সরকারের নারায়ণগঞ্জ পরীক্ষা – সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সারা দেশের দৃষ্টি এখন নারায়ণগঞ্জের দিকে, আর নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাকিয়ে আছেন সারা দেশের দিকে, উদ্ধারের আশায়। ঢাকার ছায়ায় বেড়ে ওঠা এই শহরটিতে একসময় শান্ত, অন্তরঙ্গ একটি সাংস্কৃতিক জীবন ছিল, নিরুদ্বেগ নাগরিক জীবন ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য একটা সুনাম ছিল শহরটির, কিন্তু করপোরেট ইঁদুর-দৌড়ের মধ্যে এটি কখনো পড়েনি। আশির দশকে মাঝেমধ্যে নারায়ণগঞ্জ যেতাম, আমার এক বন্ধুর বাসায়। তার মা ছিলেন, বাবা ছিলেন না। মা কখনো ঢাকা আসতে চাইতেন না। ‘ঢাকায় মানুষের অকারণ নাভিশ্বাস ওঠে’, তিনি বলতেন, ‘ঢাকায় জীবন খুব অনিরাপদ।’ তিনি নিরাপদ নিস্তরঙ্গ নারায়ণগঞ্জে থেকেই একদিন পরপারে চলে গেলেন। আমার বন্ধুটি এরপর ঠাঁই নিল ঢাকায়। মেধাবী কিশোর ত্বকীকে যখন খুন করল ভয়ানক সন্ত্রাসীদের একটি দল, সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার জান্নাতবাসিনী মাকে বলেছে, ‘দেখে যাও, তোমার নিরাপদ শহরের কী অবস্থা।’ অপহরণ-খুন-শীতলক্ষ্যাকরণের মিছিল থেকে শেষ সাতটি প্রাণ বলি হওয়ার পর হঠাৎ করেই নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। যাদের বিরুদ্ধে এই সাত প্রাণ সংহারের অভিযোগ উঠেছে, তাদের তিনজনের গায়ে দুই সপ্তাহ আগেও ছিল আইনের পোশাক। এই পোশাক নিয়ে শুরুতে অনেক বিতর্ক ছিল; অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন, কালো কেন? কিন্তু কালো পোশাক যে দুর্বৃত্ত এবং সন্ত্রাসীদের মনে ভয় ধরায়নি, তা তো নয়। এই পোশাক তো মানুষের আস্থাও অর্জন করেছিল অনেক ক্ষেত্রে। জিঙ্গরা যেভাবে বাড়ছিল, বেপরোয়া হচ্ছিল, এই কালো পোশাকের জন্যই তাতে ভাটা পড়েছিল। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের ঘটনার পর র্যাবের ওপর মানুষের আস্থা কী আর থাকবে? তা ছাড়া, আইনের রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসে; আইনের সঙ্গে, নৈতিকতার সঙ্গে প্রহসন করা হয়, মানুষের বিশ্বাসভঙ্গের মতো অপরাধ করা হয়। কলেজবেলা এক সিনেমা দেখেছিলাম, সেখানে নায়ক দিলীপ কুমার এক দুর্নীতিবাজ পুলিশ অফিসারকে বলেছিলেন, ‘এই পোশাক পবিত্র, এই পোশাক গায়ে দেওয়ার অধিকার তোমার নেই।’ দুর্নীতিবাজ অফিসার শুধু হুংকার দিয়ে যাচ্ছিল ‘শাট আপ’।
দিলীপ কুমার শাট আপ হননি। কিন্তু সাধারণ মানুষ হয়। সাধারণ মানুষ নায়কদের মতো অমর, অজয় নয়। তাদের শক্তি নেই, তারা নেহাত ছাপোষার দল। তাদের ঘাড়েও মাথা একটি করেই। কাজেই সন্ত্রাসীদের পক্ষ নিয়ে কেউ পোশাকের অমর্যাদা করে৷ একটা হুংকার দেওয়ার আগেই তারা শাট আপ হয়ে যায়। তা ছাড়া, সন্ত্রাসীরা এখন আর ছিঁচকে টাইপের নয়: এরা যাকে বলে রাঘববোয়াল। এদের এক শ রকমের ব্যবসা থাকে। পুলিশের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে নাম লেখা থাকে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় যে মূল অভিযুক্ত, তার শুধু বাংলাদেশ পুলিশের নয়, ইন্টারপোলের খাতাতেও নাম লেখা আছে। তার পরও তার নামে ১১ কি ১২ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এতগুলো আগ্নেয়াস্ত্র একজনের নামে কেন হবে—এগুলো দিয়ে ছোটখাটো একটা বাহিনীই তো চালানো যায়—সে প্রশ্ন কেউ করেনি। কাগজে দেখলাম, তার অবৈধ বালুমহাল উচ্ছেদ হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিটি পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আইনের রক্ষকদের মনে হলো, বালুমহালটি অবৈধ? এত দিন তাহলে কি এটি বৈধ ছিল? তার ট্রাকস্ট্যান্ড থেকে অবৈধ অস্ত্র আর মাদকও উদ্ধার হয়েছে। এত দিন কি এগুলো বৈধ ছিল?
ত্বকীকে হত্যা করার পর নারায়ণগঞ্জ ক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল। মানুষ পথে নেমেছিল, কারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাও পত্রপত্রিকায় লেখা হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনে নড়ন-চড়ন হয়নি। প্রশাসন মানে সরকার। সরকার দেখল, অভিযোগ উঠেছে যাদের বিরুদ্ধে তারা তার দলের। ফলে একটা অলিখিত নির্দেশ জারি হয়ে গেল সবার ওপর: নড়ন-চড়ন নাস্তি। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন। বিচার না পেয়ে তিনি সন্ত্রাসবিরোধী ত্বকী মঞ্চ তৈরি করলেন। সেই মঞ্চের একটি আলোচনা সভায় আমি গিয়েছিলাম। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেই সভায় বলেছিলেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ত্বকী হত্যার বিচার হতে হবে, তা না হলে সন্ত্রাসীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। স্যারের কথাগুলো, দুঃখজনকভাবে সত্যি প্রমাণিত হলো। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, বড় সন্ত্রাসীদের শাস্তি না হলে মেজো-ছোট সন্ত্রাসীরাও উৎসাহিত হয়ে অপকর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের তারকাখচিত সন্ত্রাসীদের কিছু হচ্ছে না দেখে পাথরঘাটা অথবা দুপচাঁচিয়ার সন্ত্রাসীরা যদি অপহরণ-ব্যবসায় নেমে পড়ে, তাহলে দেশটা মগের মুলুক হতে কত বাকি থাকে?
সব অপরাধেরই শাস্তি হওয়া উচিত। এটি সরকারের একটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। আমাদের সরকারের লোকজন তো আর ভিন্নগ্রহ থেকে আসেনি—তারাও তো রক্তমাংসের মানুষ। তাহলে একজন অপহৃত ব্যবসায়ী বা রাজনীতিকের স্ত্রী-সন্তান এবং আপনজনের বুকফাটা কান্না কেন তাদের টলায় না, তাদের বিবেকে ভয়ানক একটা মোচড় দেয় না? প্রাণহীন ত্বকীর ছবিটি দেখে চোখের পানি ফেলেনি এমন মানুষ নেই। তাহলে?
আর রাজনীতিবিদ হলেই অপহৃতের পরিবারের জন্য সমবেদনা জাগাতে হবে না, এটা কি কোনো বিবেকের কথা হলো? ইলিয়াস আলী অপহৃত হয়েছেন আজ দুই বছর হলো। তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি অনুরোধ জানিয়েছিল, তার বাবাকে তার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য। চিঠিটা পড়ে চোখের পানি ধরে রাখা কষ্টকর হয়েছে। এ রকম চিঠি প্রতিদিন, প্রতি রাতে লিখে যাচ্ছে অনেক শিশু, অদৃশ্য কাগজে, তাদের প্রার্থনার ভাষায়। তারা কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি নেতার ছেলেমেয়ে, কেউ বা অন্য কোনো দলের রাজনীতিবিদের। অথবা ব্যবসায়ী, অথবা সাধারণ মানুষের। এদের কথা ভেবেও অন্তত অপহরণ-খুন বন্ধের জন্য সরকারকে সব শক্তি নিয়ে নামতে হবে। এবং সরষের মধ্য থেকে ভূত তাড়াতে হবে।
একজন সন্ত্রাসীকে গায়ে-মাথায় বড় হতে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে সুবিচার, বিবেক আর সুনীতির শরীরকে তিলে তিলে ক্ষয় হতে দেওয়া। কাগজে দেখলাম নারায়ণগঞ্জের সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডগুলোর পর বিএনপি তীব্র কণ্ঠে প্রতিবাদ জানিয়েছে, সরকারকে ব্যর্থ-ব্যর্থ বলছে। কিন্তু বিএনপির আমলে এই সন্ত্রাসীরা কি গায়ে-মাথায় বাড়েনি? কত সন্ত্রাসীই তো পাললেন বিএনপির ক্ষমতাবানেরা, তারা কোথায় এখন? বিএনপির দুঃসময়ে তারা কি সাহায্যটুকু করছে? এখন আওয়ামী সরকার হয়তো ভাবছে, সন্ত্রাসীদের দরকার বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্য। বিএনপি যদি সরকারকে বলে, ‘সন্ত্রাসীরা আমাদের ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছু করেনি, আপনাদেরও করবে না। সন্ত্রাসীদের ঝেড়ে ফেলে দিন,’ তাহলে একটা কাজের কাজ হয়, একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করা যায়। তার পরও যদি সরকার সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে শূন্য-সহ্যবোধ না দেখায়, তাহলে মানুষ রাস্তায় নামবে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ নেমেছে। ভবিষ্যতে রাস্তায় নামা মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে মানুষ সামনে এগোতে চায়। এর কোনো বিকল্প থাকে না।
‘সন্ত্রাসীরা কোনো দলের নয়’—এ কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী বহুবার বলেছেন; আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির নেত্রীও বহুবার বলেছেন। তাহলে কেন সন্ত্রাসীরা কারাগারে অথবা পালিয়ে থাকার পরিবর্তে বুক চিতিয়ে হাঁটে, অথচ আইন মান্য করা, রুচিশীল শিক্ষিত, মেধাবী মানুষেরা তাদের শিকার হতে থাকেন? কাগজে দেখলাম, নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের প্রধান অভিযুক্ত পলাতক হওয়ার পর তাঁর দোকান-মার্কেট, বালুমহাল ইত্যাদি দখলে নেওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন বিএনপির এক স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা। ধরা যাক দেশে একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হলো, বিএনপি ক্ষমতায় এল। তখন এই প্রভাবশালী যে সন্ত্রাসীদের জন্য একটা অভয়ারণ্য তৈরি করবেন না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক কারণে আশ্রয় দিলে কিছুদিন দলের লাভ হয়। মাস্তানি-সন্ত্রাসের একটা তাৎক্ষণিক ফায়দা হয়তো পাওয়া যায়। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয় সমাজের, দেশের। একইভাবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে দলীয় প্রভাবে আনা হলে, সরকারি দলের প্রতি আনুগত্যের মাপে চাকরিতে নেওয়া হলে, পদায়ন-পদোন্নতি নির্ধারিত হলে একটা সর্বব্যাপী অরাজকতা সৃষ্টি হয়। তাহলে যে প্রশ্নটি প্রধান হয়ে দাঁড়ায় তা হলো: এ রকম একটি দেশের জন্য কি একাত্তরে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম?
সরকারের জন্য নারায়ণগঞ্জ একটি অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দেখা দিয়েছে। সরকার যদি কিছুদিন নড়াচড়া করে আবার নিষ্ক্রিয়তায় ফিরে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে সারা দেশে নারায়ণগঞ্জ ছড়িয়ে পড়বে। একসময় ফেরার উপায় থাকবে না। আর যদি সরকার সন্ত্রাসীদের মূল উচ্ছেদে নামে, নিজের মানুষ পরের মানুষ বিবেচনা না করে, সন্ত্রাসীদের ধরে, এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে, ত্বকীসহ সব খুন ও অপহরণের সুষ্ঠু বিচার করে, সারা দেশের অপহৃত ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে, তাহলে আমার বন্ধুটি তার মাকে বলতে পারবে, শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, ঢাকাও এখন নিরাপদ৷
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।