ভয়ের শাসন : বিপদের নাম রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র
বাংলাদেশে এখন দুই ধরনের শাসন দেখা যাচ্ছে৷ একটা রাষ্ট্রের শাসন, অন্যটা ভয়ের শাসন৷ রাষ্ট্রীয় শাসনের কেন্দ্র ঢাকায়, আর ভয়ের শাসনের চলতি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ৷ রাজধানী নড়ে না, কিন্তু ভয়ের রাজধানী আজ নারায়ণগঞ্জ, তো কাল নরসিংদী তো পরশু লক্ষ্মীপুরে সরে যাবে৷ যা সবখানেই ঘটতে পারে, তার দেশজোড়া ভিত্তি না থেকে পারে না৷ তাই শুধু নারায়ণগঞ্জকে ভয়ের জনপদ ভাবলে সংকটের বিস্তার ও গভীরতা নজরের বাইরে থেকে যাবে৷
প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারযন্ত্রের শাসন কি ভয়ের শাসনকে দমন বা শক্তিহীন করতে পারবে? পারা সম্ভব ছিল, যদি দুইকে আলাদা করতে পারতাম৷ অপহরণ ও গুম-খুনের ঘটনায় যেসব বাহিনীর নাম আসছে, তারা সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন রাষ্ট্রীয় বাহিনী৷ শামীম ওসমান থেকে নূর হোসেনসহ অভিযুক্ত নেতারা সবাই আওয়ামী লীগের লোক৷ অভিযোগের পাহাড় থাকা সত্ত্বেও তঁাদের দায়মুক্তি পাওয়া সরকারের ইচ্ছার বাইরে ঘটছে বলে ভাবা বোকামি৷ এই অবস্থাতেই নারায়ণগঞ্জের নিহত সাতজনের অন্যতম নজরুল ইসলামের স্ত্রী সকাতরে জানতে চান, ‘আমি এখন কী করব, কোথায় যাব?’
আলোচিত সাত খুনের পেছনে বালুমহাল ও ব্যবসা দখলের কোন্দল ছিল৷ গুমের থাবা থেকে ফিরে আসা আবু বকর সিদ্দিককে অপহরণের পেছনেও ভূমিগ্রাসীরা জড়িত বলে অভিযোগ৷ নরসিংদীর পৌর চেয়ারম্যান লোকমান বা নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর হত্যার পেছনেও ছিল ক্ষমতার রেষারেষি৷ প্রকাশ্য খুন আর গুম-খুন মিলিয়ে তাহলে পাচ্ছি দুটি কারণ: ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা তথা বিত্তের বাসনা এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিযোগিতা তথা অবৈধ ক্ষমতার অভিলাষ৷
দৃশ্যত এই দুটি শক্তি আলাদা হলেও গত দুই দশকে ভেতরে ভেতরে একই আকার ধারণ করেছে৷ কিছু বিরল ব্যক্তিকে বাদ দিলে প্রায় সব বড় নেতাই বড় ব্যবসায়ী৷ রাজনীতি এখন দ্রুত বড়লোক হওয়ার মাধ্যম৷ অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে অস্বাভাবিক বিত্ত অর্জনে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসার থেকে লোভনীয় আর কিছু নেই৷ রাজনীতির মগডাল ধরতে পারলে নামে-বেনামে ব্যাংক লুটও সহজ৷ আর আছে ভূমি গ্রাস, নদী গ্রাস, বালুমহাল গ্রাস, পরিবহন রুট দখল, মাঝারি ও খুদে ব্যবসায়ীদের থেকে লভ্যাংশ আদায়ের ব্যবস্থা৷ এভাবে অর্জিত শত-হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ব্যবস্থাও এরা গড়ে তুলেছে৷ এরাই আবার পথের কঁাটা সরাতে সরকারি-বেসরকারি ভাড়াটে লোকজন দিয়ে হত্যা, দখল ও লুটপাট চালাচ্ছেন৷ এসব কাজের একটিও আইনের মধ্যে থেকে করা সম্ভব নয়৷
বিপজ্জনক ব্যবসা চালাতে হলে রাজনৈতিক ক্ষমতার ছাতা লাগবেই৷ এই ছাতার তলে বেআইিন উপায়ে সম্পদশালী হওয়া আর জোর-জুলুমের মাধ্যমে রাজনৈতিক ক্ষমতাধর হওয়াই হয়ে উঠেছে অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রধান ধারা৷ এই দুর্বৃত্ত নেতা ও লুটেরা ব্যবসায়ীরা হলো বাইবেলে কথিত দানব ইয়াজুজ ও মাজুজের মতো৷ লোকবিশ্বাস, একদিন এই দুই দানব একজোট হয়ে মানুষকে ধ্বংস করবে৷ উপকথাকে বাস্তবে অনুবাদ করলে দেখব, এসব দুর্বৃত্ত নেতা ও লুটেরা ব্যবসায়ীদের মিলনে জন্ম হয়েছে নতুন বিপদের৷ এরই নাম রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র৷ এই দস্যুতন্ত্রই বাংলাদেশকে খাবলে খাচ্ছে, জীবন ও সম্পদের বিরুদ্ধে খাড়া করছে হুমকি৷
একসময় অনেকেই একমত ছিলেন, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিই আমাদের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা৷ কিন্তু এখনকার অপহরণ ও গুম-খুনকে চিরাচরিত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির ব্যাকরণে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না৷ সন্ত্রাস ও দুর্নীতি গুরুতর সমস্যা হলেও জীবন ও অর্থনীতিবিধ্বংসী হতে পারেনি৷ সন্ত্রাস করা হয় প্রকাশ্যে, কারা করছে তা জানা যায়৷ দুর্নীতি অর্থনীতির রক্ত শুষে খায়, কিন্তু ঘাড় মটকে দেয় না৷ সন্ত্রাস ছিল হাতিয়ার, কিন্তু এখন দস্যুতন্ত্র নিজের হাতেই তুলে নিচ্ছে ক্ষমতা৷ দুর্নীতি সম্পদের একাংশ হাপিস করত, কিন্তু দস্যুতন্ত্র পুরোটাই গ্রাস কের৷
শত শত গুম-খুনের বাস্তবতা বলছে, সন্ত্রাসের চরিত্র কাঠামোগতভাবেই বদলে গেছে৷ কারণ, এগুলোর ব্যাপকতা ও ভয়াবহতা চিরাচরিত সন্ত্রাস ও দুর্নীতির চেয়ে বহুগুণ বেশি৷ আগে কালা জাহাঙ্গীরদের মতো সন্ত্রাসীরা ছিল অসামাজিক৷ এখন যঁাদের দাপটে জনপদ ত্রাসিত থাকে, তঁারা সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত গণ্যমান্যজন৷ আগে দলগুলোর পুরোটাই সন্ত্রাসীদের কবজায় ছিল না৷ বলা যেত না যে দখল-লুণ্ঠনই রাজনীতির প্রধান উদ্দেশ্য৷ এখন বলা যায়৷ কারণ, সন্ত্রাসী ক্ষমতাবিবর্তিত হয়ে ফুলে-ফেঁপে দস্যুতন্ত্র হয়ে উঠেছে৷ একে টেকাতে গেলে দরকার একচেটিয়া ক্ষমতার রাজনীতি৷ এ অবস্থায় সব প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে একচেটিয়া শাসন কায়েম করার দিকেই যাবে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি৷ রাষ্ট্রের সব অঙ্গ যখন তাদের হাতিয়ার, তখন রাজনৈতিক দস্যুতন্ত্র রাষ্ট্রের ভেতর রাষ্ট্র হয়ে ওঠে৷ তখনই জন্ম হয় ভয়ের শাসনের৷ জাতীয় জীবন আজ এরই অধীন৷
এর বিরুদ্ধে দঁাড়ানো কঠিন৷ গত রোববারের প্রথম আলোর সংবাদে এক পুলিশ কর্মকর্তা পর্যন্ত বলেছেন, ‘এ নিয়ে কাজ করতে গেলে আমরাও গুম হয়ে যেতে পারি৷’ যোগাযোগমন্ত্রীও বলে ফেলেছেন, ‘এ অবস্থার দায় সরকারও এড়াতে পারে না৷’ গত কয়েক বছরে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, পুলিশসহ এমন কোনো শ্রেণী ও পেশার মানুষ নেই, যঁারা এর শিকার হননি৷ এই দস্যুতন্ত্র দেশজোড়া নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে৷ মধ্যযুগে বঙ্গদেশে কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে বারো ভূঁইয়া নামের বারোটি ক্ষমতাবান পরিবারের উদয় হয়েছিল৷ এখন এলাকায় এলাকায় এ রকম দাপুটে পরিবারের তাপজ্বালা শিশুও টের পায়৷
এই নব্য জমিদারদের পেছনে আছে অন্ধ দলবাজদের সমর্থন৷ বিনিময়ে তারা কোনো না কোনোভাবে খাতির-সুবিধা পান৷ অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটা অংশ ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিসে’র মজা পেয়ে গেছে৷ তাদের অনেকেও হয়ে উঠেছে খুন-অপহরণের ঠিকাদার৷ প্রথম আলোর সংবাদে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এএসএম শাহজাহান তাই বলেন, ‘কাউকে দিয়ে একটি অপরাধ করালে সে নিজের লাভের জন্য আরও ১০টি অপরাধ করবে৷’ বিরোধীদের দমনের জন্য যাদের লাগাম ছাড়া হয়েছে, লাগাম টেনে ধরে তাদের দিয়ে দস্যুতন্ত্রকে মোকাবিলা করা তাই সরকারের জন্য কঠিন৷
এ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সঙ্গে নির্বাচন না হওয়াও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত৷ নির্বাচনের মতো নির্বাচন হলে রাজনীতিকদের জনগণের সামনে যেতে হতো৷ সন্ত্রাস ও লুটপাটের আয়োজন কমাতে হতো৷ রাজনীতিবিদেরা যখন জবাবদিহির মুখে থাকেন, তখন প্রশাসনও রয়েসয়ে চলে৷ নির্বাচন হচ্ছে বানের পানির মতো, তা সাময়িকভাবে ময়লা-আবর্জনা ভাসিয়ে নেয়, ক্ষমতার দৌরাত্ম্য কমায়৷ কিন্তু কেউ যখন ভোটারবিহীন তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকে, তখন তাকে সব কায়েমি শক্তির সঙ্গে আপস করে বা তাদের দিয়ে-থুয়ে চলতে হয়৷ সামরিক ও রাজনৈতিক—দুই শাসনামলেই আমরা তেমনটা দেখেছি৷
ওই উপকথা অনুসারে, ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ জুলকারনাইন ইয়াজুজ ও মাজুজকে দেয়ালবন্দী করে রেখেছিলেন৷ সত্যিকার গণতান্ত্রিক শাসন হলো সেই নিরাপত্তা দেয়াল৷ যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতি না থাকে, গণমাধ্যম ও সমাজ সাহস ও স্বাধীনতা হারিয়ে ফেললে মানবতা রক্ষার বঁাধও ভেঙে পড়ে৷ স্বৈরতান্ত্রিক ইয়াজুজ আর লুটেরা মাজুজ তখন দেশকে ধ্বংসলীলার অভয়ারণ্য বানাতে পারে৷ এভাবেই কায়েম হয় কাঠামোগত দস্যুতন্ত্র৷ বাংলাদেশে কি তাই ঘটছে না?
আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়া অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতা দিয়ে এর ভয়াবহতা পরিমাপ করা যাবে না৷ শত শত মানুষ খুন হলেও, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বাড়াবাড়ি হলেও দেশ ধ্বংস হয় না৷ দেশ ধ্বংস হয় যখন নীতি ও নেতৃত্ব ধ্বংস হয়৷ সেটা হয় তখনই, যখন অশুভ ক্ষমতা ও মাফিয়া অর্থনীতি মাৎস্যন্যায় কায়েম করে৷ এ রকম দশায় বড় ক্ষমতা ছোট ক্ষমতাকে গিলে ফেলে৷ আমরা এখন সেই অবস্থাই পার করছি৷ বিভিন্ন স্থানে জনতা দস্যুতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করছেন; এইটুকুই আশা৷
শৈশবে শেখানো হয়, ভয় না পাওয়া হলো বড় হওয়ার লক্ষণ৷ দেশের ছোট-বড় সবাই এখন ভীত; সামষ্টিক বিপদের ব্যক্তিগত সমাধান হয় না৷ স্বাভাবিক মাত্রার অপরাধ পুলিশের বিষয়, আদালতে বিচারের বিষয়৷ কিন্তু অপরাধ মহামারি হয়ে উঠলে সমাজবিজ্ঞানী-রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদদের খুঁজতে হয় বিপর্যয়ের কারণ৷ যখন রাজনীতিবিদেরাও ভরসা হারান, তখন জনগণের আরও ঘন হয়ে বসে আলোচনা করা উচিত, এই ভয় মোকািবলার উপায় কী? আমাদের বিপদের সুরাহা নিজেরাই করতে পারছি না কেন?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com