আমার মা সব পারে- আহসান হাবীব
পৃথিবীর সেরা মা কে?
সেই যে একটা পৌরাণিক চীনা গল্প আছে না, এক প্রেমিকা প্রেমিককে পরীক্ষা করার জন্য বলল,
তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চাই আমি।
কী পরীক্ষা নেবে? সব পরীক্ষার জন্য আমি প্রস্তুত।
যাও, তোমার মায়ের হূৎপিণ্ডটা নিয়ে আসো।
প্রেমে অন্ধ প্রেমিক ছুটল মায়ের কাছে। মাকে হত্যা করে তাঁর হূৎপিণ্ড নিয়ে ছুটল প্রেমিকার কাছে, ভালোবাসার পরীক্ষায় পাস করতে…।
পথে হঠাৎ আছড়ে পড়ল প্রেমিক। হাত থেকে ফসকে গেল মায়ের তাজা হূৎপিণ্ডটা। ছেলে খুঁজে পেতে হাতে নিল মায়ের তাজা হূৎপিণ্ড। তখনো ধক ধক করছে… মায়ের হূৎপিণ্ড এবার কথা বলে উঠল, ‘কিরে খোকা, ব্যথা পেলি?’
এটা নিছকই একটা গল্প। কিন্তু সন্তানের প্রতি তীব্র ভালোবাসা কেবল মায়ের পক্ষেই সম্ভব। এ জন্যই বোধ হয় মা সব সময়ই মা।
রিকশা-সিএনজি অটোর পেছনে প্রায়ই লেখা দেখি ‘মায়ের দোয়া’।
আসলে মায়ের দোয়ার প্রতি সবারই একটা আলাদা আস্থা আছে। আমার মায়ের কাছে অনেকেই দোয়া নিতে আসে। পরিবারের নিজেদের লোকজন ছাড়াও বাইরের পরিচিত-অপরিচিত অনেকেই আসে। আমার মা-ও সবার জন্য অকৃপণভাবেই সেই কাজটা করেন। আমার মায়ের আবার দোয়া করার একটা স্পেশাল জায়গা আছে, বিশাল আয়না সেট করা একটা স্টিলের আলমারির সামনে বসে তার দোয়া চলে। একদিন আমি ঠাট্টা করে বললাম, আম্মা, আপনার দোয়া তো কোনো কাজে আসবে না, সব আয়নায় রিফ্লেক্ট করে যাচ্ছে…!
মা অবশ্য তাঁর ‘উন্মাদ’ পুত্রের কোনো কথায় তেমন গুরুত্ব দেন না। এবারও দিলেন না।
মা দিবস উপলক্ষে আমার মাকে নিয়ে লেখার অনুরোধ এসেছে। তাঁকে নিয়ে নতুন করে আর লেখার কিছু নেই। তিনি এখন যেন এক ক্লান্ত মহিরুহ (ছোটখাটো এই মানুষটাকে আমি বিশাল মহিরুহই ভাবি সব সময়)। দীর্ঘ ৮৫ বছর ধরে আমাদের ছায়া দিয়ে এসেছেন… এখন তিনি বিদায় নিতে চান। মায়ের সঙ্গে আমি প্রায়ই মৃত্যু নিয়ে কথা বলি। তিনি জানান, তিনি মৃত্যুর জন্য আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। সারা জীবন তিনি মানুষের জন্য দোয়া করেছেন, এখন কেউ এলে তিনি বলেন তাঁর জন্য দোয়া করতে। তাঁর চাওয়া অবশ্য সামান্য, তাঁর যেন একটি সুস্থ মৃত্যু হয়। গ্ল্যাডিয়েটর-এর ম্যাক্সিমাসের সেই উক্তির মতো—
‘অ্যাট লিস্ট গিভ মি এ ক্লিন ডেথ…’
তবে না, আমরা মাকে এত তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে চাই না। তিনি যদিও
অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তার পরও তাঁকে সুস্থ রাখার সব চেষ্টাই করে যাচ্ছি আমরা। ইদানীং তিনি কিছু কিছু বিষয় ভুলে যাচ্ছেন। তিনি যে একটা বই লিখেছিলেন, সেটা তাঁর মনে নেই। তাঁর বইটাই তাঁকে পড়তে দেওয়া হলো। পড়ার পর তিনি আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলেন, ‘এই বই তিনি লিখেছেন?’
মা যখন তাঁর অ্যাকাউন্টের জমা টাকার কথাও ভুলে গেলেন, তখন ভাইবোন সবাই চিন্তিত হয়ে উঠলেও আমি যেন ভেতরে ভেতরে খুশি হয়ে উঠলাম, কারণ আমি যে তাঁর নমিনি… হা হা হা! (তবে তাঁর এই ভুলে যাওয়া রোগের চিকিৎসা শুরু হয়েছে)
সানন্দা পত্রিকায় একটা বিভাগ আছে, ‘আমার মা সব জানে’ আর আমি আমার মা সম্পর্কে বলি, ‘আমার মা সব পারে’।
এই প্রসঙ্গে একটা উদাহরণ দিয়েই বরং লেখাটা শেষ করি। মা যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন একা একা। মেজ ভাই তাঁকে টিকিট পাঠিয়েছে, মা একাই যাবেন। আমরা ভয়ে ভয়ে আছি, মা পারবেন তো একা যেতে? মা দিব্যি একা চলে গেলেন (এক নারীর মাকে সাহায্য করার কথা ছিল, উল্টো সেই নারী হঠাৎ অসুস্থ হওয়ায় মা-ই নাকি তাঁকে সাহায্য করে নিয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে)।
তিন মাস পর ফিরে এলেন দেশে… একা একাই। যেদিন ঢাকা আসবেন, সেদিন বড় ভাই বলল, মাকে সারপ্রাইজ দেওয়া হবে, এয়ারপোর্টে কেউ যাবে না। মা অবাক হবেন কেউ আসেনি, তখন সে গিয়ে হঠাৎ হাজির হবে, এমনটাই প্ল্যান। কাউকে না নিয়ে বড় ভাই একাই রওনা দিয়ে দিল গাড়ি নিয়ে। এদিকে মায়ের প্লেন কোনো কারণে বহু আগে চলে এল (বা টাইম শিডিউলে বড় ভাইয়েরই কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছিল); মা ঢাকায় নেমে দেখেন, আসলেই সারপ্রাইজ, তাঁর ছয় ছেলেমেয়ের কেউ উপস্থিত নেই এয়ারপোর্টে। তিনি কী আর করেন, একটা স্কুটার নিয়ে একাই বিশাল দুই স্যুটকেস নিয়ে চলে এলেন শহীদুল্লাহ হলে (বড় ভাই তখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। সেখানেই আমরা সবাই অপেক্ষা করছি মায়ের জন্য)।
তখন আবার এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছে। হঠাৎ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গাড়ি ঢোকা বন্ধ… এমনকি শহীদুল্লাহ হলের গেটও বন্ধ… এর মধ্যে সব বাধা-বিপত্তি এড়িয়ে আমার বৃদ্ধ মা এয়ারপোর্ট থেকে স্কুটারে করে এসে হাজির… আমরা হতভম্ব। তারও ঘণ্টা খানেক পর বড় ভাই এল। সে এসে মাকে দেখে ডাবল হতভম্ব। তাই বলছিলাম, আমার মা সব পারেন। তবে সেই সব পারা মা এখন অনেক কিছুই একা একা আর পেরে ওঠেন না। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় সন্তান না থাকলেও আমরা বাকি পাঁচ ভাইবোন মিলে তাঁর না-পারাগুলোকে অতিক্রম করে তাঁকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করছি।
মা দিবসে আমার মায়ের সঙ্গে সঙ্গে সব মায়ের সুস্থতা কামনা করছি…।
পুনশ্চ: মা নিয়ে একটা কোটেশন ‘ভালো মা হওয়ার একটাই উপায় … মা হওয়া!’