পাপে ছাড়ে না বাপেরে- বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম
সেদিন যেন কোথা থেকে ফিরেছিলাম বেশ রাতে। আগাগোড়াই আমি ঘরকোণা লোক। ১১টার আগেই বাড়ি ফেরার অভ্যাস। ইদানীং আর তেমন রাজা-উজির মানি না, তাই গাড়ি থেকে নেমে ‘মা মা’ বলে চিৎকার করতে করতে যখন ঘরে ফিরি তখন প্রায়ই তিন ছেলে-মেয়ে, বউ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে তখন সম্রাটের থেকে খুব একটা ছোট মনে হয় না। নিত্যদিনের মতো সেদিনও ফিরেছিলাম। তখনো রাত ১১টা বাজেনি। ঘরে ঢুকেই বিছানায় প্যাকেট। তাকাতেই স্ত্রী বলল, পীর হাবিব পাঠিয়েছে। পীর হাবিব আবার কি পাঠাতে পারে? সে তো ছিল দিলি্লতে। ১০-১২ দিন আগে এক দুপুরে ফোন করেছিল, ‘দাদা, দাদার সঙ্গে কথা বলে এইমাত্র বেরুলাম। আপনাকে কী যে ভালোবাসেন তিনি। আপনার দেওয়া পানির জার নিয়ে অনেক কথা হলো। আরও কত কথা। বাংলাদেশের দুজনকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন। একজন আপনি, অন্যজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।’ পীর হাবিবের দাদা মানে একজন আমি, অন্যজন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জি। প্যাকেট খুলে দেখি শাড়ি আর পাঞ্জাবি। পীর হাবিবকে খুবই স্নেহ করি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সে আমায় উপহার দিতে পারে। তবু কি মনে করে দিলি্ল থেকে আমার জন্য পাঞ্জাবি, ওর ভাবীর জন্য শাড়ি এনেছে তা ওই জানে। কিন্তু উপহারটি আমায় আলোড়িত করেছে, হৃদয় শীতল করেছে। পীর হাবিবকে নিয়ে আরেক দিন লিখব। আজ অন্য প্রসঙ্গে আরও দুই-চার লাইন লিখি।
পরশু হঠাৎই ‘এক মহারাজা মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী’ শিরোনামে বাংলাদেশ প্রতিদিনে এক চমৎকার প্রতিবেদন দেখলাম। প্রথম মনে করেছিলাম না জানি কি! পড়ে দেখলাম কিছুই না। গতকালও প্রতিবেদনটি কন্টিনিউ করেছে। ১০-১২ বছর আগে আমার নামে একই খবর সপ্তাহে দুই-তিনবার ছাপা হতো। ব্যাপারটি নিয়ে পরে কোনো সংখ্যায় অবশ্যই লিখব। তবে শিরোনাম ঠিক হয়নি। লতিফ সিদ্দিকী কীসের মহারাজা? লতিফ সিদ্দিকী ‘মহাসম্রাট মন্ত্রী’ লিখলে তবু একটা মানানসই হতো। আমাদের বংশের নামে সম্রাট হুমায়ুন-আকবরের আমলে লাখেরাজ পাট্টা আছে। পরগনার পর পরগনা আমাদের পূর্ব পুরুষদের নামে সম্রাটদের লাখেরাজ করা আছে। আমাদের ভাতিজা আবুল হাসান চৌধুরী কায়সারদের স্বাধীন বাংলাদেশেও কয়েক হাজার একর জমি ছিল। মারাঠা বীর মহারাজা শিবাজি, তার নামে মহারাজা চলে। মাননীয় মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর নামে ওসব চলবে কেন? সম্রাট বাবর মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বেশি দিন বাঁচেননি। আমি বাবর রোডে বাস করি। তাই প্রতিবেদককে এসব নিয়ে সামান্য ভেবে দেখা উচিত ছিল। বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক অমিল আছে, যেটা আওয়ামী লীগের সঙ্গেও আছে। তাই বলে অযৌক্তিক কোনো কিছু মুখ বুজে মেনে নেওয়ার মানুষ আমি নই। এখানে কেউ যে ধোয়া তুলসী পাতা নয়, সেটা সবাই জানে। যিনি প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন তিনিও জানেন। চট্টগ্রাম সমিতিকে ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি বরাদ্দ দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিয়ে করেছেন ফাইলে এটা লিখে তিনি আসমান ভেঙে ফেলেননি। বর্তমান অনেক মন্ত্রীর লেখাপড়া নেই, তাই তারা ফাইলে নোট দেন না বা দিতে পারেন না। বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক অর্থমন্ত্রী হিসেবে ফাইলে নোট দিয়েছেন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ। নোট দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পুরনো ফাইল পড়ে দেখলে তাক লেগে যেতে হবে। যাক এসব কথা। এখন আসল কথায় আসি।
ব্যবহৃত কাপড় ময়লা হলে পরিষ্কার না করে আর ব্যবহার করা যায় না। সেটা ধোপা দিয়ে অথবা যে কোনোভাবে। খুব বেশি ময়লা কাপড় পরা যায় না। গণতান্ত্রিক দেশে পাঁচ বছর পরপর বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, ময়লা কাপড় ধোয়ার মতো ব্যাপার। ভালো ঘুম থেকে ওঠা ঝরঝরে শরীরের মতো একটি সুস্থ সুন্দর নির্বাচন। কিন্তু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মানুষকে কোনো সজীবতা তো দেইনি বরং হতাশ করেছে। চরম অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে রাজনীতি, রাজনৈতিক সংগঠন ও নেতাদের ওপর। যাদের ওপর মানুষের আস্থা ছিল অপরিসীম সেই সমাজপতি নেতা-নেত্রীদের প্রতি আস্থা নেই। চোর-চোট্টা, গুণ্ডা-বদমাইশ, লুটেরাকেও সাধারণ মানুষ যতটা ভরসা করে, কেন যেন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, গোষ্ঠী-দলকে ততটা ভরসা করতে পারছে না। হতাশার চরম প্রকাশ ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের সাত গুম-পরবর্তী খুনে। কদিন আগে অপহরণ করা হয়েছিল এ বি সিদ্দিককে। অনেকেই মনে করছে ওটা ছিল একটা নাটক। কিন্তু সাত অপহরণ শেষে এমন নৃশংস খুনে দেশ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা খুন করতে পারে তাতে কোনো দোষ নেই। যত দোষ সেই খুন কেউ দেখলে। এখন দেখার অপরাধেও খুন হতে হয়। যেমনটা নির্বিবাদী চন্দন সরকার হয়েছে। এই হচ্ছে সমাজ, সরকারের অবস্থা।
র্যাব একটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী নতুন প্রতিষ্ঠান, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা বেশ সুনাম করেছে। দুর্নাম যে ছিল না তাও নয়। নিরীহ ছাত্র লিমনের পায়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে সন্ত্রাসী সাজানোর কোনো মানে ছিল না। একটি প্রতিষ্ঠান যখন ন্যায়নীতি ভুলে যায় তার ওপর আল্লাহর গজব পড়ে। এক-দুজন সদস্যের অন্যায় ঢাকা দিতে পুরো প্রতিষ্ঠানের কেন বদনাম হবে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ কেউ কখনো কখনো ধরাকে সরা জ্ঞান করে নিজেদের তো ক্ষতি করেই- দেশ, জাতির মানবতা ও মনুষ্যত্বের চরম ক্ষতি করে। কেউ অন্যায় করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিচার করলে কোনো প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হয় না। ছেলেবেলায় ভাড়াটিয়া খুনিদের দিয়ে প্রতিপত্তিশালীদের খুনের কথা শুনতাম। টাঙ্গাইলে সবুর খান বীরবিক্রমের বাড়ির সামনে বল্লার প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সুধাংশু শেখর সাহা এমপির খুন ছিল খুব আলোচিত। সে ছিল ‘৬০-‘৬২ সালের ঘটনা। প্রকৃত হত্যাকারীদের কম-বেশি শাস্তিও হয়েছিল। কারণ তখন কোনো সরকারি এজেন্সি অতটা জড়িত থাকত না। কিন্তু এখন আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে যারা তারাই যদি টাকা খেয়ে মানুষ মারে তাহলে আর রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কোথায়? প্রতিপক্ষকে হত্যা করে যদি ক্ষমতায় থাকা যেত বা সামাজিক প্রতিপত্তি রক্ষা করা যেত তাহলে এ পৃথিবী এতদিন হত্যাকারীদের পদানত হতো কিন্তু এখনও তা হয়নি। বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখ লাখ নিরীহ মানুষের হত্যার জন্য দায়ী তো বটেই, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও হত্যা করেছিল পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাকেও একদিন ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। পাপে ছাড়ে না বাপেরে। আমাদের এক পুলিশ অফিসার একদিনও যুদ্ধ না করে কাদেরিয়া বাহিনীর এডমিনিস্ট্রেটর আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমের সুপারিশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে ঢুকেছিল। বেশ সুনামও কুড়িয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে সেলুট দেওয়া থেকে শুরু করে জিয়াউর রহমানের হাত থেকে প্রেসিডেন্ট পদক গ্রহণ, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পদক গ্রহণ- সব কিছুতেই ছিল প্রথম কাতারে। কিন্তু সেই আকরামের রুবেল হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজা হয়েছিল। দেড় যুগ জেল খেটে সেদিন বেরিয়েছে। মাঝে একবার জামিন পেয়েছিল, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হওয়ায় সে জামিনও বাতিল হয়েছিল। হাইকোর্টে আপিল করা হলে হাইকোর্ট সে আপিল তাকিয়েও দেখেনি, নিম্ন আদালতের সাজা বহাল রাখে। পরে সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু সাজা খেটেই তাকে বের হতে হয়েছে। আমি তার আপিল পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বারবার পড়ে দেখেছি, গ্রামগঞ্জের সাধারণ মায়মাতব্বররাও প্রমাণাদি ছাড়া কোনো অভিযোগে একদিনের জন্যও কাউকে সাজা দেবে না। কিন্তু নিম্ন আদালত সাজা দিয়ে দিয়েছিলেন মহামান্য হাইকোর্ট তা বহাল রেখেছিলেন। অথচ সত্যিই, ওই হত্যার সঙ্গে এসি আকরাম জড়িত ছিল না। তার অর্থ এই নয় যে, সে ধোয়া তুলসী পাতা ছিল। এসি আকরামকে আমিও ভালোবাসতাম কারণ শুশুর বন্ধু মুকুল ও আকবরের মেয়ে ছোট্ট শাপলা ছিল আমার দীপ-কুঁড়ি-কুশির মতো প্রিয়। সেই শাপলাকে আকরামের ছেলে তুহিন বিয়ে করেছিল। তাই ওদের প্রতি আমার খুবই স্নেহ ছিল। সেদিন তার ডিউটি ছিল না। বিধিমতো যেখান যেখান থেকে সার্টিফিকেট দেওয়া দরকার নিয়েছিল। কিন্তু ওইসব সার্টিফিকেটের দিকে কোনো বিচারক তাকিয়েও দেখেনি। সে সময় অশান্ত মানুষকে শান্ত করার দরকার ছিল তাই করা হয়েছিল। বহু বছর আগে ঢাকা-টাঙ্গাইল রোডে নাটিয়াপাড়া-বারইখোলায় এক দুর্দান্ত ডাকাতি হয়েছিল। সেখানে এসি আকরাম পিস্তল খুইয়ে ছিল। সে জন্য সে ঘরে ঘরে এমন অত্যাচার করেছিল যাতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু আকরামের হৃদয় কাঁপেনি, পোশাকের গরম কমেনি। মা-বাপ-চাচার বয়সী মানুষকেও সে অত্যাচার, অপমান-অপদস্থ করতে ছাড়েনি। যার ফল আল্লাহতায়ালা এই দুনিয়াতেই দিয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রে এমনই হয়। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের ঘটনাও একই রকম। নজরুল ও নূর হোসেন একই গোয়ালের গরু_ শামীম, নাসিমদের অনুরক্ত ভক্ত। পত্র-পত্রিকায় যা দেখছি তাতে নারায়ণগঞ্জের মতো অমন অভিশপ্ত করপোরেশন বোধহয় আর নেই। পরিষ্কার নিষ্কলঙ্ক ভাবমূর্তির আইভী রহমানের চারপাশে এমন ধরনের কাউন্সিলর ভাবতেই অবাক লাগে। শামীম ওসমানের অনুগত নূর হোসেন এখন কাউন্সিলর নজরুল হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। টাকা নিয়ে র্যাবের কর্মকর্তারা খুন করেছে অভিযোগ প্রমাণিত হলে মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাদের গ্রেফতার করবেন। অভিযোগ প্রমাণিত হলে গ্রেফতার কেন, সাজা হবে। সে সাজা ফাঁসির কম হওয়ার তো কোনো রাস্তা দেখি না। অভিযোগ প্রমাণিত হলে গ্রেফতার করা হবে, তাহলে কী কারণে মন্ত্রীর মেয়ের জামাইসহ বড় বড় কর্মকর্তাকে তুলে আনা হয়েছে? তারা জড়িত না থাকলে তাদের তুলে আনায় র্যাবের ওপর একটা মানসিক চাপ পড়বে না? একদিকে প্রতিষ্ঠানগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যদিকে সাধারণ মানুষের সন্দেহ, তার ওপর হাইকোর্টের গ্রেফতারের নির্দেশ। এখনো প্রভাবশালীরা তাদের কোলে নিয়ে থাকবেন? এভাবে আর কতদিন? দেশকে একেবারে ধ্বংস করে ফেলার সুযোগ কারও হাতে ছেড়ে দেওয়া যায় না। এরপরও যদি দেশবাসী সক্রিয় প্রতিবাদ না করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তার জন্য পিতা-মাতারা তাদের দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে সর্বনাশ ফেরাবে কে?
এক সময় গণতন্ত্রের জন্য সরকারি প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের জন্য কত সংগ্রাম করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের সাধনাই ছিল সরকারি প্রভাবমুক্ত নির্বাচন। সেই নির্বাচনই এখন সবচেয়ে বেশি সরকারি প্রভাবে কলুষিত। চোরের কাজ চুরি, রাষ্ট্রের কাজ পাহারা দেওয়া। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বা সহযোগিতায় চুরি-ডাকাতি দেখে প্রকৃত চোর-ডাকাতরাই স্তম্ভিত হয়ে গেছে। নির্বাচনে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছুটা সরকারি প্রভাব খাটালেও না হয় বলা যেত, তা নয়। চোরের মার বড় গলার মতো কোনো রাখঢাক নেই, দারোগা-পুলিশ, র্যাব, বিডিআর নিয়ে ডাকাতি। কোনো প্রতিকার নেই। সাড়ে চারশ উপজেলার মধ্যে এখন ১৭টা বাকি। তার একটা টাঙ্গাইলের বাসাইলে। আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত এমপি অনুপম শাজাহান জয় হাতে ধরে বলে কয়ে কাউলজানির হবিকে দাঁড় করিয়েছিল। টাঙ্গাইলের শক্তিশালী নেতারা তাকে ঘাড়ে ধরে বসিয়ে দিয়েছে। এখন তাদের প্রার্থী সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ছাত্র ইউনিয়নের কাজী অলিদ ইসলাম, মার্কা ঠুনকো কাপ-পিরিচ। পড়ে গেলেই শেষ। সরকারি দলেও অনেকেই চাচ্ছে না। নবনির্বাচিত এমপি তো নয়ই। কারণ তার বাবা শওকত মোমেন শাজাহানের মৃত্যুর এক দিন আগে এই অলিদ বাসাইল আওয়ামী লীগ অফিসে তার সঙ্গে মারামারি করেছিল। অনেকে মনে করে, সেই অপমান সইতে না পেরে হঠাৎ করে মারা গেছে। হতেও পারে। মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে আমায় ফোন করেছিল। বলেছিল, ‘স্যার, কত সময় কত কিছু করেছি তারপরও কাছে গেলে কত আদর-যত্ন পাই। কিন্তু এখন আর মানসম্মান নিয়ে থাকার উপায় নেই। অলিদের মতো ছেলের কাছে এমন অপমান বড় বেশি বুকে লাগে। মাফ করে দিয়েন স্যার।’ সত্যিই পরদিন তার জানাজায় মাফ করে দিয়েছিলাম। এখন আওয়ামী লীগে কোনো আদব-কায়দা নেই, বড়-ছোটর পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগ করতে হলে গুণ্ডা-পাণ্ডাদের হুমকি-ধামকি, লাথি খেয়েই করতে হবে। কদিন আগে বাসাইল-সখীপুর উপনির্বাচনে নানা ছলাকলা করে আমাকে অংশ নিতে দেয়নি। আওয়ামী লীগ নিজেরাই যা করার করেছে। একজন জিএম মালেক, হরিণ মার্কা। প্রচুর পয়সা খরচ করে লোকজনকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। নিজের কেন্দ্রে ৯৯% ভোট পেয়েছে- এ এক অলৌকিক ব্যাপার। হরিণের বালি বালি নোনা মাংস আমার দলের দুই-চারজনও খেয়েছিল। যেহেতু কৌশল করে আমাদের নির্বাচন করতে দেয়নি তাই কেউ কেউ আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জেদ ধরেছিল। বিদ্রোহী প্রার্থী বলেছে সরকারি প্রার্থী কারচুপি করে তার বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে। সরকারি প্রার্থীর কথা অখ্যাত লোক, এলাকায় যার চলাফেরা নেই সে কী করে এত ভোট পেতে পারে? সব টাকার কারবার। ঘেচুয়া কেন্দ্রের ফলাফল এক মাস স্থগিত ছিল। গত ১৬ এপ্রিল ভোট হয়েছে, তাতে সরকারি প্রার্থীকে কয়েকশ ভোটে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে ভোট ছিল ২৭০১। সরকারি দল পেয়েছে ৩০০, বিদ্রোহী ১৭০০ কয়েক ভোট। সরকারি প্রার্থী আগেই ২২৩৬ ভোটে এগিয়ে ছিল। কিন্তু তারপরও হরিণের বিশ্বাস ছিল ওই ২২৩৬ ভোট অতিক্রম করেও সে জয়ী হবে। মানে বাড়ির কাছের কেন্দ্রের মতো সব ভোট পাবে। ব্যাপারটি বড় আজব। ওই এলাকায় ঘরে ঘরে বিদেশি। তা ছাড়া কর্মক্ষেত্র, মৃত্যু ও অসুস্থ এসব কারণে ১০%-১৫% ভোটার ভোট দিতে পারে না। ‘৭০ সালে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাও কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পাননি। আমরা সারা জীবন সংগ্রাম করে ৬০-৭০% ভোট আশা করতে পারি না। গৌরী সেনের টাকার কি দাপট, তারা শতভাগ ভোট পায় বা পাওয়ার আশা করে। অন্যখানের কথা বলতে পারব না। তবে ঘেচুয়া কেন্দ্রে জনাব মালেক প্রতি ভোটারকে ১০০০ থেকে ৫-৭ হাজার পর্যন্ত টাকা দিয়েছে, যে জন্য বিচার হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন, দুদক বা অন্য কেউ কিছুই করেনি। এসব কারণে আগামী ১৯ মে বাসাইল উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে বলে অনেকে মনে করে। আমাদের এলাকার লোকজন গরু, খাসি, উট অন্যান্য বন্যপ্রাণীর মাংস খেলেও হরিণের মাংস খুব একটা খায় না, খেতে পায়ও না। তাই হরিণের মাংসের প্রতি তাদের একটা টান আগাগোড়াই ছিল। তারা এও জানে না হরিণের মাংস খুব একটা সুস্বাদু নয়, বেলে বেলে নোনতা। নোনতা আর বেলে কিচকিচে হলেও তবুও খাওয়া যায়। কিন্তু জনাব আবদুর রহিম যে ঘোড়া নিয়েছে সেটা একটা বিচিত্র ব্যাপার! ঘোড়ার দুধ, মাংস খাওয়া যায় না। গরুর নাদা ক্ষেতের সার হয় কিন্তু ঘোড়ার নাদায় তাও হয় না। উড়োজাহাজ হলেও না হয় মরিশাস যেতে পারত। কারণ নির্বাচন ছাড়া কোনো সময় সে দেশে থাকে না। কিন্তু ঘোড়া দিয়ে কী হবে? কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী নাজমুল হুদা খান বাহাদুরের মার্কা আনারস। তার অবস্থা নাকি দিন দিন ভালো হচ্ছে। কয়েক দিন ঘোরাফেরা করে আমারও তেমন মনে হয়েছে। ৯ তারিখ নাইকানী বাড়ী, আদাজান, আন্দারীপাড়া ও বালিনা গিয়েছিলাম। নাইকানী বাড়ী আগাগোড়াই গামছা বেশি। ইনশাল্লাহ গামছার প্রার্থী খান বাহাদুর সেখানে ভোটও পাবে বেশি। কিন্তু আমি অবাক হয়েছি, আদাজান, আন্দারীপাড়া ও বালিনাতে বাসাইল উপজেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সাধারণ সম্পাদক রাহাত হাসান টিপু এক সাধারণ উঠন্ত যুবক। এলাকার মানুষ তাকে এত ভালোবাসে আমার ধারণাই ছিল না। সন্ধ্যার পরপর ৩টা নির্বাচনী সভাতেই বিপুল মহিলা সমাগম হয়েছিল। বুকভরে গিয়েছিল ছেলেমেয়েদের কলরবে। ছেলেবেলা থেকেই বাচ্চারা আমার পাগল, আমিও তাদের প্রতি পাগল। বাচ্চা পেলে আর কিছু লাগে না। কার বাচ্চা তা দেখার দরকার নেই। বাচ্চা হলেই হলো। কুশিমনি আসার পর বাচ্চাদের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে আরও লাখগুণ। প্রায় ৩০-৪০ বছর বাচ্চাদের চকলেট খাওয়াই। পকেটে টাকা থাকুক আর না থাকুক চকলেট থাকে। আমরা যখন কাছাকাছি ছিলাম তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও কতবার চকলেট নিয়েছেন, একে ওকে বিলিয়েছেন, আবার কখনো গলা শুকালে নিজেও খেয়েছেন। চকলেট বিলানো আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। বাচ্চারা কলরব করলে কী যে আনন্দ লাগে বলে বুঝাতে পারব না। যতই বলি একটার বেশি নিও না, তাও তিন-চারটা করে নেয়। দুই চারবার তাদের জিভ চেটে দেখেছি মিষ্টি লেগে আছে। ৯ তারিখ যখন আন্দারীপাড়া হয়ে আদাজান যাচ্ছিলাম ৭০-৮০টা ছোট ছোট বাচ্চা ‘মার্কাটা কি? আনারস’ আনারস স্লোগান দিচ্ছিল। গাড়ি থামাতেই কিলবিল করে হাত বাড়াচ্ছিল হ্যান্ডসেক করতে। একের পর এক ধরছিলাম। তিন-চার বছরের একটা মেয়ে হাততালি দিয়ে লাফাচ্ছিল আর বলছিল, ‘কাদের সিদ্দিকী এসেছে, কাদের সিদ্দিকী এসেছে, আমাদের কাদের সিদ্দিকী এসেছে’। ১০-১২ বার লাফালাফির পর শেষবার বলল, ‘কাদের ভাই এসেছে’।
কী বললে সে শান্তি পাবে বুঝতে পারছিল না। ছোট বাচ্চাদের আলতো আলতো কথা শুনে বুক জুড়িয়ে গিয়েছিল। দক্ষিণা ঠাণ্ডা বাতাসও তেমন জুড়াতে পারবে না, ছোট বাচ্চাদের ‘কাদের ভাই এসেছে’ শুনে যেমনটা হয়েছিল। বর্তমানে নির্বাচন আর নির্বাচন নেই। জোরাজুরি, ডাকাতি। বাসাইল উপজেলা নির্বাচনে কেউ জোরাজুরি, ডাকাতির আশা করে না। আমার বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারটি খেয়াল করবেন। টাঙ্গাইলের গুণ্ডা বাহিনী যাতে বাসাইল নির্বাচনে কোনো প্রভাব খাটাতে না পারে। মানুষ অবাধে যাকে খুশি তাকে ভোট দিতে চায়। পাশের উপজেলা সখীপুরে ২৭ মার্চ উপজেলা নির্বাচন হয়েছে। সেখানে গুণ্ডাদের প্রভাব পড়েনি, কারচুপি হয়নি বলে লোকজন মেনে নিয়েছে। বাসাইলেরটাও যেন তেমন হয়- এটাই প্রত্যাশা।
লেখক : রাজনীতিক।
(সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন)