শেরপুর সদর হাসপাতালে ডাক্তার ও ওষুধ সঙ্কটে চিকিৎসাসেবা বিঘ্নিত
শেরপুর হাসপাতালে ডাক্তার সঙ্কট, ওষুধ সংকট , অবকাঠামোগত সমস্যা ও কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।
১৯৩৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ময়মনসিংহ, টিএম দৌও শহরের বটতলায় ১০ শয্যার শেরপুর হরচন্দ্র হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৫২ সালে হাসপাতালের স্থান পরিবর্তন করে শহরের নারায়ণপুরে ৩১ শয্যা হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৮০ সালে পর্যায়ক্রমে ১২৮ জনের জনবল নিয়ে ৫০ শয্যার হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। ৪ দলীয় জোট সরকারের আমলে শেরপুর সদর হাসপাতালকে ১০০ শয্যায় রূপান্তরের জন্য ভৌত অবকাঠামোগত কাজ শুরু হয়। ২০০৭ সালে ৫০ শয্যা রাজস্ব ও বাকি ৫০ শয্যা উন্নয়ন খাতে ১০০ শয্যা হাসপাতালের ঘোষণা দেয়া হয়। হাসপাতালের পরিধি বাড়ানো হলেও বাড়ানো জনবল হয়নি।
চলতি অর্থ বছরের এপ্রিল মাসে একনেক বেঠকে সারাদেশে ১১টি জেলা হাসপাতালের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সিদ্ধান্ত হয়। এর অংশ হিসেবে শেরপুর সদর হাসপাতালকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ২৫০ শয্যায় রূপান্তরের প্রস্তাব পাস করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যে মাটি পরীক্ষার কাজও শেষ হয়েছে। এখন ড্রইং, ডিজাইন ও বিল্ডিং এলিভেসন তৈরির কাজ চলছে। শেরপুর সদর হাসপাতালের প্রধান সহকারী সজল মিয়া জানান, ১২৮ জনের মধ্যে ডাক্তারের পদ সংখ্যা ৩৬টি। এর মধ্যে কর্মরত আছেন ১৮ জন। বাকি পদগুলো শূন্য রয়েছে।
কাগজ-কলমে ১৮ জনের নাম থাকলেও এর মধ্যে সিনিয়র কনসালট্যান্ট ড্যাব নেতা ডা. আক্তার আহমেদ চৌধুরী ২০০৮ সালে যোগদানের পর থেকে আজ অবধি কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। দীর্ঘদিন কর্মস্থলে না থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার প্রস্তুতি চলছে। এদিকে ১/১১ সময় জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অর্থো) ডা. আব্দুর রশিদ ছুটি নিয়ে হাসপাতালের বাইরে রোগী দেখার অভিযোগে বরখাস্ত হন। অপরদিকে, জুনিয়র কনসালট্যান্ট (চর্ম ও যৌন) ডা. জেসমিন আক্তার লীনা ২০১৩ সালের নভেন্বর মাসে যোগদানের পর থেকে এখন পর্যন্ত কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। হাসপাতালে প্রকৃত কর্মরত ডাক্তারের সংখ্যা ১৫ জন। এ ছাড়াও ৪২ জন নার্সের মধ্যে ১টি পদ শূন্য, ৫ জন সহসেবকের মধ্যে ৪টি পদ শূন্য, ১০ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদের বিপরীতে ১টি পদ শূন্য, তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ১৮টি পদের বিপরীতে ২টি পদ শন্য ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ২২টি পদের ১টি পদ শূন্য রয়েছে।
হাসপাতাল পরিদর্শনে দেখা গেছে, পুরুষ ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, গাইনি ও শিশু ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত আলোর অভাব। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা মেঝেতে গাদাগাদি করে থেকে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। নার্স সীমা ও আঞ্জুমানারা জানান, প্রতিটি ওয়ার্ডেই দুটি করে ভাগ রয়েছে। একটিৃ সার্জারি অপরটি মেডিসিন। পুরুষ সার্জারি ওয়ার্ডে ১৮টি সিট রয়েছে। এর বিপরীতে রোগীর সংখ্যা ৬৮ জন। শিশু ওয়ার্ডে ১২টি সিট থাকলেও রোগীর সংখ্যা ৮১ ।
তারা আরো জানান, ১০০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ থেকে ২৮০ জন রোগী ভর্তি থাকে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন নার্স অভিযোগ করে জানান, হাসপাতালে কখনোই ভিজিটিং আওয়ার মানা হয় না। এমনিতেই রোগীর চাপ। হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডের শৌচাগার পরিদর্শনে দেখা গেছে, এখানে সেখানে পানের পিক, উচ্ছি্যষ্ট ভাত, কফ, কাশ ইত্যাদি। কোনো কোনো শৌচাগারের সিটকিনি পর্যন্ত নেই। আউটডোরে প্রতিদিন ৫/৬ শ’ রোগী সেবা নিয়ে থাকে।
শেরপুর সদর হাসপাতালে জেলার অপর চারটি উপজেলা নালিতাবাড়ী, নকলা, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানগত সুবিধার জন্য পার্শ্ববর্তী জেলা জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চরাঞ্চল বেনুয়ারচর, আইরমারী, কান্দারচর, নাপ্তাইয়েরচর, সাজলেরচর, শিমুলচূড়া, নিলক্ষা, সাজিমারা, জিনারচর, বকশিগঞ্জ উপজেলার পাথারেরচর, সানন্দবাড়ী, খেতারচর, কামালপুর, ধানুয়া, বটতল এবং কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী এবং রাজীবপুর উপজেলার রোগীরা শেরপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। এত অল্প পরিসরে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র ১৫ জন ডাক্তার। অভিযোগ রয়েছে, হাতেগোনা কিছু ডাক্তার ছাড়া অধিকাংশই যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। তারা হাসপাতালের চেয়ে বাইরে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে চেম্বার করে রোগী দেখতে বেশি পছন্দ করেন। অপরদিকে হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানান, সারা বছরের জন্য ২৬০ আইটেমের ওষুধ সরবরাহের চাহিদাপত্র দিলে তাদের ৫০ থেকে ৬০টি আইটেমের ওষুধ সরবরাহ করা হয় এবং প্রতিটি আইটেমের বিপরীতে চাহিদার এক থেকে দুই ভাগ দেয়া হয়। এ ছাড়াও সাধারণ জ্বর ও পেটের অসুখের জন্য প্যারাসিটামল বা ট্রেটাসাইক্লিনের ওষুধগুলোর সরবরাহ প্রায় স্বাভাবিক রয়েছে।
সিভিল সার্জন ডা. নারায়ণ চন্দ্র দে জানান, হাসপাতালের প্রত্যেক ডাক্তারের সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করার সরকারি নিয়ম রয়েছে। কিন্তু ডাক্তারদের অনিয়মিত উপস্থিতির প্রশ্নের উত্তরে তিনি নিশ্চুপ থাকেন।