রাষ্ট্র ও রাজনীতি : আত্মঘাতী আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতার মোহ- মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাত ব্যক্তিকে অপহরণের কয়েক দিন পর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় সারা দেশে ক্ষোভ-বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ঝড় বয়ে চলেছে। প্রকাশ্য রাজপথে এই অপহরণ চালানো হয়েছিল দিনদুপুরে কমান্ডো স্টাইলে, অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে।
অপহৃত ব্যক্তিদের যে যানবাহনগুলোতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটির গায়ে নারায়ণগঞ্জে কর্তব্য পালনে নিয়োজিত এলিট ফোর্স র্যাব-১১-এর স্টিকার ও সাইনবোর্ড লাগানো ছিল৷ প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকে সেটা স্বচক্ষে দেখেছেন। অপহরণ ঘটনার পরপরই এ জন্য সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে অভিযুক্ত করে নারায়ণগঞ্জে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলেও প্রায় দুই দিন নূর হোসেন নারায়ণগঞ্জে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নাকের ডগায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন বলে খবর ছাপা হয়েছে। অথচ, ওই দুই দিন তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের বা গ্রেপ্তারের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি কোনো সংস্থাই, যা খুবই রহস্যজনক।
জনমনে ধারণা জন্মেছে যে নূর হোসেন গা ঢাকা দেওয়ার পরই তাঁকে ধরপাকড়ের লোক দেখানো তোড়জোড় শুরু করা হয় এবং জনমনে সন্দেহ যে তাঁকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন হওয়ার পরেই এসব নাটকের অবতারণা করা হয়েছে। শুধু নূর হোসেনকে এই সাতজনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের একমাত্র হোতা সাজানো নাটকের মঞ্চায়ন এখন জোরেশোরে এগিয়ে চলেছে। জনমনে সন্দেহটা দৃঢ়মূল হওয়ার প্রধান কারণ হলো, স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সরাসরি নূর হোসেনকে হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করে বেশ কিছু কথিত প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন। তঁার এ ধরনের পদক্ষেপ নেপথ্যের আসািমদের আড়াল করার অপপ্রয়াস কি না, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়৷
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে নারায়ণগঞ্জের একসময়ের নামী রাজনীতিবিদ এবং আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা খান সাহেব ওসমান আলীর বংশধরদের রাজনৈতিক অধঃপতনের মূর্ত প্রতীক হয়ে দঁাড়িয়েছেন শামীম ওসমান। এখন এ দেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ক্ল্যাসিক উদাহরণও বটে। জনমনে বিভীষিকা সৃষ্টিকারী পলিটিক্যাল গডফাদারের প্রসঙ্গ উঠলে সবার আগে নাম আসবে তঁারই। এই একটি পরিবারের কাছে পুরো নারায়ণগঞ্জবাসী ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে কয়েক বছর ধরে আক্ষরিক অর্থেই জিিম্ম। কোনো অজ্ঞাত কারণে প্রধানমন্ত্রীর স্নেহসুধা অব্যাহত রয়েছে শামীম ওসমানের ওপর, এ ধরনের ভয়ংকর গডফাদার ইমেজ সত্ত্বেও। প্রধানমন্ত্রীর স্নেহ দিন দিন আরও বেপরোয়া করে তুলছে শামীম ওসমান ও তাঁর মাস্তান বাহিনীকে। গত বছর ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তাঁর ভাইপো আজমেরী ওসমানের সংশ্লিষ্টতার নানা বিশ্বাসযোগ্য আলামত পাওয়ার পরও মামলাটিকে যেভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে, তাতে নারায়ণগঞ্জবাসীর মনে দৃঢ়মূল বিশ্বাস জন্মেছে যে আওয়ামী লীগ যত দিন ক্ষমতায় আসীন থাকবে, তত দিন শামীম ওসমানের জোর-জুলুম, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও মাস্তানি থেকে তাদের পরিত্রাণ নেই।
অথচ, এটা খুবই আশ্চর্যজনক যে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও সরকারের অবজ্ঞা ও অবহেলার শিকার হয়ে চলেছেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেলিনা হায়াৎ আইভীকে যেন তিনি সহ্যই করতে পারছেন না! গত মেয়র নির্বাচনেই নারায়ণগঞ্জের ভোটাররা শেখ হাসিনাকে ব্যালটের মাধ্যমে তাঁদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁরা শামীম ওসমানকে নয়, সেলিনা হায়াৎ আইভীকে চান তাঁদের মেয়র হিসেবে। এক লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে শামীম ওসমানকে হারিয়েছিলেন আইভী, শামীম ওসমানকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রদান সত্ত্বেও। বলা প্রয়োজন, ভোটারদের এই বিপুল প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে শামীম ওসমানকেই আবার মহাজোটের প্রার্থী করাটা নেতৃত্বের একগুঁয়েমির পরিচায়ক ছিল। কিন্তু, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ায় শামীম ওসমানকে দ্বিতীয়বার প্রত্যাখ্যানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নারায়ণগঞ্জবাসী, সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তা সত্ত্বেও এটি যে
আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে যাচ্ছে, এই কথাগুলো বলার সাহস এ মুহূর্তে দলের কারোরই নেই বোধগম্য কারণে। আর, একই কারণে নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনের কর্মকর্তারাও বুঝে গেছেন যে চাকির বাঁচাতে হলে শামীম ওসমানের ব্যাপারে অন্ধ-কালা-বোবা সাজা ছাড়া তাঁদের উপায় নেই।
কিন্তু, এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং গুম-খুন-অপহরণের ক্রমবর্ধমান ধারাবাহিকতার অসহনীয় তাণ্ডব চলতে দিলে তা আওয়ামী লীগের পরাজয়কে ত্বরান্বিত করবে, সময় থাকতে এটুকু শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিতে চাই। গডফাদার ও মাস্তান পোষণের রাজনীতি যদি তিনি অব্যাহত রাখেন, তাহলে ১৯৮২ সালের মতো আবারও আরেক সামরিক স্বৈরশাসককে ক্ষমতায় আসার পথটা তিনি মসৃণ করে দেবেন—এতে সন্দেহ করার কারণ আছে কি? ১৯৮২ সালে বিচারপতি সাত্তারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আবহ সৃষ্টির জন্য তদানীন্তন সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ এরশাদ সুপরিকল্পিতভাবে দেশের নানা জায়গায় আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করে চলেছিলেন একের পর এক, এ কথা এখন হয়তো আমরা ভুলে গেছি! ওই রকম এক ঘটনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা থেকে একাধিক খুনের আসামি এক দুর্ধর্ষ মাস্তানকে গ্রেপ্তার করার ঘটনায় সারা দেশে কী মহা আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথা অনেকের মনে নাও থাকতে পারে। এখন কিন্তু প্রমাণিত হয়ে গেছে যে এ দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন পরিকল্পনা অনুসারেই ওই ঘটনাগুলো ঘটানো হয়েছিল এরশাদের ক্ষমতা দখলের পথ সুগম করার প্রয়োজনে।
এটাও দুঃখজনক যে গডফাদার ও মাস্তান পোষণকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে থাকেন। এটা আগেরবারের শাসনামলের মেয়াদেও প্রমাণিত হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে ফেনীর জয়নাল হাজারী, নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান ও লক্ষ্মীপুরের আবু তাহেরের মতো দেশের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী-গডফাদাররা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিজয়কে সুনিশ্চিত করে দেবে বলে তঁার বিশ্বাস জন্মেছিল। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমান জয়নাল হাজারীর সীমাহীন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার আরও ২৯৯ জন জয়নাল হাজারী প্রয়োজন৷’ তারপর নির্বাচনের আগে সেনাবাহিনীকে যখন মাঠে নামানো হয়েছিল তখন জয়নাল হাজারী, শামীম ওসমান এবং আবু তাহেরের মতো বীর পুঙ্গেবরা প্রাণভয়ে ভেগে পগার পার হয়ে গিয়েছিল, এটাও এখন ইতিহাস! নির্বাচনের আগে ওই সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে বিচারপতি লতিফুর রহমান এক বক্তৃতায় সহাস্যে জাতিকে জানিয়েছিলেন যে, ‘দুষ্টু লোকেরা সব ভেগে গেছে৷’
অবশ্য তিনিও সত্য বলেননি, প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীর ধাওয়া খেয়ে ওই সময় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা দেশছাড়া হলেও তাদের জায়গাটা ঠিকই দখল করে নিয়েছিল বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী ও ক্যাডাররা। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় বিপর্যয়ের পেছনে এ ঘটনা অন্যতম ভূমিকা পালন করেছিল, সেটি প্রমাণিত সত্য। ২০১৪ সালে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আবারও বিএনপি-জামায়াত নির্বাচনে জিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা ছিল। বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের চালের ভুলে ওই সুযোগ তারা হারিয়েছে, কোনো সন্দেহ নেই। ওই ভুলের ফায়দাভোগী হয়ে শেখ হাসিনা এখন তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন৷ যেভাবেই সুযোগটা আসুক না কেন, এই স্বর্ণ-সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করাটাই তাঁর জন্য, আওয়ামী লীগের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে আমি মনে করি।
মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ এ দেশের গণমানুষের কাতার থেকে উঠে আসা দল। তাই, হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার করে আরেকটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ করেই আওয়ামী লীগকে তার নৈতিক জনপ্রতিনিধিত্বের দাবিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ধুরন্ধর চাণক্য নীতির প্রতিযোগিতায় জিতে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকা এবং মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার বর্তমান অস্বস্তিকর অবস্থার আশু অবসান ঘটাতেই হবে, এই গণ-ম্যান্ডেটহীন শাসন আওয়ামী লীগকে মানায় না। কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করে জনগণের মন জয় করতেই হবে।
একই সঙ্গে ছাত্রলীগ বা যুবলীগের মাস্তানি, অস্ত্রবাজি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, খুনোখুনি কঠোরভাবে নির্মূল করতে হবে। গডফাদারদের পেশির জোরে কিংবা অস্ত্র ও ক্যাডারের জোরে নির্বাচনী ফলাফল ছিনতাইয়ের বদখেয়াল পরিত্যাগ করতে হবে। সেলিনা হায়াৎ আইভীর মতো নেতা-নেত্রীর হাতে আওয়ামী লীগের ঝান্ডা তুলে দিতে পারলে নির্বাচনে জেতার জন্য আওয়ামী লীগের মাস্তানের প্রয়োজন পড়বে না।
বরিশাল সিটি করপোরেশনে দলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে মেয়র নির্বাচনে হেরে গেলেও মরহুম শওকত হোসেন হিরণের জানাজায় বিপুল জনসমাগম সারা জাতিকে জানিয়ে দিয়েছে, তিনি কতটা জননন্দিত ছিলেন৷ তিনি বরিশালের মানুষের জন্য কী করেছিলেন৷ একটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনের জন্য জাতির আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে যথাসম্ভব শিগগিরই পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনের সংলাপ শুরুর পাশাপাশি সুশাসন প্রদানের কঠোর সাধনা চালিয়ে যাওয়াই আওয়ামী লীগের হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের একমাত্র পথ।
মইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি৷