কেন সেই গোলটিকে ‘ঈশ্বরের হাত’ বলেন ম্যারাডোনা?

ডিয়েগো ম্যারাডোনা
ডিয়েগো ম্যারাডোনা

ছিয়াশির বিশ্বকাপের সেই কোয়ার্টার ফাইনাল এমনিতেই নানা কারণে ছিল ‘আগুনে’।

সে সময়ে আর্জেন্টিনা ও ইংল্যান্ডের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তাপ ম্যাচটিকে এমনিতেই তাতিয়ে রেখেছিল কয়েক গুণ বেশি। ফুটবল ম্যাচ নয়, এ যেন ছিল ফকল্যান্ড যুদ্ধের আরেকটি খণ্ড লড়াই। ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত দুটো গোলেরই জন্ম এ ম্যাচে। সেই গোল দুটোর জনক ম্যারাডোনা ফুটবল সাময়িকী ওয়ার্ল্ড সকারকে নিজের জবানিতে বলেছেন অসাধারণ ম্যাচটির আদ্যোপান্ত। বিশ্বকাপ নিয়ে বিশ্বকাপ কিংবদন্তিদের স্মৃতিচারণা নিয়ে আমাদের নিয়মিত ধারাবাহিক—

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই কোয়ার্টার ফাইনালটির আমেজই ছিল অন্যরকম। সবাই ফকল্যান্ড যুদ্ধ নিয়ে কথা বলছিল। ভাবখানা এমন ছিল যে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা যেন ফকল্যান্ড উদ্ধারের লড়াইয়ে মাঠে নামছে। তবে আমরা ফকল্যান্ড নিয়ে ভেবে আমাদের মনোযোগ নষ্ট করতে চাইনি। আমরা চাচ্ছিলাম যেকোনো মূল্যেই ম্যাচটা জিততে। সত্যি বলছি, জয় ছাড়া সেদিন আমাদের ভাবনায় আর অন্য কিছুই ছিল না।

ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, খেলাটি ২-১ গোলে জিতে আমরা সেবার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পা রেখেছিলাম। হ্যাঁ, দলের পক্ষে আমিই করেছিলাম দুটো গোল। প্রথম গোলটি ছিল বিতর্কিত। আর দ্বিতীয় গোলটি? অনন্য, অসাধারণ। ওই গোলটি আমার কাছে স্বপ্নপূরণের মতোই।

এবার প্রথম গোলটি নিয়ে বলি। চিরবিতর্কিত এক গোল। হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই হাত দিয়েই করেছিলাম সেই গোলটি।

কথাটি শুনে অনেক ইংলিশ সমর্থকই আহত হতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, তাদের অসম্মান করে আমি এটি বলছি না। আমি সত্যি কথা স্বীকার করছি। পুরো ব্যাপারটিই কীভাবে যেন সেদিন ঘটে গেল। আর্জেন্টিনায় এর আগে ওভাবে আমি অনেক গোল করেছি। এমন করে গোল করাকে অনেকে প্রতারণা বলতে পারেন, কিন্তু আমি ওটা প্রতারণা মনে করি না। পুরো ব্যাপারটিই ঘটেছিল রেফারির চোখে ধুলো দিয়ে। এক ধরনের খেলা হিসেবেই দেখুন না ওটা। এভাবে গোল করা ইউরোপের সংস্কৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। কিন্তু লাতিন সংস্কৃতিতে এটাকে চাতুর্য হিসেবেই মনে করা হয়।

গোলটা আমি করেছিলাম ইংলিশ গোলরক্ষক পিটার শিলটনের সঙ্গে লাফিয়ে। লাফানোর সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম শিলটনকে ডিঙ্গিয়ে মাথা দিয়ে বল স্পর্শ করতে পারব না। তাই হাত চালিয়ে দিলাম।

গোল হয়ে যাওয়ার পরও শিলটনের মতো অভিজ্ঞ গোলরক্ষক বুঝতে পারেনি যে আমি হাত দিয়ে গোল করেছি। ব্যাপারটা তার দৃষ্টিতে আনে ইংল্যান্ডের রক্ষণভাগের খেলোয়াড় টেরি বুচার। টেরি চিত্কার করতে থাকে, ‘হাত, সে হাত ব্যবহার করেছে।’ পুরো দল টেরির সঙ্গে শামিল হয় প্রতিবাদে। গোলটা বাতিল হয় হয় অবস্থা।

গোল করেই আমি ছুটে গিয়েছিলাম কর্নার ফ্ল্যাগের দিকে। দেখি, আমার সতীর্থরা কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা যেন ওরাও ঠিক বুঝতে পারছে না। আমি তাদের বললাম, ‘এ কী করছ তোমরা, আমার দিকে ছুটে এসো। আমাকে জড়িয়ে ধরো। গোলটা উদযাপন করতে হবে। নয়তো রেফারি তা বাতিল করে দেবে।’ সংবিত ফিরে পেয়ে আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা আমার দিকে ছুটে এল। আমরা স্বাভাবিকভাবেই গোল উদযাপন করলাম। ততক্ষণে রেফারি ও লাইন্সম্যানের চোখে ধুলো দেওয়া হয়ে গেছে। ইংলিশ ফুটবলারদের প্রতিবাদের মুখে শুনলাম লাইন্সম্যান জোর গলায় বলছে, ‘ওটা গোল।’

দ্বিতীয় গোলটির কথা আর কী বলব! অমন গোলের স্বপ্ন দেখে সব ফুটবলারই। আমার সৌভাগ্য যে আমি ওই ধরনের একটা গোল করেছিলাম। বিশ্বকাপের মঞ্চে ওই ধরনের গোল—সত্যিই ভাবা যায় না।

প্রথম গোলটিকে আমি ‘ঈশ্বরের হাত’ হিসেবে অভিহিত করেছিলাম। কেন করেছিলাম তার ব্যাখ্যায় যাচ্ছি। ব্যাখ্যাটা খুবই সরল। ঈশ্বরই তো আমাদের হাত দিয়েছেন। আর আমি ঈশ্বর-প্রদত্ত ওই হাত ব্যবহার করেই গোলটা করেছিলাম। ওটা ঈশ্বরের হাতের গোল নয় তো কী!

তবে ওই গোল নিয়ে আমার মধ্যে একটা খচখচানি আছে। সবাই চাইলে, সেই গোলটির জন্য আমি প্রকাশ্যে ক্ষমাও চাইতে পারি। খুব সম্ভবত আমার তা-ই করা উচিত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ক্ষমা চাইলেও ইতিহাস পরিবর্তন করে দেওয়ার কোনো সুযোগ কারও হাতে নেই। সেবার আমরা বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। আমি হয়েছিলাম বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend