সন্দেহ-সংশয় সবার মনে – সোহরাব হাসান

 

নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও সাত খুনের ঘটনায় গতকাল সকালে স্থানীয় সার্কিট হাউসে তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা৷ কমিটিকে তাঁরা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ না করার­­ অনুরোধ জানান l
নারায়ণগঞ্জে অপহরণ ও সাত খুনের ঘটনায় গতকাল সকালে স্থানীয় সার্কিট হাউসে তদন্ত কমিটির সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে যান জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা৷ কমিটিকে তাঁরা হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য গ্রহণ না করার­­ অনুরোধ জানান l

সকাল ১০টায় নারায়ণগঞ্জ সার্কিট হাউসে পেৌছেই দেখি বিভিন্ন টেলিভিশনের গাড়ি অপেক্ষমাণ৷ সাংবাদিকেরা িবক্ষিপ্ত ঘোরাফেরা করছেন৷ তখনো তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা এসে পেঁৗছাননি৷ সার্কিট হাউসের আগেই আদালত ভবন৷ সেখানে কালো ব্যাজ পরা আইন-জীবীরা প্রতীকী ধর্মঘট পালন করছেন৷
ঘড়িতে ঠিক ১০টা ১১ মিনিট বাজতেই দুটি বড়সড় গাড়িতে তদন্ত কমিটির কর্মকর্তারা সার্কিট হাউসে এসে পেঁৗছালেন৷ সাংবাদিকেরা সচকিত হয়ে উঠলেন৷ দোতলার একটি কক্ষে তাঁদের সঙ্গে দেখা করলেন আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খান ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন৷ তাঁরা সাক্ষ্য দেবেন ১৫ মে৷ সমিতির পক্ষে কিছু দাবিদাওয়ার কথা জানিয়ে গেলেন৷
নিচতলায় সভাকক্ষে আলাপ হলো সাক্ষ্য দিতে আসা এক তরুণ ব্যবসায়ীর সঙ্গে৷ ঘটনার দিন জালকুড়ি এলাকায়ই ছিলেন; যেখান থেকে কাউন্সিলর নজরুল, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়৷ তিনি বললেন, ‘সেদিন আমি ঢাকার জালকুড়িতেই ছিলাম৷ আমি যা দেখেছি, তা-ই তদন্ত কমিটির কাছে বলব৷’
জিজ্ঞেস করি, নিজের ইচ্ছায় সাক্ষ্য দিতে এসেছেন, না কেউ অাপনাকে আসতে বলেছেন? তাঁর স্পষ্ট জবাব ছিল, ‘না, আমাকে কেউ আসতে বলেননি৷ বিবেকের তাড়নায় এসেছি৷’
হানিফ উড়াল সড়কের কল্যাণে এখন ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জে যেতে সময় লাগে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট৷ যাত্রাবাড়ী থেকে কিছুটা সামনে যেতেই সাইনবোর্ড এলাকায় ডান দিকে মোড় নিলেই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড৷ এই লিংক রোড ধরে কয়েক কিলোমিটার এগোতেই দেখলাম বিভিন্ন নামফলকের নিচে লেখা জালকুড়ি৷ জালকুড়ি জায়গাটি সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলায়৷ কাউন্সিলর নজরুল সেদিন তাঁর সহযোগীদের নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আদালত ভবন থেকে বেরিয়ে বাড়ির দিকেই যাচ্ছিলেন৷ কাছাকাছিই ছিল আইনজীবী চন্দন সরকারের গাড়ি৷ তিনি নিশানা না থাকলেও পরিস্থিতির শিকার হন৷ অপহরণের তিন দিন পর শীতলক্ষ্যা থেকে তাঁদের লাশ উদ্ধার করা হয়৷
আমাদের ধারণা ছিল, গণশুনানিতে অনেকেই এসে সাক্ষ্য দেবেন৷ তাঁরা যা দেখেছেন বা শুনেছেন, সেসব তদন্ত কমিটির কাছে নির্ভয়ে জানাবেন৷ কিন্তু গতকাল সার্কিট হাউসে সাক্ষ্য দিতে এলেন মাত্র সাতজন৷ তা-ও একজন নাম লিখিয়ে সাক্ষ্য না দিয়ে চলে গেলেন৷ অর্থাৎ, সাকল্যে সাক্ষ্য দিলেন মাত্র ছয়জন৷
নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তিনটি কারণে গণশুনানিতে সাড়া পাওয়া যায়নি৷ প্রথমত, অনেকে ভয় পেয়েছেন৷ সর্বত্র প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তীক্ষ্ণ নজরদারি রয়েছে, শুনানিতে এলে কী বিপদ হয়! দ্বিতীয়ত, কারও কারও মতে, গণশুনানিতে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে না৷ তৃতীয়ত, অবিশ্বাস৷ এর আগে নারায়ণগঞ্জে অনেকগুলো খুন ও অপহরণের ঘটনা ঘটলেও কোনোটিরই বিচার হয়নি৷ এ কারণে মানুষের মনে এই ধারণা জন্মেছে যে এসব সাক্ষ্যটাক্ষ্য দিয়ে লাভ নেই৷ দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পাবে না৷
সার্কিট হাউসেই একজন সাংস্কৃতিক কর্মীকে জিজ্ঞেস করি, কীভাবে বুঝলেন, শাস্তি পাবে না? জবাবে িতনি বললেন, ‘নারায়ণগঞ্জে এতগুলো হত্যা ও অপহরণের ঘটনা ঘটল, কোনোটির বিচার হয়নি৷ এমনকি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে তদন্তকাজও থমকে গেছে৷ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বদলি হয়ে গেছেন৷
সাত খুনের পর প্রশাসন তথা সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসলেও নারায়ণগঞ্জের মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না৷ তারা মনে করছে, প্রশাসন প্রথম থেকে উদ্যোগী হলে খুনিরা ধরা পড়ত৷ সাত খুনের ঘটনায় র৵াবের সঙ্গে প্রভাবশালী অারও কেউ জড়িত বলে তারা মনে করে৷ সেই শক্তি হয়তো একই ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছে৷
এদিকে সাত খুনের ঘটনা নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে নেমে পড়েছে দুই প্রধান দলই৷ আওয়ামী লীগ এত দিন চুপচাপ থাকলেও গত শনিবার থেকে নড়েচড়ে বসেছে৷ অভিযুক্ত নূর হোসেন ও তাঁর সহযোগীদের দল থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে৷ কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী রোববার নারায়ণগঞ্জে এসে নিহত নজরুল ও চন্দন সরকারের স্বজনদের সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন৷ কৃষিমন্ত্রীর সফরে স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানকে সঙ্গে না নেওয়াকেও নারায়ণগঞ্জের মানুষ তাঁর (সাংসদ) প্রতি সরকারের বিশেষ বার্তা বলেই মনে করছে৷
গতকাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেনের কাছে জানতে চাই, শামীম ওসমানের দাবি, একমাত্র তাঁর প্রতিই আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ আছে৷ এর অর্থ কী এই নয় যে আপনাদের প্রতি কেন্দ্রের আস্থা নেই? জবাবে তিনি বললেন, ‘সবার না হলেও কারও কারও আস্থা তো আছেই৷ আস্থা না থাকলে আমরা টিকে আছি কী করে?’
এই পরিস্থিতিতে বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া আজ নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছেন৷ প্রথমে জানানো হয়েছিল, তিনি বুধবার যাবেন৷
সার্কিট হাউস থেকে বেরোতেই দেখি জাতীয়তাবাদী আইনজীবীদের একটি মিছিল আদালতপাড়া প্রদক্ষিণ করছে৷ এর আগে বিএনপির পক্ষ থেকে জনসভার অনুমতি চাওয়া হলেও প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে তা নাকচ করে দেওয়া হয়৷
একটি সূত্র জানায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেই বিএনপির নেতা তৈমুর আলম খন্দকার এই কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন৷ উদ্দেশ্য ছিল, সিটি মেয়ার সেলিনা হায়াৎ আইভী জনসভার অনুমতি দিলে তাঁকে সহজেই বিএনপি-জামায়াতের দালাল হিসেবে িচহ্নিত করা যেত৷ কিন্তু মেয়র আইভী সেই সুযোগটি তাঁদের দেননি৷

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend