক ছিল। সেলিনার অভিযোগ, র‌্যাব সদস্যরা আগে থেকেই নজরুলকে নজরে রাখছিলেন। আদালতের ভেতরে র‌্যাবের একজন সদস্য সাদাপোশাকে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাফেরা করার সময় নজরুলের লোকজন তাঁকে সন্দেহবশত আটক করেন। ফতুল্লা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাইফুল ইসলাম  বলেন, র‌্যাবের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর লোকটিকে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে পুলিশের কোর্ট পরিদর্শক তাঁকে জানিয়েছিলেন।

নজরুলের স্ত্রী আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জ আদালত থেকে বের হয়ে স্টেডিয়াম পার হয়ে একটু দূরে গিয়ে নজরুল তাঁকে ফোন করে ঢাকায় যাওয়ার কথা জানান। এর পাঁচ মিনিট পর মনির নামের এক যুবক জানান, নজরুলসহ পাঁচজনের ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। পরে তিনি পাহারায় থাকা নজরুলের কয়েকজন সহযোগীকে সেখানে পাঠান। তাঁরা ফিরে এসে জানান, র‌্যাবের তিনটি গাড়ি এসে নজরুলের গাড়িটি গতিরোধ করে। তাঁরা প্রথমে গাড়ির সবাইকে মারধর করেন। এরপর জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। এ সময় নজরুলের কাছে দুটি অস্ত্রও ছিল। ঘটনাস্থলে থাকা বালুশ্রমিকেরা এ দৃশ্য দেখেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বালুশ্রমিক বলেন, নজরুলকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি দেখেন, সামনে একটি গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ আদালতের একজন আইনজীবী বলেন, নজরুলকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে ফেলেন আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার। তিনি কোনো কথা না বলে অপহরণকারীদের গাড়ির পিছু নেন। একপর্যায়ে তাঁর গাড়ি অপহরণকারীদের তিনটি গাড়ির একটির সামনে এসে পড়ে। তখন পেছন থেকে একটি গাড়ি চন্দনের গাড়িতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে থামিয়ে দেয়। চন্দন গাড়ি থেমে নামলে চালকসহ তাঁকে ওই গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। সবগুলো গাড়িই চলে যায় নারায়ণগঞ্জ শহরের দিকে।

সেলিনা জানান, এ ঘটনা শুনে তিনি প্রথমে শামীম ওসমানের কাছে যান। শামীম ওসমান সব শুনে বলেন, নূর হোসেন এ কাজ করতেই পারে না। এভাবে তিনি অনেক সময় কাটান। তবে এ সময় শামীম ওসমান র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে কথা বলেন।

সেলিনা মনে করেন, শামীম ওসমান ভালো করে নূর হোসেনকে বললে নজরুলের মৃত্যু হতো না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কর্নেল জিয়া  বলেন, ওই দিন শামীম ওসমান তাঁকে বলেন, নজরুলকে র‌্যাব-১১-এর সদস্যরা ধরে নিয়ে গেছেন। এ কথা শুনে তিনি শামীম ওসমানের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি এটা কী করে জানলেন যে র‌্যাবই তাঁদের নিয়ে গেছে? জবাবে শামীম ওসমান বলেন, আদালতের লোকজন তাঁকে জানিয়েছেন, র‌্যাব-১১-এর লোকজন নজরুলসহ সবাইকে ধরে নিয়ে গেছেন।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, সবাইকে একটি ‘টর্চার সেলে’ নেওয়ার পর ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করা হয়। এরপর মুখে গামছা ঢুকিয়ে দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনেও শ্বাসরোধের প্রমাণ মিলেছে। ওই সূত্রটি জানায়, সাতজনকে ওই দিনই মেরে ফেলা হয়। এরপর রাতের বেলা বড় নৌকায় করে লাশগুলো নেওয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীর নির্জন স্থানে। সেখানে নেওয়ার পর বুক-পেট চিরে প্রতিটি লাশের সঙ্গে ১৬টি করে ইট বেঁধে পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। আর এ দলে ছিলেন ২০ জনের মতো। এঁদের মধ্যে সরকারি বাহিনীর সদস্যও ছিলেন বলে শোনা যাচ্ছে।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend