তিন প্রতিবেদন প্রস্তুত : কোণঠাসা জামায়াতের শেষ ভরসা কূটনীতিকরা
গুম, খুন, অপহরণ ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রতিবেদন নিয়ে কূটনীতিকদের কাছে অভিযোগ করতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছেও তারা অভিযোগ তুলে ধরবে। এ লক্ষ্যে দলের গবেষণা সেল থেকে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে রাজনৈতিক বিরোধের জেরে দলের নেতাকর্মীদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে হতাহত, হামলা ও মিথ্যা মামলায় হয়রানি করার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে। সামনে আরো বেশি নির্যাতন, নিপীড়ন ও হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে।
জামায়াত সূত্র জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে আইনশৃখলাবাহিনীর হাতে নিহত, আহত, গুম, খুন, রাজনৈতিক মামলায় হয়রানির শিকার জনপ্রতিনিধিদের তথ্য সম্বলিত তিনটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে দলটির একটি বিশেষ গবেষণা সেল। সমন্বিত প্রতিবেদন খুব শিগগিরই দেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছানো হবে।
এর আগে বিএনপি বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে। এরপর রামুর বৌদ্ধপল্লীতে সন্ত্রাসী হামলার নিজস্ব প্রতিবেদন এবং সর্বশেষ সারা দেশে গুম-খুন-অপহরণের তথ্য সম্বলিত সিডি কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দেয় বিএনপি।
এখন কূটনীতিকদের কাছে নিজেদের উদ্বেগ ও অভিযোগের কথা তুলে ধরতে যাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এ বিষয়টি জামায়াতের এক কর্মপরিষদ সদস্য অস্বীকার করলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলামেইলকে বলেন, ঢাকা মহানগরের দু’জন গুরুত্বপূর্ণ নেতা জামায়াত-শিবিরে ব্যাপক জনপ্রিয়। তাদেরকে ক্রসফায়ারে দিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করেছে সরকার। এছাড়া সুযোগ পেলেই জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন মামলার আসামি করে গ্রেপ্তার করা হয়। সরকার প্রতিনিয়ত জামায়েতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে।
জামায়াতের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তিনটি টিমের তৈরি করা তিনটি প্রতিবেদন ধরেই কাজ করছে জামায়াত-শিবিরের উচ্চ পর্যায়ের নেতারা। এরই মধ্যে একটি টিম দেশের বাইরে অবস্থানরত দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে কাজ শুরু করেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এই টিমের কাজ চলছে। সেখান থেকে ব্রিটেন, তুরস্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), ফ্রান্স, ইতালি, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে যোগাযোগ করছে। এই টিমের কাজ বাংলাদেশ থেকে তদারকি করছেন দলটির কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তার নেতৃত্বে দেশেও একটি টিম ঢাকার কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই টিমে একজন আইনজীবীও রয়েছেন। জামায়াতের একাধিক সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।
জামায়াতের একজন দায়িত্বশীল নেতা জানান, আন্দোলন-সংগ্রাম বিএনপির ওপরই নির্ভর করছে। তাদের পক্ষ থেকে আন্দোলনের কর্মসূচির আগে পর্যন্ত বিদেশি রাষ্ট্র ও কূটনৈতিকদের সঙ্গে আপাতত এই কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকবে জামায়াত।
তবে তালিকা প্রণয়ন ও কূটনীতিকদের কাছে নালিশ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে বর্তমানে কী ধরনের বর্বরতা চলছে তা দেশে ও দেশের বাইরের সবাই জানে। আমাদের আলাদা করে নালিশ করার কিছুই নেই।’
মুজিবুর রহমান বলেন, ‘ইতোপূর্বে সরকার চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধাসহ বিভিন্ন উপজেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সরকার সংবিধান মানে না, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। জনমতের প্রতি সরকারের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই। জনপ্রতিধিদের পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদেরকে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হত্যা করে সরকার দেশকে রাজনৈতিক নেতৃত্বশূন্য করতে চায়। তাই সরকার প্রতিনিয়ত জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীদের খুন, গুম ও গ্রেপ্তার করছে।’
প্রস্তুতকৃত তিনটি প্রতিবেদনে যা থাকছে
১ম প্রতিবেদন
এ প্রতিবেদনে সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর গ্রেপ্তারকৃত জনপ্রতিনিধিদের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। তালিকায় বলা হয়েছে, গত নির্বাচনে বিজয়ী ৩৬ জন জামায়াত-সমর্থিত চেয়ারম্যানের মধ্যে ১৬ জনই কারাগারে। রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অনেককে শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া ১২১ জন ভাইস-চেয়ারম্যানের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ১৩ জন দলসমর্থিত বিজয়ী।
২য় প্রতিবেদন
এই প্রতিবেদনটি জামায়াত-শিবিরের নিহত নেতাকর্মীদের বিষয়ে। ২০১০ সাল থেকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময় রাজনৈতিক সহিংসতায় ও পুলিশ-র্যাবের গুলিতে যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের নাম ও ঠিকানা এই তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তালিকার শিরোনামে ২০১০ থেকে নিহতদের নাম লেখা হলেও মূলত ২০১৩ সাল থেকে নিহতদের নাম-ঠিকানা রয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, গতবছরের ৩ মার্চ থেকে চলতি বছরের ৭ মে পর্যন্ত সর্বমোট ২৩৩ জন নিহত হয়েছে। এসব হত্যার জন্য পুলিশ ও র্যাবকে দায়ী করা হয়েছে।
৩য় প্রতিবেদন
২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন কারণে সহিংসতায় আহত, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, রিমান্ড, গুম, সাজা, গুলিবিদ্ধ এবং হামলাকারীর পরিচয়সহ এই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী, বর্তমানে জামায়াত-শিবিরের ৬০ হাজার ৪৭১ নেতাকর্মী কারাগারে রয়েছেন। এর মধ্যে তিন শতাধিক নেতাকর্মী বিভিন্ন মেয়াদে সাজা পেয়েছেন।
এছাড়াও সারাদেশে ২৫ হাজারের বেশি ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়টিও যুক্ত করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে। পাশাপাশি কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার বিষয়ে সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত রয়েছে বলে দলটির বিশেষ দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।