নারায়ণগঞ্জে সাত খুন: তদন্ত কমিটির সামনে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সাক্ষ্য : স্বজনেরা কাঁদলেন, কাঁদালেন
কথা বলতে গিয়ে তাঁরা সবাই কেঁদেছেন। কখনো তাঁদের কণ্ঠে ছিল হতাশা, কখনোবা ক্ষোভ। কেউ হত্যাকাণ্ডের শিকারের বাবা-মা, কেউ ভাই-বোন, কেউবা স্ত্রী অথবা সন্তান। সবাই অভিযুক্ত করেছেন নূর হোসেন আর র্যাবকে। দাবি করেছেন, নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক, যাতে এমন ঘটনা আর কখনো না ঘটে।নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত খুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির সামনে গতকাল শনিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সাক্ষ্য দিয়েছেন নিহতদের স্বজনেরা। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এই সাক্ষ্য গ্রহণ চলে।
সকালে একে একে হাজির হন নিহতের পরিবারের স্বজনেরা। সাক্ষ্য দিতে প্রথমে আসেন নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, শ্বশুর মো. শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান এবং নজরুলের ভাই আবদুস সালাম। দুপুর পর্যন্ত তাঁরাই সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দেওয়ার পর বেরিয়ে শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটিকে বলেছি, এ ঘটনায় নূর হোসেন ও র্যাব জড়িত। আমরা বলেছি, অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলেই র্যাব সদস্যদের প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন তাঁদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হোক।’ র্যাবের কোনো সদস্যের নাম বলেছেন কি না জানতে চাইলে শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক তারেক সাঈদ মোহামঞ্চাদ, মেজর আরিফ হোসেন ও নারায়ণগঞ্জ ক্যাম্প অফিসের অধিনায়ক এম এম রানার নাম বলেছি।’ শহীদুল ইসলাম জানান, তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাঁকে নানা জায়গা থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেই পুলিশের নিরাপত্তায় গাড়িতে করে চলে যান।
নজরুলের পরিবারের পরে আইনজীবী চন্দন সরকারের দুই মেয়ে সুসিঞ্চতা সরকার ও সেঁজুতি সরকার এবং মামলার বাদী বিজয় কুমার পাল সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দেওয়া শেষে বিজয় কুমার পাল অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘তদন্ত কমিটি জানতে চেয়েছিল, আমরা এই হত্যাকাণ্ডে কাউকে সন্দেহ করছি কি না। আমরা বলেছি, হত্যার ধরন দেখে আমাদের মনে হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এর সঙ্গে জড়িত। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও তথ্য-উপাত্ত দেখে আমাদের মনে হয়েছে, র্যাব-১১ এর সঙ্গে জড়িত। আমরা সেটি বলে এসেছি। অভিযুক্ত তিন র্যাব সদস্যের নামও বলেছি।’
আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ির চালক ইব্রাহিমের বাবা আবদুল ওহাব মিয়া, স্ত্রী হনুফা বেগম, ছেলে রনি, বোন রহিমা, ভাগনে শাকিল সাক্ষ্য দেন।
হনুফা বেগম সাক্ষ্য দিয়ে এসে বলেন, ‘আমার স্বামীসহ সাত হত্যায় প্রশাসনের লোকজন জড়িত বলে আমার মনে হয়। আমি বিচার চাই।’
মনিরুজ্জামান স্বপনের পরিবারের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য দেন তাঁর বাবা হায়দার আলী খান, স্ত্রী মোর্শেদা বেগম ও ভাই রিপন। সাক্ষ্যের পরে স্বপনের ভাই রিপন বলেন, ‘নূর হোসেনের সঙ্গে নজরুল ভাইয়ের বিরোধ ছিল। আমার ভাই কিছুদিন ধরে বলত, নজরুল ভাই বিপদে আছে, আমিও বিপদে আছি। যেকোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। এই হত্যার জন্য নূর হোসেন দায়ী। র্যাবকে টাকা দিয়ে সে আমার ভাইসহ সাতজনকে হত্যা করেছে।’
এরপর সাক্ষ্য দেন জাহাঙ্গীরের আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সামসুন্নাহার, মা মেহেরুন, ভাই শাহজাহান ও শাহাবুদ্দিন। কাউন্সিলর নজরুলের বন্ধু তাজুল ইসলামের পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁর মা তাসলিমা, বাবা আবুল খায়ের, ভাই সাইফুল ইসলাম রাজু সাক্ষ্য দেন। পরে আবুল খায়ের বলেন, ‘আমি বিচার চাই। কিন্তু আর কেউ যেন এভাবে সন্তান না হারায়।’ নজরুলের বন্ধু সিরাজুল ইসলামের পরিবারের পক্ষে তাঁর বড় ভাই রফিকুল ইসলাম, ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম সাক্ষ্য দেন।
সন্ধ্যায় সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহাজাহান আলী মোল্লা। তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা নিহত সাতজনের পরিবারের ২৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে তদন্তের স্বার্থে আমরা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।’ তদন্তের অগ্রগতি সন্তোষজনক কি না জানতে চাইলে শাহাজাহান আলী মোল্লা বলেন, ‘আমরা কার্যবিধি মোতাবেক কাজ করছি। আমরা এগোচ্ছি।’ র্যাব-১১-এর অভিযুক্ত তিন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার ছাড়া তদন্তকাজ এগিয়ে নেওয়া সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
গণশুনানি: তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, ১২ ও ১৫ মে নারায়ণগঞ্জে তারা গণশুনানি করবে। ওই দিন সকাল ১০টায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে গিয়ে যে কেউ ঘটনার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিতে পারবেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রসঙ্গত, ৫ মে হাইকোর্টের নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. শাহাজাহান আলী মোল্লাকে চেয়ারম্যান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
নূর হোসেন ও ইয়াসিন মিয়াকে অব্যাহতি: সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়াকে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ। গতকাল বিকেলে সিদ্ধিরগঞ্জ পুল এলাকায় থানা আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় সর্বসমঞ্চতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে সভাপতি মজিবুর রহমান জানান। তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্ত মহানগর কমিটিকে জানানো হয়েছে। দল থেকে বহিষ্কারের জন্য মহানগর কমিটিকে সুপারিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিএনপির প্রতিবাদ: গুম-হত্যার প্রতিবাদে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে শহরের ডিআইটিতে অবস্থিত জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ সমাবেশ করে বিএনপি। নগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামাল বলেন, জনসভার অনুমতি না পেলেও বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আসবেন এবং নিহতদের পরিবারকে সমবেদনা জানাবেন।
ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত স্থগিত: নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা আইনজীবী সমিতির পূর্বঘোষিত আজ রোববারের র্যাব-১১ কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি স্থগিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা ওই দিন দুপুরে আদালত চত্বরে মানববন্ধন ও কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করবে। জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘অভিযুক্ত র্যাব কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা পূর্বঘোষিত র্যাব অফিস ঘেরাওয়ের কর্মসূচি স্থগিত করেছি।’
স্মারকলিপি: এদিকে নারায়ণগঞ্জে হত্যা, গুম ও অপহরণের ফলে জনমনে আতঙ্ক দূর করার দাবিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে গতকাল সঞ্চারকলিপি দিয়েছে হিউম্যান রাইটস ফর পিস বাংলাদেশ। গতকাল দুপুুর ১২টার দিকে সংগঠনের সভাপতি আইনজীবী মনজিল মোরসেদ এবং সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী এ সঞ্চারকলিপি দেন।
শামীম ওসমানের নিরাপত্তায় পুলিশ: আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমানকে পুলিশি নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শামীম ওসমান গত শুক্রবার রাতে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানের পাহারায় শহরের চাষাঢ়ায় অবস্থিত রাইফেল ক্লাবে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করার পরে চলে যান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, নারায়ণগঞ্জে যে কেউ নিরাপত্তা চাইবেন, পুলিশ মনে করলে তাঁকেই নিরাপত্তা দেওয়া হবে। কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজন অপহরণের ঘটনার পর শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি জিডি করেছিলেন। তাতে তিনি নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।