গদ্যকার্টুন এটা কি একটা জঙ্গল?

আকা : তুলিআকা : তুলিমা বলল, টিপরা, এই পাতাটা ছেড়ে কোথাও যাবে না! কেমন?
টিপরা বলল, ঠিক আছে মা, যাব না।
ইপরা বলল, মা, কেন যাব না। আমরা আর ছোট পিঁপড়াটা নেই। বড় হয়ে গেছি।
মা বলল, তোমাদের জন্য মধু আমি নিয়ে আসছি। তোমরা এই পাতাটা ছেড়ে কোথাও যাবে না। এটাই আমার ফাইনাল কথা।
মা পিঁপড়া বেরিয়ে পড়ল। গাছের ডাল বেয়ে ছয় পায়ে গিয়ে পেঁৗছাল ফুলের বৃন্তে। জায়গাটা বিপজ্জনক। একটা মাকড়সা এখানে জাল পেতে রেখেছে। খুব মিহি জাল। এটা এড়িয়ে যেতে হবে। জালে পা পেঁচিয়ে গেলেই সর্বনাশ।
জাল এড়িয়ে মা পেঁৗছে গেল ফুলের গোড়ায়। পাপড়ি বেয়ে ঢুকে গেল ফুলের ভেতরে। আরেকটু এগোতেই, উফ্… মধু।
প্রথমে নিজে খানিকটা খেয়ে নিল মা পিঁপড়া।
তারপর মুখের চঞ্চুতে ভরে ফিরতে লাগল নিজের বাসায়। যেখানে তার দুই মেয়ে টিপরা আর ইপরা অপেক্ষা করছে।
এদিকে টিপরার মাথায় দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলা করছে। সে বলল, ইপরা চলো, আমরা পাতার ওই পাশে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। মা যখন এসে দেখবে আমরা নেই, তখন ভয়ে কান্না জুড়ে দেবে। তখন আমরা মায়ের সামনে এসে হাজির হব। মা আমাদের দেখে খুব খুশি হবে।
ইপরা বলল, তোর শুধু দুষ্টুমি বুদ্ধি। মা কষ্ট করে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসছে। আমরা তাকে স্বাগত জানাব। পেট ভরে মধু খেয়ে তাকে ধন্যবাদ জানাব। না বাবা, আমরা কোথাও যাব না।
একটা ছোট্ট পাখি এই সময় এসে বসল তাদের খুব কাছে। তারা তাড়াতাড়ি করে পাতার আড়ালে মুখ লুকাল।
মা আসছে। ওদের দুই বোনের মনে খুব আনন্দ। মা আসতেই টিপরা বলল, মা মা, ইপরা বলে, মধু নাকি ভালো খাবার নয়। ও খেতেই চায় না। আমাকে প্রথমে চেখে দেখতে হবে, ভালো কি না, তারপর নাকি ও খাবে।
মা বলল, ইপরা, এটা কী ধরনের কথা। তোমাদের মা কষ্ট করে মধু এনে দিচ্ছে, সেটা আবার খারাপ হয় কী করে। আমি তোমার কাছে এই ধরনের কথা আশা করিিন।
ইপরা বলল, মা, আমি কিছুই বলিিন। সব টিপরা বানিয়ে বলছে।
মা বলল, মুখে মধু নিয়ে এত কথা বলতে পারব না। নে টিপরা, খেয়ে নে।
টিপরা মধু খেল।
ইপরা, তুই কি খাবি?
খাব মা। মধু আমার খুব প্রিয়। ইপরা মধু খেয়ে বলল, খুব ভালো মধু। মা, তুমি এত কষ্ট করে আমাকে মধু এনে দাও। তুমি খুব ভালো। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।
মা বলল, আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি।
টিপরা বলল, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি।
মা দুজনকে জড়িয়ে ধরল ছয় পায়ে। বাচ্চারা খাচ্ছে, এই দৃশ্য দেখে সে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ল।
এমন সময় উঠল জোরে বাতাস। মনে হয়, কালবোশেিখ।
ওদের বাসা যে পাতায়, সেটা গেল ঝরে।
নিচে একটা ছোট্ট ঝরনা।
পাতাটা পড়ল সেই ঝরনার জলে।
ইপরা বলল, মা, মা বঁাচাও।
টিপরা বলল, মা, আমাদের কী হবে? আমরা কি মরে যাব?
মা ওদের দুজনকে নিজের পিঠে তুলে পাতার ওপরে পা উঁচু করে দঁাড়াল। পাতায় পানির ছিটা লাগছে। এই বুঝি মা ভেসে যায়।
মা কঁাদতে কঁাদতে বলল, প্রভু, আমার বাচ্চা দুটোকে অন্তত বঁাচাও। আমার প্রাণের বিনিময়ে হলেও…
পাতাটা গিয়ে একটা নৌকার গায়ে লাগল। মা বাচ্চা দুটোকে পিঠে করে নৌকার কাঠে উঠে পড়ল। জোরে ঢেউ এল। এই বুঝি তারা ডুবে যায়। এক লহমায় তাদের ওপর দিয়ে বয়ে গেল জলের স্রোত। পরের মুহূর্তে জল সরে গেলে মা তাড়াতাড়ি আরও ওপরে উঠে গেল।
তারা উঠে গেল নৌকার ছইয়ের নিচে। এখন তারা নিরাপদ। মা, টিপরা আর ইপরা। তারা ছইয়ের নিচে বঁাশের বেড়ার ফোকরে আরামেই আছে।
গুড়ের একটা কৌটা আছে নৌকায়।
তারা তিনজন চলল গুড়ের সন্ধানে।
বাচ্চা দুটোও এরই মধ্যে বড় হয়ে গেছে। তিনজনেই নিজের পায়ে হঁাটতে পারে।
কৌটাটা যখন খোলা ছিল, মা আর টিপরা ঢুকে গেল ভেতরে। তারা আরাম করে গুড় খাচ্ছে। খাওয়া শেষে তারা ইপরার জন্য গুড় নিয়ে ফিরবে।
হঠাৎ কৌটার মুখ হয়ে গেল বন্ধ। এখন তারা বেরোবে কী করে?
মা কেঁদে উঠল, আমার ইপরার কী হবে? মা আর টিপরা আসছে না। ইপরাও কঁাদে। নৌকার মাঝি গুড় 

খাবেন। কৌটার মুখ খুললেন। গুড় নিলেন। তঁার বন্ধুকেও গুড় দিলেন।
মা পড়ল মাঝির পাতে।
টিপরা পড়ল মাঝির সঙ্গীর পাতে।
মাঝি গুড়টা খেতে যাচ্ছেন। দেখলেন, একটা পিঁপড়া। তিনি পিঁপড়াটাকে আলগোছে তুলে নিয়ে ছেড়ে দিলেন।
আর মাঝির সঙ্গী টিপরাকে দেখতে পেয়ে থালার কোনায় রেখে টিপ দিতে লাগল। টিপরার একটা পা ভেঙে যাচ্ছে। আরেকটা পা ভেঙে যাচ্ছে। টিপরা কঁাদছে। আমাকে মেরো না। আমাকে ছেড়ে দাও। শুনে মা ছুটে গেল মাঝির সঙ্গীর দিকে। তার পায়ে দিল কামড়। কামড় খেয়ে সঙ্গী মায়ের দিকে হাত বাড়াল। মাকে টিপে মারতে লাগল। মায়ের পা গেল। পেট গেল। শুধু মাথাটা আছে।
মা বলল, টিপরা তুই পালা।
দুটো ভাঙা পা নিয়ে টিপরা গেল ইপরার কাছে।
বাছারা, তোরা ভালো থাকিস। মা মারা গেল।
টিপরা চুপ হয়ে গেল। সে শুধু বলে, আমার মা নিজের প্রাণ দিয়ে আমাকে বঁাচিয়ে রেখেছে।
ইপরা বলে, কেঁদো না বোন। তোমার নিজের দুটো পা ভাঙা। আমি অনেক যত্ন করে তোমার এই পা দুটো ভালো করে দেব।
ইপরা টিপরার পায়ে ওষুধ লাগায়। টিপরা বলে, আমরা ভীষণ দুঃখী। আমাদের মা নেই।
ইপরা বলে, তবু আমার একটা বোন আছে।
টিপরা বলে, বোন না পচা, আমার জন্য মা মারা গেছে।
রাতের বেলা টিপরার ঘুম ভেঙে গেল। সে শুনল, ইপরা গান গাইছে, ‘ও তোতা পাখি রে, শেকল খুলে দিতে পারি, আমার মাকে যদি এনে দাও’।
দুজনে গলা জড়িয়ে মা মা বলে কঁাদতে লাগল।

 

প্রিয় পাঠক। ক্ষমা চাই। আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমি পিঁপড়ার গল্প শোনাচ্ছি। কিন্তু গল্পটা পড়ে একটা পিঁপড়ার জন্য আপনার মনে একটুও মায়া জন্মেনি? আপনার মনে হচ্ছে না, পিঁপড়াটা যেন ফিরে আসে তার সন্তানদের কাছে?
এখন মনে করে দেখুন, সাত-সাতজন মানুষ আর স্বজনদের কাছে ফিরে আসতে পারলেন না। তঁাদের অপহরণ করার পর খুন করা হয়েছে। খবরে নানা কথা আমরা জানছি। একজনকে মারতে গিয়ে সাতজনকে মারা হয়েছে।
আমরা একটা পিঁপড়ার মৃত্যুতেও ব্যথা পাই। একজন মানুষকে কেন মানুষ খুন করবে? তারপর তঁার ড্রাইভারের কী অপরাধ?
এখন শোনা যাচ্ছে, পেছনের গাড়ির মানুষগুলো অপহরণের দৃশ্য দেখে ফেলেছিলেন, তঁাদেরও মারা হয়েছে। মানুষের প্রাণ এত সস্তা।
আর শোনা যাচ্ছে, একটা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য এটার পেছনে আছেন! রক্ষকেরা এখন নাগরিকদের প্রাণসংহারে নেমেছেন? আর তঁাদের পেছনে আছেন নেতারা, যঁাদের আমরা ফুলের মালা দিয়ে বরণ করি।
এটা একটা দেশ? এটা একটা রাষ্ট্র? নাকি এটা একটা জঙ্গল?
আর এরা তো কোনো কাজ ঠিকমতো করতেও পারে না। একজনকে মারতে গিয়ে সাতজনকে মারে। এদের নিষ্ঠুরতার সীমা নেই, লাশের মুখ বিকৃত করে, পেট কেটে দেয়।
পিঁপড়ার মৃত্যু আমরা সইতে পারি না। মানুষের এই অপঘাত মৃত্যু আমরা সইব কী করে?

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend