র‌্যাব বিলুপ্ত না করলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধের সুপারিশ করবে এইচআরডব্লিউ

image_81660_0র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র‌্যাব) পুর্নগঠন বা নিষিদ্ধের প্রয়োজনীয় পদ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে বাংলাদেশের প্রতি সব ধরণের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধের সুপারিশ করা হবে বলে জানিয়েছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস্‌ ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

বাংলাদেশ সরকারকে হুঁশিয়ার করে এইচআরডব্লিউ বলেছে, র‌্যাবের বিচার করে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে বাহিনীটিকে হয় পুনর্গঠন অথবা নিষিদ্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় আমেরিকা, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়াসহ বাংলাদেশের সবগুলো দাতা দেশ অবিলম্বে তাদের সব ধরনের সহযোগিতা স্থগিত করবে এবং যতদিন পর্যন্ত না সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয় ততদিন পর্যন্ত এসব সুবিধা স্থগিতই থাকবে।

‘বন্দুকযুদ্ধ: বাংলাদেশে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শিরোনামে ৫৩ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন সংক্ষিপ্ত আকারে সংস্থাটি তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে।

প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ দাবি করেছে, বছরের পর বছর ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, অপহরণ ও গুমসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকা থেকে এলিট ফোর্স র‍্যাবকে দমন করতে এবং এসব ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

র‍্যাবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে সেগুলোর গভীরে ঢুকে আরো বিস্তৃত পরিসরে তদন্তে একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র সংস্থা গঠনের জন্য প্রতিবেদনটিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তাগাদা দিয়েছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে র‍্যাবকে একটি ‘ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।

২০০৬ সালে প্রকাশিত এইচআরডব্লিউ’র ‘বিচারক, অপরাধ নির্ণায়ক এবং জল্লাদ: বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর এলিট ফোর্সের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন’ শীর্ষক আরেকটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সাম্প্রতিক প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। এছাড়াও ঘটনার শিকার, প্রত্যক্ষদর্শী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা, আইনজীবী ও বিচারকসহ ৮০ জনেরও বেশি ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতেও প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।

বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যত ঘটনা র‍্যাব ঘটিয়েছে সেগুলো সম্পর্কে এইচআরডব্লিউ’র কাছে নথিপত্র আছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবদেনটিতে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন থেকেই চালানো বিভিন্ন অভিযানে এখন পর্যন্ত র‍্যাব প্রায় ২০০ ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। অথচ যখন এই আওয়ামী লীগই সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আসীন ছিল, তখন তারা সব ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সমাপ্তি ঘটানোর আশ্বাস দেয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর এই সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাই আবার র‍্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি ক্রমাগত অস্বীকার করে গেছে এবং তাদের কেউ কেউ এমনকি র‍্যাবের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে।

‘দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর র‍্যাবের এই হত্যাচর্চা বন্ধের জন্য প্রয়োজনের চেয়েও বেশি সময় পেয়েছিল সরকার’ বলে মন্তব্য করেন এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া মহাদেশের আঞ্চলিক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস্‌। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে একটি ‘ডেথ স্কোয়াড’ অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং এই খুনে চক্রটিকে প্রতিহত করতে সরকার কিছুই করছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এখন প্রতিক্রিয়া দেখানো দরকার।”

এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা এবং দোষীদের শাস্তি দেয়ার বিষয়ে সরকার এরই মধ্যে হাজারো প্রতিশ্রুতি দিলেও একজন র‍্যাব কর্মকর্তাও এখনো পর্যন্ত ‘বন্দুকযুদ্ধ’র মতো হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য শাস্তি পাননি। বাহিনীটির অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডকে আইনের চাদরে ঢেকে ফেলারই একটি আনুষ্ঠানিক নাম হলো ‘বন্দুকযুদ্ধ’।

ব্র্যাড অ্যাডামস্‌ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীকে এখন অবশ্যই বৃহৎ পরিধিতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তদন্তের দায়িত্ব নিতে হবে এবং শুধু নারায়ণগঞ্জই নয়, বরং র‍্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা সবগুলো অভিযোগের বিষয়েই স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন সংস্থাও গঠন করতে হবে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, আওয়ামী লীগের নেতারা অব্যাহতভাবে এই বিষয়ে তর্ক করেই গেছেন যে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের শিকড় উপড়ে ফেলার কোনো প্রয়োজনই তাদের নেই। এর কারণ হলো- বাহিনীটির ওপর যথেচ্ছ রাজনৈতিক অধিকার খাটাতে পারেন তারা। সরকারের দুই বছরেরও বেশি কার্যকাল ধরে এই বিষয়ে অনেক প্রমাণও যোগাড় করা হয়েছে বলেও জানানো হয় প্রতিবেদনটিতে।

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তিকে অপহরণের পর আপাতদৃষ্টিতে ‘চুক্তিভিত্তিতে’ হত্যার ঘটনায় র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র‍্যাবসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জড়িত থাকার বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঘোষণা করেছিলেন- এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যে দলেরই বা যে পদেরই হোক না কেন, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

নিজস্ব গতিতে চলমান উচ্চ আদালত এই ঘটনার পরে অভিযুক্ত তিন র‍্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। তবে এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করার আগেই ‘যেকোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সঙ্গে বিশেষভাবে গঠিত কোনো স্বাধীন নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত থাকলে তাদের বিচার বেসামরিক আদালতে করা হবে’ বলে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।

বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে র‍্যাবের জড়িত থাকার বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তথ্য সংগ্রহ করে আসছিল এইচআরডব্লিউ।

র‍্যাবকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশে এখন খোলাখুলিই আলোচনা করা হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনে জানায় এইচআরডব্লিউ। এমনকি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া যিনি নিজেই তার সরকারের আমলে র‍্যাব গঠন করেছিলেন, তিনি এখন এই বাহিনীটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

অ্যাডামস্‌ বলেন, “নিরাপত্তা বাহিনীগুলো মানবাধিকার ভঙ্গ করলে তাদের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অবলম্বন করা হবে বলে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সরকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে, সেই প্রতিশ্রুতি পূরণের এটাই সুবর্ণ সুযোগ তাদের জন্য।”

গণতন্ত্রে ‘ডেথ স্কোয়াড’ বা ঘাতক বাহিনীর কোনো জায়গা নেই উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, “র‍্যাবকে নিষিদ্ধ করা উচিত। এর জায়গায় এমন একটি বাহিনীকে নিয়োগ করা উচিত যারা সম্পূর্ণ বেসামরিক বাহিনী হবে এবং আইনের শাসনের অধীনে থেকেই কাজ করবে।”

এই প্রসঙ্গে র‍্যাবের পরিবর্তে হয় পুলিশের অধীনেই অথবা সম্পূর্ণ পৃথক একটি নিরাপত্তা বাহিনী গঠনের ওপর জোর দেয়া হয়। বলা হয়- পৃথক ওই বাহিনীটিতে বেসামরিক ধারা বা পুলিশ ফোর্সের চাইতে ভিন্ন ধারার কোনো বাহিনী যেমন- সেনা, নৌ বা বিমান অর্থাৎ সামরিক বাহিনী বা র‍্যাবের মত কোনো সংগঠনের সদস্য থাকতে পারবে না।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend