১৪শ টাকা কেড়ে নিয়ে নেমে গেছে ট্রাফিক পুলিশ

download (1)রাজধানীর বিজয় সরণি মোড় পার হওয়া মাত্রই ছোট কাভার্ডভ্যানটি থামাতে ইশারা করে ট্রাফিক পুলিশ। পাশেই নভোথিয়েটারের সামনে থামালেন চালক। তড়িৎ গতিতে গাড়ির কাছে গিয়ে (ঢাকা মেট্রো-ম-১১-১২৭৯) দরজা খুলে হেলপারের পাশে বসে পড়লেন এক ট্রাফিক কনস্টেবল। গাড়ির কাগজপত্র দেখতে চাইলেন। কাগজপত্রগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখে কনস্টেবল গেলেন ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পাশে বসে থাকা সার্জেন্টের কাছে। তিন মিনিট পর আবার ফিরলেন গাড়ির কাছে। উঠলেন গাড়িতে। এবার তিনি চালককে বললেন, গাড়ির কাগজপত্রে সমস্যা আছে। রেকার করতে হবে। রেকার করতে না চাইলে ২ হাজার টাকা দিতে হবে। তাড়াতাড়ি ভাবো কি করবা, রেকার করলে গাড়ি ডাম্পিংয়ে যাবে। এতে তুমিই ঝামেলায় পড়বে।এরই মধ্যে ওই সড়কে ভিভিআইপি যাওয়ার জন্য রাস্তা যানজটমুক্ত করছিলেন ট্রাফিক পুর্লিশের অন্য সদস্যরা। এ কারণে ওই কনস্টেবল গাড়ির কাগজপত্র নিজের কাছে রেখে গাড়ি নিয়ে চন্দ্রিমা উদ্যানের মোড় হয়ে ঘুরে আসতে বললেন গাড়ির চালককে। ভিভিআইপি চলে যাওয়ার পর যথারীতি চালক গাড়ি নিয়ে আগের জায়গাতেই থামালেন। কনস্টেবল গাড়িতে উঠে ফের দেনদরবার। একপর্যায়ে দেড় হাজার টাকা নিয়ে গাড়িটি ছেড়ে দেন কনস্টেবল। এ ঘটনাটি ৩০ এপ্রিল দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে শুরু হয়ে ১টা ৫৫ মিনিটের। নেমপ্লেট থেকে জানা গেল ওই ট্রাফিক কনস্টেবলের নাম নাসির আর সার্জেন্টের নাম আনিছ।
রাজধানীতে এভাবেই চলছে ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন গাড়ির মালিক ও চালকরা। গাড়ির কাগজপত্র যাচাই ও রেকারিংয়ের নামে দিন-রাতে এসব চাঁদাবাজি চলছে প্রকাশ্যে। তাছাড়া বিভিন্ন গাড়ি থেকে মাস, সপ্তাহ ও কথিত রুটপারমিট চুক্তি দিয়েও চাঁদাবাজি করছে পুলিশ। অধিকাংশ চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে সার্জেন্ট থাকেন বসে আর টাকা তোলেন কনস্টেবল।
গাড়ি থামিয়ে চালকের পাশে বসে আবার কখনও পুর্লিশ বক্সের মধ্যে সংশ্লিষ্ট চালককে নিয়ে টাকা নেয়া হয়। চাহিদা মতো টাকা দিতে রাজি না হলে চালককে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত মামলা কিংবা গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে ডাম্পিং সেন্টার পর্যন্ত পৌঁছে। যত ওপরে জানাজানি ঘুষের রেট তত বেশি। দুই দিন ও এক রাত রাজধানীর বনানী, কাকলী, মহাখালি, মালিবাগ, কমলাপুর টিটিপাড়া, বিজয় সরণি এলাকায় সরেজমিন ও অনুসন্ধান করে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজি সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে।
৩০ এপ্রিল রাত ১২টা ৭ মিনিট। মালিবাগ রেলগেট পুলিশ বক্স। বাড্ডাগামী একটি ইটভর্তি মিনি ট্রাক (ঢাকা-ন-৮৬৮৯) থামান ট্রাফিক কনস্টেবল। নেমপ্লেটে লেখা তার নাম এনামুল। ট্রাকটিতে ওঠে পড়েন তিনি। এরপরেই কাগজপত্র বের করতে বলা হয়। কাগজপত্র ঘেটে সমস্যার কথা তুলে চালকের কাছ থেকে ২ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন তিনি। চালক দিতে অস্বীকার জানালে তাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নেয়ার হুমকি দেন। প্রায় ১৫ মিনিট পর কনস্টেবল নেমে যান গাড়ি থেকে। তিনি চলে গেলে চালকের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে যুগান্তরকে বলেন, আমি ইট নিয়ে আসছি পাগলা থেকে। যাব বাড্ডা এলাকায়। ট্রাফিক পুলিশ আমার কাছে ২ হাজার টাকা চায়। বলে, টাকা না দিলে থানায় নিয়ে যাবে। হাতকড়া পরাবে। আমার পকেট থেকে ১৪শ টাকা কেড়ে নিয়ে নেমে গেছে ট্রাফিক পুলিশ।
মালিবাগ মোড়ে ৪৫ মিনিট অবস্থান করে এমন বেশকিছু ট্রাক, পিকাপভ্যান, ঢাকার বাইরে থেকে আসা দূরপাল্লার বাস থেকে প্রকাশ্যে ট্রাফিক হাবিলদার লাবলু, ট্রাফিক কনস্টেবল এনামুল, ফারুক ও মজিবরকে টাকা নিতে দেখা যায়। গাড়ি থামিয়ে এমন চাঁদাবাজি দেখে মালিবাগ রেলগেট পুলিশ বক্সের পাশে ফুটপাথের কয়েকজন চা দোকানি এই প্রতিবেদককে বলেন, আপনি তো একরাত দেখছেন টাকা ওঠাতে। দিন-রাত সবসময় গাড়ি থামিয়ে টাকা উঠায় ট্রাফিক পুলিশরা। বিশেষ করে রাতের অবস্থা দেখে মনে হয় টোল আদায়ের জন্যই ট্রাফিক পুর্লিশ রাতে ডিউটিতে থাকে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মালিবাগ এলাকার ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) শফিকুর রহমান পরদিন বৃহস্পতিবার দুপুরে মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, রাতের ট্রাফিক পুলিশ সাধারণত আমি নিয়ন্ত্রণ করি না। রাতে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও সড়ক দুর্ঘটনার বিষয় দেখার জন্য ট্রাফিক পুলিশ রাখা হয়। তারা টাকা উঠায় কিনা সে বিষয়ে আমার জানা নেই। তবে তাদের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে আমি জানাচ্ছি।
৩০ এপ্রিল রাত ১১টা থেকে ১২টা পর্যন্ত কমলাপুর টিটিপাড়া মোড়ের ট্রাফিক পুর্লিশ বক্সের পাশে অবস্থান করেও গাড়ি থেকে অবৈধভাবে টাকা নিতে দেখা যায়। ওই এক ঘণ্টায় ১৭টি গাড়ি থেকে টাকা ওঠায় ট্রাফিক পুলিশ। এরমধ্যে রাত ১১টা ৩৩ মিনিটে ঢাকা মেট্রো-ন-১১-১৮৩০ নম্বরের ট্রাক থেকে ট্রাফিক কনস্টেবল বুলবুলকে আড়াইশ টাকা নিতে দেখা গেছে।
১ মে কাকলী ট্রাফিক পুলিশ বক্সের অদূরে দুপুর দেড়টায় পুলিশ সদস্য কাজল একটি অটোরিকশা রেকারিংয়ের ভয় দেখিয়ে চারশ টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই অটোরিকশার চালক জলিল এ তথ্য জানান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই সময় কাজল ৯ নম্বর রেকারের দায়ীত্বে ছিলেন।
কাকলী টু নতুন বাজার রুট : বনানীর কাকলী থেকে গুলশান-২ হয়ে নতুন বাজার পর্যন্ত সড়কে অলিখিতভাবে অটোরিকশা চালকদের রুটপারমিট দিয়েছে ওই এলাকার ট্রাফিক পুলিশ। এজন্য অটো চালকদের কাছ থেকে প্রতি সপ্তাহ ও মাস চুক্তিতে টাকা উঠায় সংশ্লিষ্ট টিআই ও সার্জেন্টরা। তাদের টাকা তোলার জন্য রয়েছে লাইনম্যান দুলাল, শফিক ও রবিউলসহ অন্তত ৫ জন। অটোচালকরা এ অভিযোগ করেছেন।
কাকলী থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত অন্তত ৯০টি অটোরিকশা চলে। প্রতিটি গাড়ি থেকে ওই এলাকার সার্জেন্টদের জন্য সাপ্তাহিক চাঁদা তোলা হয় ৬০০ টাকা হারে। এছাড়া চেকপোস্ট পুলিশের জন্য প্রতিদিন একশ টাকা ও মাসে গাড়িপ্রতি কাকলীর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) নিজাম উদ্দিনকে ৪ হাজার ও নতুনবাজার এলাকায় দায়ীত্বরত টিআইকে ৪ হাজার টাকা দিতে হয়- যা গাড়িপ্রতি মাসে দাঁড়ায় মোট ১২ হাজার ৪০০ টাকা। তবে এই টাকা নেয়ার কথা অস্বীকার করেন টিআই নিজাম উদ্দিন। ১ মে দুপুরে যুগান্তরকে তিনি বলেন, আমি কোনো মাসোহারা নিই না। তবে সার্জেন্টরা টাকা নেয় কিনা আমি বলতে পারব না। অটোরিকশা থেকে টাকা তোলার বিষয়ে তদন্ত চলছে। তার এলাকায় ২৬ জন সার্জেন্ট আছেন বলে তিনি জানান। এক প্রশ্নের জবাবে টিআই দাবি করেন, ওই লাইন (কাকলী টু নতুন বাজার) দুদিন আগে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
অটোর মালিক সার্জেন্ট : কাকলী থেকে নতুন বাজার পর্যন্ত চলা ৯০টি অটোরিকশার মধ্যে অন্তত ৩০টির মালিক ওই এলাকার ট্রাফিক সার্জেন্টরা। এসব গাড়ি গাজীপুর ও ঢাকা জেলা থেকে রেজিস্ট্রেশন নেয়া। এসব গাড়ি ডিএমপিতে চলা আইনত নিষিদ্ধ। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে কতিপয় ট্রাফিক সার্জেন্ট অবাধে নিজের গাড়ি ও চাঁদার বিনিময়ে অন্যদের অবৈধ গাড়ি ওই রুটে চলাচল করাচ্ছে। এরমধ্যে সার্জেন্ট সুশান্তর দুটি, সার্জেন্ট ফিরোজের কয়েকটি অটোরিকশা ওই রুটে চলে। অটোরিকশা মালিকানা বিষয়ে সার্জেন্ট ফিরোজ বলেন, আমার গাড়ি থাকার প্রশ্নই আসে না। গাজীপুর-দ-১১-০১১১৪ নম্বরের অটোরিকশাটি কার, এই প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ একটু হকচকিয়ে যান। বলেন, ওই গাড়ির মালিক আরেকজন। তার বাড়ি আমাদের এলাকায়। গাড়িটি পুলিশ ধরলে আমাকে ফোন দিয়ে ছাড়ানোর কথা বলত। তবে আমি বলতাম পারব না। 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend