ব্যাধির নাম পর্নোগ্রাফি
‘এইটিন ইয়ার্স ওল্ড ভার্জিন। মামা, লাগবে নাকি? ইন্ডিয়া থেকে এসেছে নতুন। পানির মতো ক্লিয়ার ছবি। দামে ঠেকবে না।’ ঢাকার তেজগাঁও থানার নাকের ডগায়, ফার্মগেটের ওভারব্রিজের পাশের রাস্তা দিয়ে কলেজে যাওয়ার সময় ছেলেটিকে এ ধরনের কথা শুনতে হতো প্রায়ই। এভাবেই এক দিন দুপুরে পেছন ফিরে তাকায় ১৭ বছরের অনিক (ছদ্মনাম)। এদিক-ওদিক তাকিয়ে কিছুটা আগ্রহ, একটু উত্তেজনা ও বড় কৌতূহল থেকেই কাঁপা হাতে উল্টে-পাল্টে দেখে কয়েকটি সিডি। বাসায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে নিজের ল্যাপটপে ওপেন করে সিডি। শুরু সেই থেকে। দেখতে দেখতে এক সময় পড়াশোনার চেয়েও বেশি আসক্ত ও আগ্রহী হয়ে পড়ে পর্নো সিডির এই ‘যৌন পাঠে’।
পরিবারের অজান্তে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে অনিকের স্বাস্থ্য, মন ও একাডেমিক ক্যারিয়ার। শুধু ফার্মগেটই নয়, পর্নোগ্রাফিতে এভাবেই সয়লাব হয়ে গেছে পুরো দেশ। আর এর বিষাক্ত ছোবলে প্রতিনিয়ত বিদ্ধ হচ্ছে তরুণ ও যুবসমাজ। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদাসীনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দিন দিন। ফলে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা যাচ্ছে না।
পর্নোগ্রাফি কী: এককথায় পর্নোগ্রাফি হিসেবে চিহ্নিত করা যায় অশ্লীল রচনা ও চিত্রকে। তবে এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পর্নোগ্রাফি আইন-২০১২-তে বলা হয়েছে, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কোনো অশ্লীল সংলাপ, অভিনয়, অঙ্গ-ভঙ্গি, নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নৃত্য যা চলচ্চিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও ভিজুয়াল চিত্র, স্থিরচিত্র, গ্রাফিকস বা অন্য কোনো উপায়ে ধারণকৃত ও প্রদর্শনযোগ্য এবং যার কোনো শৈল্পিক বা শিক্ষাগত মূল্য নেই এবং যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী অশ্লীল বই, সাময়িকী, ভাস্কর্য, কল্পমূর্তি, মূর্তি, কার্টুন বা লিফলেট। এসব পর্নোগ্রাফি উৎপাদন, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, আমদানি-রপ্তানি, সরবরাহ, ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শন অপরাধ।
পর্নোগ্রাফি যেখানে-সেখানে: একটি সিডির দোকান থাকবে, অথচ সেখানে কাটপিস, হটপিস বা পর্নো সিডি পাওয়া যাবে না- এটি প্রায় অসম্ভব। এ ছাড়া জনাকীর্ণ রাস্তার মোড় ও ওভারব্রিজ, রাস্তার পাশে ম্যাগাজিন ও পত্রিকার দোকান, সাইবার ক্যাফে, পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহন এবং সিনেমা হলের পাশে- কোথায় নেই পর্নোগ্রাফি? ‘যেখানে নেই’-গোপন করে রাখা আছে সেখানেও। মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় পর্নোগ্রাফি খুবই সহজলভ্য হয়ে গেছে এখন। সূত্রমতে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পর্নোগ্রাফি বিক্রি হচ্ছে দেদার। মফস্বল শহর ও গ্রামের সিডি দোকানগুলো পর্নোগ্রাফির অন্যতম উৎস বলে মনে করেন অনেকে। ঢাকা শহরে যেসব জায়গায় পর্নোগ্রাফি সহজে ও সুলভ মূল্যে পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে- ফার্মগেট, নিউমার্কেট, কারওয়ানবাজার, যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁও, গুলিস্তান, কমলাপুর, মহাখালী, নীলক্ষেত ও নয়াপল্টন।
পর্নোগ্রাফিতে শিশু: আইন অনুযায়ী পর্নোগ্রাফি যেমন দণ্ডনীয় তেমনি এতে শিশুর ব্যবহারও শাস্তিযোগ্য। তবু এক্ষেত্রে শিশুদের ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছেই। অনেকের মতে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও কম বয়সীদের পর্নোগ্রাফির চাহিদা বেশি। এর উৎপাদন ও নির্মাণে শিশু বা অপেক্ষাকৃত কম বয়সীদের ব্যবহারের অন্যতম কারণও এটাই। আবার এর বিক্রিতেও শিশুর ব্যবহার বাড়ছে দিন দিন। বিশেষ করে পর্নোগ্রাফির বিক্রয় কাজে শিশুদের দেখা গেছে ফার্মগেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে। ফার্মগেটের একটি ভাসমান পর্নো দোকানের এক শিশু বিক্রয় কর্মীর সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয় বুধবার রাতে। সে জানায়, শুধু স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী বা তরুণ-যুবকই নয়, মুরবি্বগোছের ব্যক্তিরাও পর্নো সিডির ক্রেতা। পুলিশের বাধা দেওয়ার বিষয়ে সে জানায়, এ জন্য মাসোহারা দেওয়া হয় পুলিশকে।
আইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই: পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২-এর কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘যেহেতু পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের ফলে নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে এবং বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।’ এ আইনে ক্ষেত্র ও ধরন বিশেষে পর্নোগ্রাফির শাস্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর। কিন্তু তবু রোধ করা যাচ্ছে না এ আইনে সংজ্ঞায়িত সব অপরাধ। এ জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে সরকার ও মিডিয়াকে। রাজধানীর তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘ফার্মগেটের যে অংশটি আমাদের থানার অন্তর্ভুক্ত সে এলাকায় পর্নোগ্রাফি বিক্রি হওয়ার কথা প্রথম শুনলাম আপনার কাছেই। আমাদের থানা এলাকায় পর্নোগ্রাফি বিক্রি বা প্রচারের ঘটনায় কেউ জড়িত থাকলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পর্নোগ্রাফির প্রভাব: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র কনসালটেন্ট ত্বক, এলার্জি ও যৌনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. এ কে এম মাহমুদুল হক খায়ের বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ব্যক্তির সবসময় চিন্তা থাকে পর্নোকেন্দ্রিক। নষ্ট হয় উৎপাদনশীলতা ও সৃজনশীলতা। স্বাভাবিক যৌন সম্পর্কে খুশি হয় না সে। ভুলভাবে যৌনচর্চা করতে শেখে ব্যক্তি জীবনে। সন্দেহ, অবিশ্বাস দানা বাঁধে মনে। বিবাহিত জীবনেও থাকে অসুখী।’ বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের সাম্প্রতিক এক সেমিনারে জানানো হয়, নিজের পর্নো ভিডিও ক্লিপ বাজারে ছড়িয়ে পড়ার কারণে ১৩ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে গত বছর।