ঝিনাইগাতীতে বন্যহাতির তান্ডব অব্যাহত
মোহাম্মদ দুদু মল্লিক, ঝিনাইগাতী (শেরপুর) থেকে : বন্যহাতি ও দারিদ্রতার সাথে লড়াই করে বেঁচে আছেন শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার পাহাড়ী গ্রামবাসীরা। বর্তমানে বন্যহাতির তান্ডব অব্যাহত রয়েছে। বন্যহাতির দল তান্ডলীলা চালিয়ে পাহাড়ী গ্রামবাসীদের ঘর-বাড়ী, ক্ষেতের পাকা ধান, বাগানের কাঁঠালসহ বিভিন্ন শাক-সবজি, বাগান সাবার করে চলেছে। প্রায় প্রতি রাতেই পাহাড়ী গ্রামগুলোতে হানা দিচ্ছে বন্যহাতি। ফলে পাহাড়ী গ্রামবাসীরা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। শতশত গ্রামবাসীরা বেঁচে থাকার তাগিদে সনাতন পদ্ধতিতে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে পটকা ফুটিয়ে হাতি তাড়ানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে আসলেও তা ফলশ্রুতি হয়ে উঠছে না। উন্নতি পদ্ধতিতে হাতি তাড়ানোর পদ্ধতি না থাকায় সনাতন পদ্ধতিতেই হাতি তাড়াতে গিয়ে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গারো পাহাড়ের পাদদেশে মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেষেঁ অবস্থিত অবহেলিত জনপদ শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলা গারো পাহাড়। বন-বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানান গেছে, ১৯৯৬ সাল থেকে ঝিনাইগাতী উপজেলা পাহাড়ী গ্রামগুলোতে শুরু হয় বন্যহাতির তান্ডব। উপর্যপুরি বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পাহাড়ী জনপদের লোকজন। এসব পাহাড়ী গ্রামগুলো হচ্ছে, উপজেলার তাওকুচা, গুরুচরণ দুধনই, পানবর, বাকাকুড়া, ছোট গজনী, গজনী, গান্ধিগাও, হালচাটি, নওকুচি, বানাইপাড়া, রাংটিয়া, সন্ধ্যাকুড়া, হলদিগ্রাম ও গোমড়া। গারো, হাজং কোচ বানাই, বর্মণ, হুদি, বংশি, হিন্দু ও মুসলমানসহ বিভিন্ন জাতিগোত্র মিলে সীমান্তবর্তী এসব পাহাড়ী গ্রাম গুলোতে প্রায় ২০ হাজার লোকের বসবাস। দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী গ্রামবাসীরা প্রতিনিয়ত বন্যহাতি আর দারিদ্রতদার সাথে লড়াই করে টিকে আছে। কৃষির উপর নির্ভরশীল আদিবাসী অধ্যূষিত এসব পাহাড়ী গ্রামবাসীরা যুগ যুগ ধরে তাদের জমি চাষাবাদের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিল।কিন্তু বন্যহাতির দল তাদের জীবিকার পথে কাল হয়ে দাঁড়ায়। বন্যহাতির তান্ডবে গারো পাহাড়বাসী দীর্ঘদিন থেকে তাদের জমিতে ফসল ফলাতে পারছে না। আবার কোন কোন কৃষক বেঁচে থাকার তাগিদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চাষাবাদ করলেও কৃষকদের কষ্টার্জিত ক্ষেতের ফসল ঘরে তুলতে পারছে না। বন্যহাতির দল দিনে বনের গভীর অরণ্যে আশ্রয় নিচ্ছে এবং রাতে লোকালয়ে নেমে এসে তান্ডব লীলা চালাচ্ছে। ভারতের বিশাল এলাকা জুড়ে বনভূমি থাকলেও সীমান্তে কাঁটা তাঁরের বেড়া নির্মানের কারনে বন্যহাতির দল ভারতে প্রবেশ করতে পারে না। নদী-নালা হয়ে কোন সময়ে প্রবেশ করলেও বিএসএফ ও ভারতীয় গ্রামবাসীদের হাতে ধাওয়ায় বন্যহাতির দল ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে পাহাড়ী গ্রামগুলোতে। ফলে বন্যহাতির দল খাদ্যের সন্ধানে এলাকার ঘর-বাড়ী, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসলসহ জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে চলছে। প্রতি বছর ধান পাকা শুরু হওয়ার সাথে সাথে এখানে বন্যহাতির তান্ডব বৃদ্ধি পায়। গ্রামবাসীরা জানায়, হাতির দল কৃষকদের গোলা ও ক্ষেতের ধান শাক-সবজির বাগানসহ বিভিন্ন জাতের ফলমুল আম ,কাঠাল খেয়ে এবং পায়ে পিসে দুমড়ে-মুচরে একাকার করে চলছে। এসব এলাকার কৃষকরা জানমাল ও ক্ষেতের ফসল রক্ষার্থে রাত জেগে পাহাড়া দিচ্ছে। ঢাক-ঢোল পটকা ফুটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানেরা বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা চলছে ততই বন্যহাতির দল তেড়ে আসছে লোকালয়ে। কিছুতেই হাতি তাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। বন্যহাতির তান্ডবে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ পাহাড়ী গ্রামগুলোতে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ জন নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও শতশত ঘর-বাড়ী বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যহাতির দল একদিকে ঘর-বাড়ী গুড়িয়ে দিচ্ছে অন্যদিকে বেঁচে থাকার তাগিদে বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ী মেরামতের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসীরা। অনাবাদি হয়ে পড়েছে শতশত একর জমি। বন্যহাতির তান্ডবে বিপদগ্রস্ত পাহাড়ী গ্রামগুলো দু’টি ইউনিয়নে বিভক্ত। নলকুড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান খলিলুর রহমান ও কাংশা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর সরকার জানান, পাহাড়ী গ্রামগুলোতে বন্যহাতির তান্ডবে শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। তাদের মতে, পাহাড়ী গ্রামবাসীদের জীবিকার সন্ধানে দারিদ্রতার সাথে ও রাতে হাতির সাথে লড়াই করে বেঁচে আছে। রাতে হাতি তাড়ানোর পর দিনে বের হতে হচ্ছে জীবিকার সন্ধানে। তাদের মতে, পেটে ভাত না থাকলেও রাতে হাতি তাড়ানোর জন্যে মশাল জ্বালাতে ২/৩লিটার কেরোসিন তেল হাতের নাগালে রাখতে হচ্ছে। যা দরিদ্র পরিবারের অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। লাকাবাসীর অভিযোগ প্রথম দিকে হাতি তাড়ানোর জন্য মশাল ব্যবহার করতে সরকারীভাবে কেরোসিন তেল সরবরাহ করা হত। কিন্তু এখন আর কেউ তাদের খোঁজ-খবর নেয় না। হাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত পাহাড়ী গ্রামবাসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন। ওয়ার্ল্ড ভিশন হাতি তাড়ানোর জন্য গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে এসব এলাকার জনগনকে সচেতন করে তুলতে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করে যাচ্ছে। তবে গ্রামবাসীদের অভিযোগ সরকারীভাবে হাতি তাড়ানোর জন্য স্থানী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। গ্রামবাসীদের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে বন্যহাতির তান্ডবে বিপর্যস্ত পাহাড়ী গ্রামগুলো বিদ্যুায়িত করার জন্য সরকারের প্রতি সু-দৃষ্টি কামনা করেছেন।