জন্মবার্ষিকীর শ্রদ্ধা: রবীন্দ্রনাথ এখন কতটা প্রাসঙ্গিক? রবীন্দ্রনাথ গুরু, প্রশ্ন গুরুতর
বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক বিশেষ সংস্কৃতি৷ সমাজমানসের গভীরে তাঁর প্রভাব৷ জন্মের দেড় শ বছর পর এই সময়ের লেখকেরা তাঁকে কীভাবে পাঠ করেন? সাম্প্রতিক সাহিত্যচর্চায় তাঁর প্রাসঙ্গিকতার রূপটিই বা কেমন? প্রশ্নগুলো নিয়েই রবীন্দ্রজয়ন্তীর এই বিশেষ আয়োজন৷ লিখেছেন একালের প্রতিনিধিত্বশীল দুজন কবি ও কথাসাহিত্যিক
আমাদের এই কালে রবীন্দ্রনাথ নামটি আর কেবল কবি পরিচয়ে আলাদাভাবে বিশেষ অর্থ প্রদান করে না।চাই বা না চাই রবীন্দ্রনাথ বরং নিজেই হয়ে উঠেছেন এমন একটা নাম, যাকে আমরা ব্যাকরণে বলি নামপদ। নামপদ আবার বিশেষ (Particular) এবং সামান্যও (Universal) হতে পারে। সমাজে বিশেষ ‘নামপদ’ কখনো একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবেও যেমন বিবেচিত হতে পারে, সেই সঙ্গে একটি আদর্শ বা মতাদর্শ রূপেও হাজির থাকতে পারে অথবা প্রতিষ্ঠানেরই গোপন নামটি আদর্শ ওরফে মতাদর্শ।রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময় থেকে মৃত্যুর তিয়াত্তর বছর পরও প্রায় সমান প্রতাপের সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে সমাসীন রয়েছেন। যদিও তাঁর উপস্থিতির চেহারাটি এখন আর আগের মতো প্রবলভাবে মূর্ত নয়, বিশেষত, আমরা যদি রবীন্দ্রনাথকে শিল্প-সাহিত্যের উপরোল্লিখিত খণ্ড-টুকরায় বসিয়ে দেখতে চাই। তার এক প্রধান কারণ, আমাদের ব্যাপক জনগোষ্ঠীটি এখনো রয়ে গেছে শিক্ষাহীন, দীক্ষাহীন তো বটেই। যে জনগোষ্ঠীর ওপর একটি দেশ দাঁড়িয়ে থাকে, তিনি সেই অনামিকার অন্তর-সুরের সঙ্গে নিজেকে ঢেলে জীবনচিন্তার যে তাত্ত্বিক মূল্য তৈরি করা দরকার, তা পারেননি। কিন্তু সমাজচিন্তার নানা ক্ষেত্রে আবার তাঁর এক ধরনের প্রভাবও বিদ্যমান দেখা যায়। একদিকে তাঁর কবি পরিচয় বা অন্য যেকোনো পরিচয় এবং অন্যদিকে তাঁর সামগ্রিক পরিচয়, এই দুই পরিচয়ের মধ্যে ফারাক ক্রমেই বেড়ে গেছে এবং একটা টানাপোড়েন তৈরি করেছে। এই দুই অবস্থা সময়ে সময়ে দ্বিমেরুকরণের মাধ্যমে স্ব স্ব জায়গা এবং অর্থও বদল করে থাকে। এই পরিস্থিতিরও একটা ডায়ালেক্টিকস আছে বৈকি। আপাতত ছোট পরিসরের মধ্যে আমরা কবি রবীন্দ্রনাথ এবং বর্তমান সময়ের কাব্যভাবনার সঙ্গে যে টানাপোড়েনটি হাজির রয়েছে, তার ওপর একটু আলো ফেলতে চাই। এ কথা তো সত্য যে আমরা এখন আর রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কবিতা লিখি না। সে প্রয়োজনও নেই। কিন্তু শুধু যে লিখিই না তা নয়, রবীন্দ্রনাথকে আমরা আগের মতো শুদ্ধ আনন্দের জন্যও পাঠ করি না।সমাজ রূপান্তরের মাধ্যমে ভাষার বদল ঘটে। কবিতার ইতিহাসে এই বদলে যাওয়ার বা বদলে দেওয়ার কতগুলো চিহ্নযুক্ত অনুষ্ঠান রয়েছে। আমরা তাকে কাব্য-আন্দোলন বলে থাকি। এই কাব্য-আন্দোলন নির্দিষ্ট সমাজের, নির্দিষ্ট সময়ের রাজনীতিনিরপেক্ষ নয়। কিন্তু ইতিহাসে দেখতে পাই, বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণীর নেতৃত্বে যেসব সাহিত্য আন্দোলন হয়, সাধারণত সেই সব আন্দোলনে রাজনীতির মূল সুর বা প্রশ্নটি একটু আড়াল হয়ে যায়। ক্রমে ক্রমে এই আড়াল পুনরায় স্পষ্টতর হয়ে ওঠে সৎ ও বিদগ্ধ লেখকের কলমে৷বাংলা কাব্যে প্রথম আধুনিকতার চেহারাটি আমাদের সামনে তুলে আনেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর কাব্যের ভেতর দিয়ে তো বটেই, তেমনি নিজের নামের মধ্যেও সেই আধুনিক বিপ্লবের চিহ্ন খোদাই করা রয়েছে। বলাবাহুল্য, ইউরোপীয় আধুনিকতাই ছিল মধুসূদনের আধুনিকতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতার আধুনিকতা তাঁরই হাত ধরে অগ্রসর হয়েছে, তাকে আরও ফলবান করেছে। তবু এ প্রশ্নও যদি কেউ তোলেন যে রবীন্দ্রকাব্যের আলোময়তার চেয়ে মধুসূদনের কাব্যের তেজোদীপ্ততা কিছু কেলভিন বেশি, তবে তার কথা হৃদয়ঙ্গম না করে সঙ্গে-সঙ্গে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা অন্যায় হবে। কিন্তু আমাদের নজর এড়ায় না, বঙ্কিমের পর রবীন্দ্রনাথই সেই প্রথম কবি যিনি সমাজ, রাজনীতি ইত্যাদি গরম বিষয়গুলো নিয়ে যতটুকু সম্ভব পারা যায় সরাসরি কথা বলেছেন, জোরালো মতামত রেখেছেন, এমনকি মাঠেও নেমেছেন। এ কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে কাজটি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ আগে-থেকে-নির্দিষ্ট-করে-রাখা পাটাতন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। এবং তা কবির পক্ষে সম্ভবও ছিল না।কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, যিনি বাংলা ভাষার পুরো প্রান্তরটি তিন শ ষাট ডিগ্রি একনজরে তাকিয়ে দেখেছেন, কিন্তু ইউরোপ মহাদেশকে হাতে রেখেছেন মাপকাঠি হিসেবে। সঙ্গে অবশ্য ভারতীয়তার জন্যও জায়গা ছেড়েছিলেন, তবে অনেকটাই বিমূর্তভাবে। সত্য এই যে রবীন্দ্রনাথ নিজেকে শুধু কবিতায় আটকে না রেখে আরও তেপান্তরী অনুসন্ধানে মনোযোগ দিলে বাংলা ভাষা পেয়ে যায় একটা শক্ত ভিত্তি। বাংলা গদ্যের শুধু যে মাধুর্য, তা নয়, বরং তার ভেতরকার শক্তি, এবং তার অপার সম্ভাবনার দরজার খিলও খুলে দিলেন তিনি। আজ যদি মুখের বা চাঁড়ালি ভাষায় সাহিত্য করার অধিকারের প্রশ্ন উঠে থাকে, তবে বলতে বাধা নেই রবীন্দ্রনাথের তৈরি রাস্তাটিকে পুরোপুরি পরিহার করে তা হাসিল করা হয়তো সম্ভব নয়।শিল্প-সাহিত্য থেকে সমাজ, সবদিকে সমান রকম নজর দেওয়ার কারণেই হয়তো রবীন্দ্রকাব্য হয়ে উঠেছে একটু বেশি বর্ণনামূলক এবং বিশেষত তাঁর প্রথম দিকের কবিতা ‘অকারণে দীর্ঘ’ (ভূমিকা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: শ্রেষ্ঠ কবিতা’)। যা-হোক অতি-বর্ণনা সাধারণত কবিতার সত্যকে কিছুটা আড়াল করে দেয়। চিদঘন মুহূর্ত পার হয়েও কবিতা অতি-কথনের দিকে ঝুঁকে পড়লে, আমরা তখন বুঝতে পারি না এটি অরণ্য না স্রেফ জঙ্গল। রবীন্দ্রকাব্যের আরেকটি বড় গুণ সম্ভবত তার কাহিনিমুখীনতা, যা আমরা অতিসাম্প্রতিক কালের কবিতায় আর
তেমন বিশিষ্টভাবে দেখতে পাই না৷ অবশ্য এ কথাও মনে রাখা দরকার, কাহিনিমিুখীনতার সঙ্গে দৈর্ঘ্যের সম্পর্ক আবশ্যিক নয়, যা আবশ্যিক, তা হলো, মিতকথন, ছন্দ, তা যদি গদ্যও হয়, ধ্বনির সুগ্রাহ্য বিন্যাস, স্মরণযোগ্য পদের অনিবার্য পরিণতির সঙ্গে পাঠককে জড়িয়ে ফেলা। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা সহজেই পেতে পারি ছন্দ-ভঙ্গির বিচিত্র লীলা। ইদানীং বরং কবিতার ভাষায় এমন এক জঞ্জাল উপস্থিত, যা দিয়ে আমরা পাঠকের চেতনাচেতনলোকে পৌঁছাতে তো পারিই না, উল্টো পাঠককে ঠেলে নিয়ে যাই কোনো এক বোবা-ভাষার দিকে, যেখানে জননীগর্ভ থেকে নিয়ে আসা ধ্বনিপ্রস্রবণ বা রক্তস্পন্দন ইতিমধ্যে তিস্তা ব্যারেজের মতো দুর্মতি দিয়ে রুদ্ধ এবং নিষিদ্ধ করে ফেলেছি।
পরিণামহীন আধুনিক কবিপথিকেরা আমাদের রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল করেছিলেন, নিজেরা যু্দ্ধ-নেতৃত্বের দায়িত্বও নিয়েছিলেন, কিন্তু নতুন মধ্যবিত্তের বিকাশ এবং তার স্বার্থের তরেই যেন সেই যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। অস্তিত্বের অধিকারের গৌরব থেকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে পেছনে রেখে এই অনুবাদিত আধুনিকতা কবিতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। কবিতাকে সর্বমানব বা সেই অনামিকার কণ্ঠ থেকে উৎপাটন করার ভুল বোঝাবুঝির খেসারত আমরা এখন যে দিচ্ছি, তার প্রমাণ বেশির ভাগ পত্রপত্রিকায়, লিটল ম্যাগাজিনে, এমনকি ফেসবুকে টাঙিয়ে দেওয়া কবিতার দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
বলতে গেলে এক রবীন্দ্রনাথ একাই বাংলা গদ্যকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন ভাষার নতুনতর বিপ্লবের সামনে। কবিতার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক রেখেও তাঁর গদ্য স্বাধীন, আবার কবিতার জন্য বৈপ্লবিক ইশারা। আমরা সেই তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম কাব্যবিপ্লবের সম্ভাবনার কৌশলগত দিকটি হয় উপেক্ষা করেছি, নয়তো ধরতে পারিনি। বরং বিশ্বপঁুজি পানে ছুটে গেছি হাফ-গেরস্থ হওয়ার তাগিদে।
কাব্যের ধ্বনিমুদ্রায় ধনবান ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শব্দের ভেতরের হীরা হয়ে উঠতে থাকা কার্বন অণু-পরমাণুর স্বভাবটিও জানা ছিল তাঁর। কিন্তু আমাদের কবিকুল, যাঁদের আমরা আধুিনক কবি বলি, সেদিকটায় তেমন নজর দিলেন না, বরং হাঁটু হিঁচড়ে পর-বাগানের দেয়াল ডিঙাতে গিয়ে নিজের হাঁটু ছিলে একাকার করে দিলেন!
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে তাঁর গানের প্রসঙ্গ আসবেই। আমার ধারণা, যাকে আমরা গান বলে জানি, তা যদি সুরারোপ করা না হতো, অথবা গীত না হতো, তবু তার কাব্যগুণ কমার সম্ভাবনা ছিল না। বরং গানগুলোতেই কবিতা বলতে যা আমাদের অনুভূতিতে কাজ করে, তার প্রায় সম্পূর্ণতা রয়েছে। একমাত্র গানেই নেই অতিকথন, অনাবশ্যক দীর্ঘতা। বরং, রয়েছে ইমেজ-স্পষ্টতা, উপমা, রূপক আর লক্ষণার সঙ্গে ধ্বনিমণ্ডলের অনিবার্য সংশ্লেষ। এই গান থেকেও সম্ভবত আমরা খুব বেশি কিছু নিতে পারিনি। আমরা যেন ভুলেই গিয়েছি, কবিতা আসলে গানেরই অনুজ সহোদরা!
আমার ধারণা, বিশেষপদ অথবা সামান্যপদ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটি আসলে ছিল প্রগতিশীলদের, অনুষ্ঠানবাদীদের নয়। এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলা যায় যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটিও অনুষ্ঠানবাদে আচ্ছন্ন। ফলে তঁাকে চেনার ভুল তরিকা সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। এর ফলে যার জন্ম হয়েছে তার নাম সংস্কৃতিবাদ, সমকালীন বাংলা কবিতা সেখানে মিঁউ মিঁউ কান্না ছাড়া বেশি কিছু নয়।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের প্রাচীন সংস্কৃত-সাহিত্য হয়ে মধ্যযুগের সাহিত্য এবং পৃথিবীর আর-আর সাহিত্যরুচির সঙ্গে অন্তরনিষ্ঠ পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমরা সেদিনের সেই তুরস্ক থেকে রোম পর্যন্ত যাওয়া প্রাচীন রাস্তাটিকে সমূলে উৎপাটন করে তার ওপর একটা মিথ্যা ম্যানহাটন গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফলে পাপ আমাদের ছাড়বে কেন?
ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ এখন বরং কবিতা পড়াই ছেড়ে দিয়েছে!
তাঁর কথাসাহিত্যের সামনে দাঁড়িয়ে-জাকির তালুকদার