র‌্যাবের তারেক সাঈদের বিরুদ্ধে আরও একটি অভিযোগ ; ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে দুই কোটি টাকা দাবি

b3974f0b5fa2d39834f071a2d8131ae6-40 (1)র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মাদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগের কর্মী ইসমাইল হোসেনকে অপহরণের অভিযোগ তুলেছে তাঁর পরিবার৷ এই পরিবারের দাবি, ইসমাইলকে ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ওই কর্মকর্তা সরাসরি তাঁদের কাছে দুই কোটি টাকা দাবি করেছিলেন৷ তিন মাস আগে ইসমাইলকে (৫০) তাঁর এক বন্ধুর সামনে থেকে অপহরণ করা হয়। এখনো তাঁর খোঁজ মেলেনি৷
ইসমাইলের পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন, তাঁরা একাধিকবার সরাসরি ও একাধিক লোকের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় টাকার অঙ্ক কমানোর জন্য তারেক সাঈদ এবং তাঁর পরামর্শে র‌্যাবের আরেক কর্মকর্তা মেজর আরিফের সঙ্গে দেনদরবার করেছেন৷ টাকা দাবি করার পরপরই ইসমাইলের পরিবার জমিজমা বিক্রিও করে এক কোটি টাকা জোগাড় করে মেজর আরিফের সঙ্গে দেখা করেন বলে দাবি করেন ইসমাইলের স্ত্রী জোসনা বেগম ও তাঁর দেবর আবদুল মান্নান৷ এ দুজনই নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় চলমান গণশুনানিতে উপস্থিত হয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার তদন্ত কমিটিকে এ বিষয়ে সবিস্তারে অবহিত করেন এবং ইসমাইলকে উদ্ধারের আবেদন জানান৷
জানতে চাইলে গতকাল রাতে র৵াবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এ টি এম হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না৷’
নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ইউনিয়ন যুবলীগের কর্মী ইসমাইল হোসেন একজন ঠিকাদার। তিনি চার সন্তানের জনক৷ গত ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অপহরণ করা হয়। দুই দিন পর ইসমাইলের ছোট ভাই আবদুল মান্নান থানায় মামলা করেন৷ এতে ছয়জনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, এদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ইসমাইলের বিরোধ চলছিল৷ এর মধ্যে ৭ ফেব্রুয়ারি তাঁকে অপহরণ করা হয়৷
আবদুল মান্নান গত বুধবার তাঁর ভাই ইসমাইলের বাসায় বসে প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭ ফেব্রুয়াির আমার ভাই তাঁর বন্ধু হিরনের গাড়িতে করে বাসায় ফিরছিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সিদ্ধিরগঞ্জের পাইনাদী এলাকায় এলে একটি মাইক্রোবাস তাঁদের গাড়িটির গতিরোধ করে থামায়। মাইক্রোবাসের সবার হাতে অস্ত্র ছিল। তারা র্যাব পরিচয় দিয়ে আমার ভাইকে তুলে নিয়ে যায়। আমরা তখনই থানায় যাই। কিন্তু পুলিশ বলে, আমাদের কিছুই করার নেই। আপনারা র‌্যাবের অফিসে যান। এরপর আমি ও আমার ভাবি সিদ্ধিরগঞ্জে র‌্যাব-১১-এর কার্যালয়ে যাই। কিন্তু আমাদের সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’ মান্নান জানান, এরপর তিনি থানায় মামলা করেন।
জোসনা বেগম এ সময় বলেন, ‘অপহরণের ১২ দিন পর দুজন লোক র‌্যাবের সোর্স (তথ্যদাতা) পরিচয় দিয়ে আমাদের কাছে ইসমাইলের লেখা একটি চিরকুট নিয়ে আসেন। ওই দুজন আমাদের বলেন, আপনারা র‌্যাবের সিও (তখনকার) তারেক সাঈদের সঙ্গে দেখা করেন। দুই দিন পর আমি ও মান্নান (দেবর) র‌্যাব-১১-এর কার্যালয়ে গিয়ে তারেক সাঈদের সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাদের বলেন, ইসমাইল হান্ড্রেড পারসেন্ট ডেঞ্জার লোক। খারাপ লোক। তাঁর খোঁজে কেন আসছেন? আমরা তাঁর হাতে-পায়ে ধরে কান্নাকাটি করি। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ইসমাইলকে জীবিত পেতে হলে দুই কোটি টাকা লাগবে। আমাদের এক দিন সময় দিয়ে তিনি বলেন, ঘটনা পুলিশ বা অন্য কাউকে জানালে স্বামীকে জীবিত ফেরত পাওয়া যাবে না।’
জোসনা বেগম আরও বলেন, ‘র‌্যাবের সিওর কাছ থেকে ফিরে আমরা দ্রুত জমিজমা, গয়নাগাটি সব বিক্রি করে দেই। আত্মীয়স্বজনদের কাছে যাই। একজন আত্মীয় তাঁর দোকান বিক্রি করে টাকা দেন। আমরা এক কোটি টাকার মতো জোগাড় করি। এই অবস্থায় মেজর আরিফ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা ওই টাকা নিয়ে আরিফের কাছে যাই। কিন্তু তিনি বলেন, দুই কোটি টাকাই লাগবে, নইলে ইসমাইলকে পাওয়া যাবে না।’
আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর পাঁচ-সাত দিন পর আমরা কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হককে সঙ্গে নিয়ে আবারও র‌্যাবের সিওর সঙ্গে কথা বলতে যাই। সিও ফজলুল হককে অনেক ধমকান৷ বলেন, খারাপ লোকের জন্য কেন আসছেন?’
মান্নান জানান, এরপর তাঁরা ইসমাইলের বন্ধুদের পরামর্শে রফিক নামে এক ব্যবসায়ীকে দিয়ে র‌্যাবের সিওকে ফোন করান। তাতে সিও টাকা কিছুটা কমাতে রাজি হন। এর কয়েক দিন পর রফিকের ঢাকার বসুন্ধরায় বাসায় একটি বৈঠক হয়। তাতে তারেক সাঈদ উপস্থিত ছিলেন৷ সেখানে মান্নান আবার র‌্যাবের সিওকে অনুরোধ করেন৷ সিও বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন।
আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এরপর আমরা আবার তারেক সাঈদের কাছে যাই। তিনি আমাদের মেজর আরিফের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। আমরা আবারও মেজর আরিফকে টাকা কিছুটা কমাতে অনুরোধ করি। কিন্তু তিনি রাজি হননি৷’ মান্নান বলেন, ‘এর মধ্যে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন নিয়ে র‌্যাব ব্যস্ত হয়ে পড়লে আমরা আর তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। এরপর ২২ এপ্রিল আমরা মেজর আরিফের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, আপনারা অনেকের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। কাজটি ভালো হয়নি। তিনি আর কথা বলতে রাজি হননি৷’
আবদুল মান্নান বলেন, আদমজী ইপিজেডের ভেতরে তিনতলা একটি পুরাতন ভবনে (ব্যাচেলর বিল্ডিং হিসেবে পরিচিত) অবস্থিত র‌্যাব-১১-এর ক্যাম্পের নিচতলার একটি কক্ষে ইসমাইলকে আটকে রাখা হয়েছিল বলে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন। তাঁর ধারণা, তাঁর ভাই এখনো বেঁচে আছেন।
ইসমাইলকে কেন র‌্যাব অপহরণ করবে—জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ইসমাইল কাঁচপুর এলাকায় ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন। এ ছাড়া একটি পোশাক কারখানার ঝুট ব্যবসা ও বালু ভরাটের কাজ করতেন। এই ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয়। ওদের নিয়ন্ত্রণ করতেন নূর হোসেনের আপন শ্যালক ছাত্রলীগের নেতা নূর আলম। তারাই র্যাবকে দিয়ে এই অপহরণের কাজটি করিয়েছে। মামলায় তিনি ওই ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন বলে জানান৷
যে বন্ধুর সঙ্গে আসার পথে ইসমাইল অপহৃত হয়েছেন, সেই মাজহারুল ইসলাম ওরফে হিরন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মাইক্রোবাসে করে কাঁচপুর থেকে সিদ্ধিরগঞ্জে যাচ্ছিলাম। পাইনাদীর আশিক নার্সারির সামনে এলে একটি মাইক্রোবাস এসে আমাদের থামায়। সেখান থেকে সাদাপোশাকে অস্ত্রধারী লোকজন এসে আমাদের গাড়ির চাবি নিয়ে নেয়। এরপর তারা আমাকে মারধর করে তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ এ সময় তাদের মধ্য থেকে কয়েকজন বলে ওঠে, এইটা না, সামনেরটা। এরপর তারা ইসমাইলকে তুলে নেয়। ইসমাইল ধস্তাধস্তি শুরু করেন৷ এতে আশপাশের লোকজন চলে আসলে অপহরণকারীরা অস্ত্র উঁচিয়ে বলে, আমরা র‌্যাব। আসামি ধরতে আসছি। এরপর লোকজন চলে যায়৷ এবং র‌্যাব পরিচয়ধারীরা ইসমাইলকে নিয়ে চলে যায়।’
ইসমাইলকে ছাড়িয়ে আনতে র‌্যাব-১১-এর কার্যালয়ে সিও তারেক সাঈদের কাছে গিয়েছিলেন কাঁচপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফজলুল হক। জানতে চাইলে গত বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইসমাইল অামার এলাকার ছেলে। তাই তাঁর পরিবারের অনুরোধে আমি তারেক সাঈদের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, ইসমাইল খারাপ লোক। তাঁর জন্য আপনি কেন এসেছেন? এরপর আমি আর কিছু বলিনি।’
অভিযোগের বিষয়ে র‌্যাবের  ওই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ সিদ্ধিরগঞ্জের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজনকে অপহরণ ও খুনের ঘটনায়ও র‌্যাব-১১-এর এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ওরফে শহীদ চেয়ারম্যান অভিযোগ করেছেন, ছয় কোটি টাকা নিয়ে র‌্যাবের সাবেক অধিনায়ক (সিও) তারেক সাঈদ, মেজর আরিফ হোসেন ও নৌবাহিনীর লে. কমান্ডার এম এম রানা এই কাজ করেছেন। ওই ঘটনার পর এই তিন কর্মকর্তাকে নিজ বাহিনীতে ফেরত নেওয়া হয় এবং চাকরি থেকে অবসরে পাঠানো হয়৷ হাইকোর্ট তাঁদের গ্রেপ্তার করতেও নির্দেশ দিয়েছেন৷
আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে জানান, র‌্যাব-১১-এর বর্তমান অধিনায়ক আনোয়ার লতিফ খানকেও তাঁরা বিষয়টি জানিয়েছেন। নতুন পুলিশ সুপারকেও জানিয়েছেন। সবাই বলছেন, তাঁরা এখন সাত খুনের মামলা নিয়ে ব্যস্ত।
জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, ‘ওই পরিবার থানায় আগেই অভিযোগ করেছে। সেটাকে ভিত্তি ধরেই অভিযোগের তদন্ত চলছে’।
জোসনা বেগম বলেন, ‘আমরা তো নিশ্চিত, র্যাবই আমার স্বামীকে নিয়ে গেছে৷ আমার স্বামীকে খুঁজে বের করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। আমি তাঁকে ফেরত চাই।’

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend