কংগ্রেসের পরাজয়ের কারণ
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটেছে কংগ্রেসের। এমনকি তারা এককভাবে বিরোধীদলে থাকার মতো আসনও পায়নি এবারের নির্বাচনে। গান্ধী পরিবারের দুই পুত্রবধূ ও দুই সন্তান দুই শিবির থেকে জিতলেও কংগ্রেসের ভরাডুবির কারণ খুঁজছেন এখন নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক আর পর্যবেক্ষকদের হিসাবের খাতা খুলে গেছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কংগ্রেসের পাঞ্জা অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়ায় কার্যত ভোটের ময়দানে লড়াই হয়নি। যেন নরেন্দ্র মোদি এলেন, দেখলেন আর দিল্লি জয় করলেন। হিন্দুত্ববাদের অহঙ্কার থেকে সরে না দাঁড়ানো নরেন্দ্র মোদি এক বছর আগে থেকেই তিনি কোমর বেঁধে নেমেছিলেন ভোটের লড়াইয়ে।
গুজরাটের উন্নয়ন মডেল সামনে নিয়ে ভারতবাসীকে বলেছিলেন, ‘আমাকে শক্তিশালী সরকার দিন, আমি আপনাদের শক্তিশালী ভারত দেব।’ ‘মা-বেটার শাসন’ বলে কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী ও ভোটযুদ্ধের সেনাপতি রাহুল গান্ধীকে মাঠে-ময়দানে তুলাধোনা করেছেন। জ্ঞানী, পণ্ডিত, বিচক্ষণ, সৎ, মেধাবী প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংকে গান্ধী পরিবারের হাতের পুতুল বানিয়ে ছেড়েছেন মানুষের কাছে। বিজেপির প্রবীণ নেতা এল কে আদভানি, সুষমা স্বরাজ, মুরলি মনোহর জোশিদের কোণঠাসা করে দলের পূর্ণ কর্তৃত্ব নিয়ে নিজেকে প্রধানমন্ত্রীই ঘোষণা করেননি, সর্বত্র জুতসই প্রার্থী দিয়ে একটি পরিকল্পিত, সংগঠিত ভোটযুদ্ধে নেমেছিলেন আটঘাট বেঁধেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার ক্যাম্পেইন ছক যারা করেছিলেন তাদেরই নিজের প্রচারের জন্য এনেছিলেন তিনি।
রাজনীতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কংগ্রেসের প্রচার-প্রচারণা থেকে ভোট লড়াইয়ের নমুনা ছিল সম্পূর্ণই দায়সারা গোছের। যেন ভোটের আগেই হেরে বসেছিলেন রাহুল গান্ধী ও কংগ্রেস। এদিকে রুপির বিপরীতে ডলারের দাপট বেড়েছে। ক্রয়ক্ষমতা সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। নানান সামাজিক কর্মসূচির মাধ্যমে রাজকোষ খালি হয়েছে। কংগ্রেসের একটা অংশ লুটেপুটে খেলেও মানুষের দুয়ারে তা পৌঁছেনি। দলের কর্মীদের সঙ্গেও কংগ্রেস নেতৃত্বের দূরত্ব বাড়তে বাড়তে সাংগঠনিক দুর্বলতা চরম আকার নিয়েছে। আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন ভারতবাসীকে প্রতিবাদীই করেনি, কংগ্রেস সরকারকে বড় ধরনের আঘাত দিয়েছে। আম আদমি পার্টির জন্ম ও কেজরিওয়ালের আবির্ভাব কংগ্রেসের সমালোচনার ভিতর দিয়েই গড়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলে দাঙ্গা হবে- এই বলেই পথ হেঁটেছেন রাহুল গান্ধী। ২০০৪ সালের পর থেকে জোট ছেড়ে চলে যাওয়া ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তিকে না কাছে টেনেছেন, না দলকে সুসংগঠিত করেছেন। মোদি যেখানে তার শক্তি সুসংগঠিত করে তার ওপর দাঁড়িয়ে লড়ছিলেন, রাহুল সেখানে ছিলেন অতিশয় দুর্বল সেনাপতি। না ছিল অস্ত্র, না ছিল সৈন্য।
অপরদিকে বাগ্মিতায় ক্যারিশমায় নরেন্দ্র মোদি দিনে দিনে গান্ধী পরিবার ও কংগ্রেস জমানার অবসান ঘটিয়ে পরিবর্তনের হাওয়া তুলতে সাধারণ মানুষের হৃদয় স্পর্শ করা বক্তৃতায় জনতার ঢল নামিয়েছেন। তিনিই হয়ে উঠেছিলেন কংগ্রেসবিরোধী শক্তির মহীরুহ। বিপরীতে রাহুল গান্ধী ছিলেন নিষ্প্রভ, বর্ণহীন, ধূসর এক দুর্বল সেনাপতি। কংগ্রেসের প্রচারের দায়িত্বে থাকা রমেশকে প্রিয়াঙ্কা যখন জবাবদিহিতার মুখোমুখি করেছিলেন তখন ভোটের লড়াই মোদির অনুকূলে চলে যায়। আঞ্চলিক দুর্গ গড়ে যারা নরেন্দ্র মোদি ও তার রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, তারা ছিলেন বিভক্ত। অর্থাৎ প্রগতিশীল শক্তির বিভক্তির মুখেই গুজরাটের নরেন্দ্র মোদি গেরুয়া পোশাক পরে অ্যারিয়ান হর্সের মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন ভারতবর্ষ। পশ্চিমবঙ্গেই তিনি গেছেন সাতবার। ভোটের আনুপাতিকহারে কংগ্রেসের ওপরই তার অবস্থান। মোদি ঝড়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের রাজনৈতিক দুর্গ।
ভোটের ময়দানে নরেন্দ্র মোদি দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কথা বলেছেন। পরিবারতন্ত্র হটিয়ে মেহনতি মানুষের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। গুজরাট দাঙ্গার বিতর্ক ছাড়া নিজেকে একজন যোগ্য ও দক্ষ কৌশলী, সৎ প্রশাসকের মডেল হিসেবে ভোটারদের সামনে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। তিনি বিজেপিকে পেছনে ফেলে নিজেকে সামনে এনে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের অনুভূতিতে হাত দিয়েছেন।
এ ছাড়াও কংগ্রেসের নিয়তিতেই বাঁধা ১০ বছর পর পর অভিশপ্ত হতে হয় ভোটযুদ্ধে। ১০ বছর পর এবারও তা-ই হয়েছে। তবে এবার মাসুলটা হয়েছে চড়া।