‘বিএনপি-বিজেপি চক্রের গোপন চুক্তি আওয়ামী-কংগ্রেস চক্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। জনপ্রিয় তাত্ত্বিক, অর্থনীতিবিদ, জাতীয় সম্পদ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা। তথ্য ও যুক্তি দিয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এক ব্যাখ্যা দিয়েছেন বর্তমান রাজনীতি ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে। কথা বলেছেন ভারতের নির্বাচন পরবর্তী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিষয়ে। ব্যাখ্যা করেছেন সরকারের উন্নয়ন নীতির মূল সঙ্কটটা কোথায়। অর্থনীতির জটিল এক হাতিয়ার ‘জিডিপি’ ও এর প্রবৃদ্ধির নানা সূত্রের পেছনে কোন তথ্যগুলো গোপন থাকে তা উন্মোচন করে দিয়েছেন। পাট নিয়ে সরকারের নীতির সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, শুধু পাট দিয়েই আমরা বিশ্বের অন্যতম শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে পারি। তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির আন্দোলনের বর্তমান স্থিতাবস্থা নিয়েও জবাবদিহি করেছেন। দীর্ঘ এ সাক্ষাৎকারে ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি। দেশ ও দেশের স্বার্থেই যেখানে মূলকথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিস রায়হান
সাপ্তাহিক: বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ভবিষ্যৎ কী হতে পারে বলে মনে করেন।
আনু মুহাম্মদ: গত চার দশকের শাসনব্যবস্থায়, তা সামরিক বা বেসামরিক যেমনই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা দেখলাম, যারা ক্ষমতায় আসে তারা যেকোনোভাবে হোক ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে। এটা করতে গিয়ে তারা সবকিছুর ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। তারা এদেশে কোথাও কোনো প্রতিষ্ঠানকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। তারা সংবিধানকে কাজ করতে দেয় না। বিচার বিভাগকে কাজ করতে দেয় না। পুলিশ, সেনাবাহিনীকেও তারা সঠিকভাবে কাজ করতে দেয় না। নির্বাচন কমিশনকে কাজ করতে দেয় না। অর্থাৎ এখানে কোনো প্রতিষ্ঠানকে তারা দাঁড়াতে দেয়নি। আমরা ভারতের নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখতে পাব, এত বড় দেশে নির্বাচন হলো, কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকল, তাদের অধীনেই নির্বাচন হলো, তা সত্ত্বেও সেখানে তেমন কোনো বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ঘটেনি। তাদের নির্বাচন কমিশন কিন্তু ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করেছে। এটা করতে পেরেছে কারণ, প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ। ওই প্রতিষ্ঠানটি আমাদের দেশেও আছে কিন্তু তার হাত-পা বাঁধা। অর্থাৎ আমাদের শাসকরা প্রাতিষ্ঠানিকতার বিকাশ ঘটতে দেয়নি। এটা বাংলাদেশকে বিপজ্জনক পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
একটা দল, একটা পরিবারের ইচ্ছামাফিক দেশ চালানো হলে, তার মধ্যে তো কোনো গ্রহণযোগ্য কাঠামো তৈরি হতে পারে না। বর্তমান সরকার নিজেরাই জানে যে, তারা জোর জবরদস্তি করে ক্ষমতায় এসেছে। অধিকাংশ কেন্দ্রে কোনো ভোটই পড়েনি। নির্বাচনের আগেই তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেছে। একটা ভোটারবিহীন সংসদ এখন দেশ চালাচ্ছে। যাদের কোনো বিরোধী পক্ষ নেই। এমনকি নিজেদের ওপরও নিজেদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের নিজেদের মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, এই অবস্থা খুব বেশিদিন চলবে না। তাই তারা নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। যে যেভাবে পারে সম্পদ বানিয়ে নিচ্ছে। এজন্য যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছে, তাদের দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ফলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন র্যাব, পুলিশ এখন ভাড়াটিয়া বাহিনীতে পর্যবসিত হয়েছে। পেশাদার সন্ত্রাসী বাহিনী, পেশাদার লাঠিয়াল বাহিনী, পেশাদার খুনির মতোই তারাও টাকার বিনিময়ে কাজ করছে। তারাও সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের মতো করেই সম্পদ বানানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে।
আমরা যদি গভীরভাবে দেখি, তাহলে দেখতে পাব যে, দল হিসেবে এসব ক্ষেত্রে রাজনীতি, অর্থনীতি, বিদেশনীতি, দুর্নীতি, যেকোনো উপায়ে সম্পদ গড়া, খুনোখুনি, লুণ্ঠন, কোনো ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। আওয়ামী লীগ নিজেকে বিএনপির চেয়ে উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করার জন্য, জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতার জন্য, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওপর ভর করেছে। স্বাভাবিকভাবেই আমরা দেখেছি, তারা বিষয়গুলোকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এ নিয়ে নানা ধরনের কূটচাল দিয়েছে। নিজেদের সমস্ত অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে যুদ্ধাপরাধের বিচারকে। এভাবে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কলঙ্কিত করেছে, জনগণের মধ্যে এই চেতনার সম্প্রসারণটা এখন আর কোনো সংগ্রাম বা অন্যায় বিরোধী চেতনা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বরং অন্যায় করার একটা পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা জানাতে গিয়ে সোনা নিয়ে যে কেলেঙ্কারী করেছে তা জাতির জন্য লজ্জার। যুদ্ধাপরাধের বিচারও তাই।
সব মিলিয়ে অবস্থা এখন এরকম যে, রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই কাজ করছে না। নাগরিকের সেবা করছে না। এগুলো ক্ষমতাসীনদের দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের তাড়াহুড়া দেখে মনে হচ্ছে, তারা বুঝতে পারছে যে, এভাবে চলবে না। আমার ধারণা, তারা দ্রুতই নির্বাচন দেবে। আওয়ামী লীগ যে সম্প্রতি জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়ার মধ্যে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে যে দরকষাকষি ও সম্পর্কোন্নয়ন হচ্ছে, এটাকে আমার কাছে বিশেষ ইঙ্গিতপূর্ণ মনে হচ্ছে। এই আওয়ামী-জামায়াত, হেফাজত সখ্যতা নির্বাচন এগিয়ে আসার লক্ষণ।
সাপ্তাহিক: যদি নির্বাচন এগিয়ে না আসে, সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে? সাধারণত এ ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা দখলের পথে হাঁটতে দেখার অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। সরকার এসব বুঝেই কি সেনাবাহিনীকে তোষামোদের নীতি গ্রহণ করছে?
আনু মুহাম্মদ: সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতা দখলের সুযোগ এখন আর আগের মতো নেই। আন্তর্জাতিকভাবে এর গ্রহণযোগ্যতা নেই, পরিস্থিতি বদলেছে। এটা ষাট দশক পর্যন্ত, বলা চলে আশির দশক পর্যন্ত ছিল। আশির দশকের পর আর নতুন করে পৃথিবীর কোনো দেশেই সেনা শাসন আসেনি।
অন্যদিকে যেসব দল আমাদের দেশে সরকার গঠন করে, তারা সকলেই শোষণ পীড়নমূলক, বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার ওপর, জোর জবরদস্তির ওপরই দাঁড়িয়ে থাকে। এর মাধ্যমে তারা জনগণের বিপুল সম্পদ লুট করে। ব্যতিক্রমহীনভাবে এসব ক্ষেত্রে তারা সেনাবাহিনীকে অংশীদার বানায়। এর মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকাটা নিশ্চিত করে। এটা পাকিস্তানে আমরা দেখতে পাই। বাংলাদেশেও একই অবস্থা। বিভিন্ন ধরনের বেসামরিক তৎপরতা ব্যবসা, বাণিজ্য কিংবা বিভিন্ন প্রকল্প, সরকারি, আধা সরকারি কাজ, সর্বত্রই তারা সেনাবাহিনীকে টেনে এনেছে। তাদের টাকা পয়সা বানানোর সুযোগ করে দিয়েছে। র্যাবের মধ্যে সেনাবাহিনীকে এনে তাদের বিভিন্ন ভাড়া খাটা কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজে তাদের যুক্ত করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর মধ্য থেকে যেসব দাবি করা হয়, সেগুলোকে কোনো বিচার বিবেচনা না করে, তা আরও বেশি বেশি করে পূরণ করা হচ্ছে। অস্ত্র আমদানি, ব্রিগেড বাড়ানো থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত রামুতে ১৮০০ একর জমি দেয়া- সবখানেই দেখা যাবে শাসকরা সেনাবাহিনীকে তুষ্ট রাখার নীতিতে চলছে।
রামুতে জমি দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার যুক্তি দিচ্ছে যে, বৌদ্ধরাই চেয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে সেনানিবাস করার সময়ও একই কথা বলা হয়েছিল। এর মধ্যে দিয়ে বিপুল পরিমাণ বন উজাড় হবে। পাহাড় ধ্বংস হবে। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চল ঘিরে মার্কিনের যে রণনৈতিক পরিকল্পনা তা বাস্তবায়নের জন্য এই জমি দেয়া হতে পারে। আমরা দেখেছি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেসব কর্তাব্যক্তিরা এদেশে আসে, তারা সবাই চট্টগ্রাম সফরে যায়। ওই অঞ্চলে তারা নানাভাবে পুঁজি বিনিয়োগ করছে। একই সঙ্গে সামরিক করণের কাজটাও এগুচ্ছে। বিষয় হচ্ছে, ওই পুরো অঞ্চলটাই নানা ধরনের খনিজসম্পদে ভরপুর। চীনও খুব বেশি দূরে নয়। তাই মার্কিনের যে বিরাট স্বার্থ আছে ওখানে, এটা অনুমান করাই যায়। আমি নিশ্চিত নই যে, এই সামরিকীকরণের ক্ষেত্রে মার্কিনের যোগাযোগ ঠিক কতটা। তবে তাদের সম্পৃক্ততার পেছনে এখানে আমরা জোরালো কিছু যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি।
সাপ্তাহিক: সম্প্রতি আমাদের পত্রপত্রিকায় ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী ‘র’ কর্তৃক পাকিস্তানের ‘আইএসআই’এর ওপর আধিপত্যমূলক তৎপরতা নিয়ে খবর প্রকাশ হয়েছে। আমরা দেখেছি এখানে মার্কিন কম বেশি আওয়ামীবিরোধী ভূমিকায় ছিল। আপনার কি মনে হয় যে, বাংলাদেশে মার্কিনের নিয়ন্ত্রণ কমছে?
আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশে তো বহু ধরনের গোয়েন্দা সংস্থা কাজ করে। ‘র’ তো এখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। ‘আইএসআই’ আছে, ‘সিআইএ’ আছে। এটা খুবই গোলমেলে। কারণ গোয়েন্দা সংস্থা মানেই তো একটা গোপন সাম্রাজ্য। দানবীয় এক গোপন কাঠামো। কে, কোথায় কার মধ্যে কাজ করছে, তারা নিজেরাও জানে না। ‘র’ এর কাজই হচ্ছে ‘আইএসআই’ কি করছে তা জানা। তারা চর ঢোকাচ্ছে। ওরাও ঢোকাচ্ছে। এভাবে একে অপরের মধ্যে নানাভাবে তৎপরতা চালায়। কে, কখন কার কাজ করে এটা জানা, বোঝা খুবই মুশকিল। সংস্থাগুলো নিজেরাও জানে না।
এখন যে এদেশে ‘র’ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, এটা তো বোঝাই যায়। তারা পার্শ্ববর্তী দেশ, বড় দেশ। এদেশে তাদের বিনিয়োগ আছে, নানা ধরনের স্বার্থ আছে। তবে তার অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তো আর আগের মতো নেই, যেমনটা সোভিয়েত যুগে ছিল। তখন ভারত ছিল সোভিয়েতের দিকে। তা সত্ত্বেও মার্কিনের সঙ্গেও তার সদ্ভাব বজায় ছিল। এখন তা বড় ধরনের পারস্পরিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এগুচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক, নানা ধরনের চুক্তি আছে। এটা খুবই সম্ভব যে, বাংলাদেশে তৎপরতার ক্ষেত্রে দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে একটা বোঝাপড়া আছে। বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ সামরিক মহড়া এই ধারণাকে শক্তিশালী করে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে মার্কিনের কিছু দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ভারত চায় বাংলাদেশে তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। অন্য কোনো দেশ এর মধ্যে আসতে হলে তাদের মাধ্যমে, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে আসতে হবে। ভারতই এখানকার আঞ্চলিক মোড়ল বা কমান্ডার। এই পদবিটা কিন্তু আবার তাকে যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছে। আশির দশকের গোড়াতে যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম ভারতকে এ অঞ্চলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সোভিয়েতের পতনের পর আনুষ্ঠানিক নানা চুক্তির মাধ্যমে তারা এ স্বীকৃতিকে বাস্তব কাজে সম্প্রসারিত করেছে। ভারত এখন এ অঞ্চলের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত বাস্তবায়নের প্রধান ঘাঁটি। সব সময়ই অপরাপর সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতকে মাঝখানে বসিয়েই এ অঞ্চলের পরিকল্পনা দাঁড় করায়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ও ভারতের মধ্যেকার যে দূরত্ব আমাদের অনুভূত হচ্ছে তা বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো নির্ধারক বিষয় বলে আমার মনে হয় না। সবকিছু মিলিয়ে এখানে মার্কিনের স্বার্থ কিছুই কমেনি। বরং এই সরকারের ওপর তাদের কিছু কারণে বিরক্তি তৈরি হয়েছে। ড. ইউনূস, পদ্মা সেতু, রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনা, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প এবং সর্বশেষ নির্বাচন এর মধ্যে অন্যতম। তাদের এই বিরক্তি দূর করার জন্য আওয়ামী সরকার মরিয়া হয়ে ছুটছে। মার্কিনকে প্রসন্ন করার জন্য সরকার টিকফা চুক্তি করেছে, সমুদ্রের গ্যাস ব্লক বরাদ্দ দিচ্ছে, স্থলভাগের গ্যাস ব্লকগুলো বরাদ্দ দেয়ার আয়োজন চলছে। এভাবে সেবাখাতসহ সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানে মার্কিনের পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে জাতির গলায় আরও বেশি করে ফাঁস পরাচ্ছে। ফলে মার্কিনের নিয়ন্ত্রণ আদৌ কমছে বলে মনে হয় না।
সাপ্তাহিক: ভারতের নির্বাচনের ফলাফল বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামনের দিকে কী ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে?
আনু মুহাম্মদ: মোদি যে প্রধানমন্ত্রী হবে, বিজেপি যে জিতবে এটা নিয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু তারা যে এ রকম বিরাট ব্যবধানে এককভাবে জিতবে এটা কেউ ভাবেনি। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে সঙ্কট সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো অনেক দিনের। বিজেপি এর মধ্যে ক্ষমতায় এসেছে, কংগ্রেস এসেছে, ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে কিন্তু ভারতের নীতি বদলায়নি। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া, নদী শাসন, পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, ছিটমহল, বাণিজ্য বৈষম্য, ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশকে করদ রাষ্ট্র হিসেবে দেখা, এ নীতিগুলো কখনই পরিবর্তন হয়নি। এই সমস্ত সমস্যা যে সামনের দিকেও অব্যাহত থাকবে এটা বলাই যায়, কংগ্রেস থাকলেও এর হেরফের হতো না। বিজেপি গুজরাট মডেল বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের যেসব কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে সেগুলো কিন্তু মনমোহনের নীতিরই বাস্তবায়ন। কংগ্রেস যেসব নীতি গ্রহণ করেছিল প্রচার করেছিল তা বাস্তবায়নে তাদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের দুর্বলতা ছিল প্রকট। মোদি সে কাজটি গুজরাটে করে দেখিয়েছেন এবং সারা ভারতে সেটি করে দেখাবার আশ্বাস দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কংগ্রেসের চেয়ে বিজেপি সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী দল। কর্মীপর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ কংগ্রেসের চেয়ে অনেক বেশি, সরকারেও তাই থাকবে। বিজেপির ফ্যাসিস্ট চেহারা সারা পৃথিবীর জন্যই ভীতিকর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা বিশেষ নতুন কোনো পরিকল্পনা নেবে কি না তা পরিষ্কার নয়। তবে এটা স্পষ্ট যে ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতের আমলাতন্ত্রের যে প্রভাব ছিল তা অনেকটা কমে যাবে। ভারতের আমলারা যেভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করত, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দিত, তা এখন আর চলবে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের কার্যকলাপ এখন যাই হোক না কেন তা হবে রাজনৈতিক। যদি তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরও আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করে তা বিজেপির রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশই হবে। ভারতীয় আমলাতন্ত্রের যে সাধারণ বাংলাদেশ বিরোধিতা, তা অনেকটা খর্ব হবে।
বিজেপি নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে যেসব বক্তব্য বিবৃতি দিয়েছে, তাকে রাজনৈতিক ট্রামকার্ড, সাম্প্রদায়িক কৌশল হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। এগুলো বলে তারা ভোট কামিয়েছে। এ সংস্কৃতি এ অঞ্চলে আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি, তার কতটা তারা বাস্তবায়ন করবে তা অচিরেই আমরা দেখতে পারব। বিষয়টা এমন নয় যে কংগ্রেস চলে গেছে আর আমরা বিপদে পড়ে গেলাম। কংগ্রেস চলে যাওয়ার ফলে এখানে তার ঐতিহাসিক মিত্র আওয়ামী লীগ কিছুটা সমস্যায় পড়তে পারে। এ সুযোগটা বিএনপি জামায়াত জোট কাজে লাগাতে পারে। বিএনপির তো এই রেকর্ড আছে যে মুখে ভারত বিরোধিতার কথা বললেও ক্ষমতায় থাকাকালে তারা ভারতীয়দের সকল ধরনের সুবিধাই দিয়েছে। এবার বিএনপি-বিজেপি চক্রের গোপন চুক্তি আওয়ামী-কংগ্রেস চক্রকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বিএনপি বিজেপির সঙ্গে আরও বেশি গোপন চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য এটাই হবে বড় বিপদের কারণ।
সাপ্তাহিক: কংগ্রেসের নীতিতে আমরা সব সময়ই এক ধরনের নমনীয় ভাব দেখেতে পাই। বিভিন্ন ইস্যুতেই আমরা দেখেছি তারা তাদের উদ্দেশ্যটা ঠিকই হাসিল করে নেয়। কিন্তু বলার সময় তাদের ভাবটা এমন হয় যে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তারা খুবই আন্তরিক। বিপরীতে বিজেপির মনোভাবটা দাম্ভিকতাপূর্ণ। যেন আমরা তাদের দাস। এ ক্ষেত্রে সহিংসতার আশঙ্কা থাকছে কি?
আনু মুহাম্মদ: আমার ধারণা ট্রানজিট, করিডোরের মতো বিষয়গুলো একান্তই ভারতের কর্পোরেট স্বার্থের ব্যাপার। এখানে কংগ্রেস, বিজেপির অবস্থান অভিন্ন। আচরণগত পার্থক্য দুই দলের ক্ষেত্রে থাকতে পারে। তবে সহিংসতার আশঙ্কা বিজেপির আমলের চেয়ে কংগ্রেসের আমলে কিছু কম থাকে না। সহিংসতা হয় না, কারণ তারা যা চায়, তার চেয়ে বেশি পেয়ে যায়। এখনও তাই হবে। এর ব্যত্যয় ঘটার কোনো সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের কোনো সরকার এটা দেখাতে পারেনি যে, জাতীয় স্বার্থ নিয়ে তারা অন্য কোনো দেশের সঙ্গে দরকষাকষি করছে। এটা করার জন্য যেসব অনুসন্ধান গবেষণা দরকার, তা তারা করে না। যেসব ক্ষেত্রে সক্ষমতা বাড়ানো দরকার, সেখানে যা ক্ষমতা থাকে তাকে তারা ধ্বংস করে দেয়। এজন্যই ভারতের পক্ষে সুবিধা হয়। বাংলাদেশকে তো তাদের মোকাবেলা করতে হয় না। বাংলাদেশ তো ছোট দেশ না। ১৬ কোটি মানুষের দেশ। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে আমাদের কথা বলার সুযোগ আছে। তথ্য, উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করার ব্যাপার আছে যে, ভারত কর্তৃক আমরা নিগৃহীত হচ্ছি। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। আন্তর্জাতিক আইনের বরাত দিয়ে ভারতকে অনেক ক্ষেত্রেই চ্যালেঞ্জ করা যায়। কিন্তু আমাদের সরকারগুলো সেই পথে হাঁটে না। তারা অধঃস্তন হিসেবে আচরণ করে। অধীন থেকেই নিজেদের স্বার্থটা ভালো হাসিল করা যায়। এটা তারা জানে। দেশের স্বার্থের কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। সে ক্ষেত্রে বিদেশি কোনো পক্ষ দ্বারা বা ভারত দ্বারা তো আক্রান্ত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ ভারত যা চায়, তার থেকে বেশি পেয়ে যায় চাওয়ার আগেই।
সাপ্তাহিক: রাজনীতির সঙ্গে অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট। গার্মেন্টে মজুদ জমছে বলে দাবি করেছেন গার্মেন্ট মালিকরা। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থাকে কীভাবে দেখছেন? এর গতিমুখ কোনদিকে?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতি নিয়ে সরকার অধিকাংশ সময়েই মিথ্যা কথা বলে। ভুল তথ্য দেয়। এটা এখানকার একটা সাধারণ প্রবণতা। সবচেয়ে বেশি মিথ্যা তথ্য দেয় গার্মেন্ট মালিকরা। এটা তাদের একটা কৌশল। সব সময়ই তারা সঙ্কটের কথা বলে। যেমন, রানা প্লাজা ধস, মজুরির আন্দোলন এবং শ্রমিকবিরোধী শ্রম আইন প্রণয়ন এতসব ঘটনার মধ্যেও কিন্তু গার্মেন্টের রপ্তানি বেড়েছে। তাহলে মজুদ বাড়বে কীভাবে? বাজেট আসার আগেই সরকারের কাছ থেকে তারা বাড়তি যে সুবিধা পাচ্ছে, তার পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। বাজেটে তো নানা ধরনের প্রণোদনা যোগ হবেই।। সরকার শ্রমিকদের জন্য তোলা চাঁদার টাকা ফেলে রেখেছে। তাদের তা দিচ্ছে না। কিন্তু মালিকদের তিন হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে। এটা কোন নীতি? গার্মেন্ট মালিকরা সবসময়ই কান্নাকাটি করে। সরকার থেকে তো আর তারা আলাদা না। তারা সরকারের ভেতরেরই একদল লোক। ফলে সরকার ও গার্মেন্ট মালিকদের মধ্যে একটা চুক্তি হয়। তার সুবাদে কোনো একটা ক্ষেত্র বা ঘটনা তৈরি করে মালিকদের সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়।
এখন অ্যালায়েন্স, অ্যাকর্ড তদন্ত চালাচ্ছে। সরকারের মুখ দিয়ে শ্রমিকপ্রীতির খই ফুটছে। কিন্তু এখনও অনেক গার্মেন্টেই দেখা যাবে নতুন মজুরি বাস্তবায়ন হয়নি। সুতরাং মালিকদের সঙ্কটের কথাগুলো আসলে ফাঁকি। যতদিন তাদের সঙ্কটের কথা শোনা যাবে, ততদিনই তাদের বিকাশ ঘটবে।
সাপ্তাহিক: অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
আনু মুহাম্মদ: রেমিটেন্সের অবস্থা এখনও ভালো। কিন্তু এটা কিছু সমস্যায় সামনের দিকে পড়বে বলে মনে হচ্ছে। সেটাও সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা আয়োজনের একটি ভোটাভুটিতে সরকার রাশিয়াকে ভোট দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য, দুবাইকে এক্ষেত্রে সরকার ভোট দেয়নি। ফলে তারা শ্রমিক নেয়া বন্ধ রেখেছে। এটা সামনের দিকে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রবাসী শ্রমিকরা কেমন আছে, তা নিয়েও সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাদের থাকা, খাওয়া পরা নিয়ে সরকার কিছু করে না। কীভাবে তারা বিদেশে গিয়ে জীবনযাপন করে এটা নিয়ে সরকারের কোনো তৎপরতা নেই। গার্মেন্ট শ্রমিকদের মতোই প্রবাসী শ্রমিকরাও ভয়াবহ শ্রম আর কঠিন অবস্থার মধ্য দিয়ে জীবন পার করেন। দেশের অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা বিরাট। কিন্তু সরকারের কোনো সহযোগিতাই তারা পান না। এটা অর্থনীতিকে আক্রান্ত করবেই। আজ হোক বা কাল।
শিল্পসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল খাত এখন পড়ে আছে চোরাই টাকার কবলে। টেলিকমিউনিকেশন তথা মোবাইল কোম্পানি এবং বাড়ি বানানো তথা রিয়েল এস্টেট এই দুটো তো এখন অর্থনীতির প্রধান খাত। এখানে নানা ধরনের অনিয়ম, অস্বচ্ছতা বিদ্যমান। জমি দখল রিয়েল এস্টেটের প্রধান কাজ। আর মোবাইল কোম্পানিগুলোর কাজ হচ্ছে বিদেশে অর্থ পাচার এবং ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া। উভয়ক্ষেত্রেই সরকারের অবস্থান হচ্ছে কমিশনখোর। সমস্ত ক্ষেত্রে অনিয়মগুলোকে তারা বৈধতা দেয় কমিশনের বদলে।
সরকারের কাজের আগ্রহ আমরা দেখি বড় প্রকল্পগুলোতে। এগুলো অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখে। সরকার সাধারণত কম খরচের কাজে আগ্রহ দেখায় না। হাজার হাজার কোটি টাকার কাজে তাদের আগ্রহ বেশি। এরকমই একটা প্রকল্প হলো যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার। সেখানে আমরা দেখেছি কীভাবে টাকা ঢালা হয়েছে। এক কিলোমিটার ফ্লাইওভারের সাধারণ যে খরচ বিশ্বব্যাপী ধরা হয়, এমনকি আমাদের দেশেও আগের ফ্লাইওভারগুলোতে যে খরচ হয়েছে, এখানে খরচ হয়েছে তার তিনগুণ বেশি। এই অতিরিক্ত ব্যয় সরকার কেন মেনে নিল? একটাই উত্তর, কমিশন খেয়ে। আর এর দায় মেটাতে হবে জনগণকে। বছরের পর বছর উচ্চহারে ট্যাক্স গুনে। সরকারের লক্ষ্য তাই বড় প্রকল্প। বড় কমিশন। এসবের কারণেই আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, টাকার অঙ্কের হিসাবে বিরাট বিনিয়োগ হচ্ছে। ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলছে। কিন্তু এর বড় অংশই হচ্ছে অনুৎপাদনশীল এবং চোরাই টাকা। অর্থনীতির মধ্যে চোরাই টাকার অনুপাত ক্রমশ বাড়ছে। এর মালিকেরা আবার প্রভাবশালী, রাজনৈতিক ক্ষমতার কর্ণধার। ফলে টাকার ভাগবাটোয়ারাকে কেন্দ্র করে খুন, গুম, সন্ত্রাস বেড়ে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। এখানে যারা এগুলো করতে পারছে তারাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে সুবিধা পাচ্ছে। যিনি উৎপাদনশীল খাতে শান্তিপূর্ণ পথে বিনিয়োগ করছেন, তিনি তো কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। কোনো প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন না। ফলে বৈধ টাকার চেয়ে অবৈধ টাকার ক্ষমতা এখানে ক্রমশ বাড়ছে। এটা অর্থনীতিকে গর্তে নিয়ে ফেলবে।
কৃষিক্ষেত্রে আমরা সবাই জানি যে, একটা ভারসাম্যহীন বিকাশ ঘটে চলেছে। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধির তাগিদটাই এখানে গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে সার, কীটনাশকের ব্যবহার হচ্ছে অতিমাত্রায়। যা দীর্ঘমেয়াদে কৃষির বড় ধরনের ক্ষতি করছে। সেচ ব্যবস্থাটা ভূগর্ভস্থ পানিকেন্দ্রিক হওয়ায় আমাদের ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আমরা উৎপাদন বেশি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু এর সামগ্রিক ফলাফলটা যে নেতিবাচক হবে তা বলাই বাহুল্য।
কৃষিতে জিএম বীজের ব্যবহার যেভাবে বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে তা উদ্বেগজনক। কৃষিমন্ত্রীকে নিয়ে অনেকের অনেক আশা আছে। সব আশাকে দুরাশায় পরিণত করে তিনিও জিএম বীজের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অথচ কার না জানা যে, এটা কৃষকদের স্বনির্ভরতা ধ্বংস করবে। কৃষি ব্যবস্থাকে পরনির্ভরশীল করে ফেলবে।
সুতরাং সাধারণভাবে উৎপাদনের উন্নতি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে ভারসাম্য নেই। তাই এর সামাজিক ও পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও হবে ব্যাপক। সামাজিক কোনো পরিকল্পনা নেই। টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেষ্টা নেই। বর্তমানকে মোকাবেলাই সবার লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। শাসকদের লক্ষ্য তো নিজেদের পকেট ভরা। এসবে তাদের কীবা যায় আসে।
সাপ্তাহিক: এই ভারসাম্যহীন বিকাশ অর্থনীতিকে কী ধরনের সঙ্কটে ফেলতে পারে?
আনু মুহাম্মদ: এটা তো এখনই দেখা যাচ্ছে। অনুৎপাদনশীল খাত অর্থনীতির নির্ণায়ক হয়ে যাচ্ছে। হাউজিং বাড়ছে ব্যাপক হারে। এটা দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক মাপা হচ্ছে। অথচ এর ফলে নদী, খাল, জলাভূমি, বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। কিছু লোকের টাকা হচ্ছে। কিন্তু বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে দেশ। ঢাকার মতো শহরগুলো তো মৃত্যুর মুখে। অনেক ক্ষেত্রেই সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে, যা বাজারকে, উৎপাদককে অস্থিতিশীল করে ফেলছে। আলু চাষিদের করুণ অবস্থা তো আমাদের সবার জানা। পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। গ্রীষ্মকালে অনেক এলাকাতেই চাপকলে পানি উঠছে না। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। নগরগুলো হয়ে উঠছে আবর্জনার স্তূপ। মিষ্টি পানির আধার ধ্বংস হচ্ছে। জমি কমছে, উর্বরতা কমছে। এসবের ফলে নতুন নানা রোগের উৎপত্তি হচ্ছে। মানুষ যা খাচ্ছে তাতেই বিষ। একদল লোকের অর্থের ক্ষুধা অর্থনীতিতে উন্নয়নের ছাপ ফেলছে। ফলাফলটা হচ্ছে বাদবাকি মানুষের ধ্বংস হাতে ডেকে আনা।
সাপ্তাহিক: পাটখাত নিয়ে অর্থমন্ত্রী বললেন যে, এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ধ্বংস হচ্ছে। আবার সরকারের অন্য মন্ত্রীরা বলছেন, পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনবেন। গত কয়েক মাসে সরকারি পাটকলগুলো বিরাট সঙ্কটের মুখে পড়েছে। বেসরকারি অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। পাট নিয়ে সরকার আসলে কী করছে?
আনু মুহাম্মদ: এমনিতেই সরকারের কথাবার্তার মধ্যে আমরা কোনো সঙ্গতি খুঁজে পাই না। একবার এটা বলে তো, আরেকবার বলে ওটা। দুই মন্ত্রী এক বিষয়ে কথা বললে বক্তব্য কখনো একরকম হয় না। তথ্যও দেয় ভুলভাল, মিথ্যা।
আর পাটখাত নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, তারা এই খাতের আসলেই কোনো উন্নতি চান না। নির্বাচনে ভোটের হিসাব নিকাশের কথা বিবেচনা করে তারা পাটকল চালুর কথা বলেছিল। দুটি পাটকল চালু করেছিল। কিন্তু সেখানে কোনো সুসমন্বিত, পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া হয়নি। যেখানে সবাই জানে যে, পাটখাতের উন্নয়নের জন্য দরকার নতুন করে বিনিয়োগ করা, সেখানে অর্থমন্ত্রী বরাদ্দ দিবেন না বলে বেঁকে বসেছেন। এই লোকটাকে চিনে রাখা দরকার। আমলা ও মন্ত্রী, দুইভাবেই তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির দেখভাল করছেন। পাটের ওপর তার আক্রোশটা নানা সময়ে আগেও দেখা গেছে। তিনি এখন বলছেন যে, পাটে হাজার হাজার কোটি টাকা ধ্বংস হচ্ছে। অথচ সরকার গত পাঁচ বছরে পাটখাতে বিনিয়োগ করেছে মাত্র এক হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এক হাজার কোটি টাকায় লাভ না হওয়ায় মন্ত্রী চটে গেলেন। কিন্তু এই সেই অর্থমন্ত্রী, যিনি হলমার্কের লুট করা চার হাজার কোটি টাকার বেলায় বলেছিলেন, এটা কিছুই না। হলমার্ক চার হাজার কোটি টাকা চুরি করলে তার গায়ে লাগে না। কিন্তু পাটখাতে এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করায় দুঃখে তার বুক ফেটে যাচ্ছে। পাট এমনই একটি খাত, শুধু এর দ্বারাই আমরা পৃথিবীর অন্যতম একটি শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হতে পারি। সরকার গার্মেন্ট মালিকদের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেয়। কিন্তু বেসরকারি পাটকল মালিকদের কিছুই দেয় না।
ভারত পাটজাত পণ্য ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। এদেশেও আইন আছে। কিন্তু সরকার তা বাস্তবায়ন করে না। পাট পরিবেশবান্ধব। মানুষ এখন পরিবেশ নিয়ে আগের চেয়ে অনেক সচেতন। কিন্তু সরকার পাট নিয়ে, পাটের ব্যবহার বাড়াতে কোনো প্রচারণা চালায় না। পাটের পুরো ব্যবসাটা তুলে দেয়া হয়েছে ভারতের হাতে। পাটের তন্তু থেকে সুতা করে কাপড় উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও সেই গবেষণা আলোর মুখ দেখে না। সেই প্রযুক্তি বিকশিত হয় না। প্রতি বছর পাট কেনা নিয়ে জাতীয় পাটকলগুলো সমস্যার মুখে পড়ে। কিন্তু কেন? ঘটনাটা হচ্ছে, পাটকলগুলো যা আয় করে, তা তাদের ব্যয় করার ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ কারখানাগুলো স্বায়ত্তশাসিত না। ফলে প্রতি বছর পাট কেনার মৌসুমে তারা সরকারের বরাদ্দের আশায় বসে থাকে। তাদের যা আয়, তা সময়মতো কোষাগারে জমা হলেও প্রয়োজনের সময়, পাট কেনার সময় সেই টাকা আর পাওয়া যায় না। এভাবে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে পাটকলগুলোকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়। পরে লসের হিসাব দেখিয়ে সরকার এগুলো বন্ধ করে। খালেদা জিয়া তো আদমজী বন্ধ করে বিদেশিদের বাহ্বা পেয়েছিলেন। শ্রমিকের পেটে লাথি মেরে, দেশের অর্থনীতির পিঠে ছুরি মেরে তিনি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ‘সাহসী দেশনায়ক’ এর খেতাব। বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারা তখন তার ভূয়সী প্রশংসা করেন।
পুরো বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করলে, এখানেও অর্থনীতির সেই সাধারণ প্রবণতাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। টেকসই, পরিবেশবান্ধব, স্বনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও পাটখাতে টাকা দিতে সরকার অপারগ। অন্যদিকে হলমার্ক টাকা নিলে বা গার্মেন্ট মালিকদের টাকা দিতে তাদের আপত্তি নাই। অনুৎপাদনশীল খাতকে প্রধান করে তোলা, দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি ডেকে আনা, বিনিময়ে কিছু কমিশন কামানোটাই সরকারের লোকজনের লক্ষ্য। টাকার অঙ্কে হিসাব করলে সামগ্রিক অর্থনীতিকে ঊর্ধ্বমুখী মনে হলেও বাস্তবে দেশ ও দশের জন্য তা ভয়ানক ক্ষতিকর।
সাপ্তাহিক: সরকার জনগণের নানা ধরনের উন্নয়নের ফিরিস্তি দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধির কথা। আমরা তো দেখছি জনগণের আয় ও ব্যয়ের ফারাক আগের চেয়ে অনেক বেশি। আয়ের তুলনায় যদি ব্যয় বাড়তেই থাকে তাহলে কি এটাকে উন্নয়ন বলা যায়? আগে যে পরিবারে একজন কাজ করতো, এখন দেখা যাবে সেখানে একাধিক সদস্য রোজগার করছে। আগে যিনি আটঘণ্টা শ্রম দিতেন, এখন তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি খাটছেন। তারপরও মানুষ কুলিয়ে উঠতে পারছে না। অথচ সরকার বলছে, জিডিপির প্রবৃদ্ধি বলে দিচ্ছে মানুষের আয় ও সক্ষমতা বাড়ছে। দেশও এগিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
আনু মুহাম্মদ: এটা ঠিক যে, আমরা জিডিপির প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছি। গত কয়েক বছর ধরেই এটা পাঁচ থেকে ছয়, কখনো তার ঊর্ধ্বেও উঠেছে। কিন্তু এটা সবসময় ইতিবাচক নয়। এটা অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্র প্রকাশেও সক্ষম নয়। এটা দিয়ে উন্নয়নের মাত্রা বোঝাতে গেলে ভয়ানক বিপদ হবে। এটা অর্থশাস্ত্রের এমন একটা হাতিয়ার, যা দিয়ে উন্নয়ন তৎপরতার নেতিবাচক দিকগুলোকে লুকিয়ে ফেলা যায়। জিডিপি তখনই বাড়ে, যখন অর্থনৈতিক লেনদেন বাড়ে।
যেমন ধরুন, ফ্লাইওভার হলে, পাহাড় কেটে হাউজিং করা হলে, নদীতে বাঁধ দেয়া হলে, বন উজাড় হলে জিডিপি বাড়বে। যদি বনে অনেক গাছ থাকে এবং সেগুলো না কাটা হয় তাহলে কিন্তু জিডিপি বাড়বে না। বিনা বেতনে শিক্ষা কর্মসূচি চালু করলে জিডিপি বাড়বে না। কিন্তু শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ হলে জিডিপি বেড়ে যাবে। বিনা টাকায় চিকিৎসা দিলে জিডিপি বাড়বে না। কিন্তু প্রচুর বেসরকারি ক্লিনিক করে, সেখানে মানুষের গলা কাটা হলে জিডিপি বাড়তে থাকবে।
জিডিপির প্রবৃদ্ধির সূত্রটা কি এটা আগে বিবেচনায় নিতে হবে। যদি দেখা যায় এ ধরনের উন্নয়ন, যা কিনা কিছু লোকের হাতে টাকা জমায় আর অন্যদের নিঃস্ব করে দেয়, প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, যা কিনা আমাদের দেশে হরদম চলছে, তাহলে এটাকে আদৌ উন্নয়ন বলার কোনো রাস্তাই নেই। কিন্তু অর্থশাস্ত্রের পরিভাষায় এটাকেই উন্নয়ন হিসেবে দেখানো হবে। আমাদের সরকার তাই দেখাচ্ছে। এটা এক ধরনের বিকৃত উন্নয়ন।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে দখল হচ্ছে উন্নয়নের একটা প্রধান ধরন। জমি দখল হচ্ছে, খাল-বিল, নদী-নালা, জলাশয়, যত ধরনের সর্বসাধারণের সম্পত্তি, সব হয় লিজের মাধ্যমে, নয় গায়ের জোরে দখল করা হচ্ছে। তাতে নানা ধরনের স্থাপনাও গড়ে উঠছে। এটাকে ধরা হচ্ছে উন্নয়ন। যেমন, রামপালে সুন্দরবন ধ্বংস করে সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্র করলে এটা হবে বিরাট উন্নয়ন। রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতি কী হুমকিতে পড়বে তা বিবেচ্য হবে না, এটাও হবে উন্নয়ন। রামুতে বন উজাড় করে ক্যান্টনমেন্ট করা হলে, এটাও হবে উন্নয়ন। এসব দেশ ও জাতি বিরোধী উন্নয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছে সরকার স্বয়ং। আর তার দলের লোকেরা তো দেদারসে পাহাড় কাটা, নদী দখল, বন উজাড় করে, যেখানে যেভাবে পারা যায় দখল চালিয়েই যাচ্ছে।
এর ফলে দেখেন, নির্মাণকাজই এখন জিডিপির প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে শক্তিশালী জায়গা। বাকি বড় দুটি খাত হচ্ছে, রেমিটেন্স ও গার্মেন্ট। এর সঙ্গে আছে দোকানপাট, শপিংমল। এগুলো কিন্তু কোনোটাই টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদে ইতিবাচক কিছু নয়। এখানে কোনো ভালো মানের কর্মসংস্থানও হচ্ছে না। গুণগত দিক থেকে বিবেচনা করে যে কর্মসংস্থান হবে, এটা যে অর্থনীতির ভিত্তি হবে, তা না। এখনকার জিডিপির ভিত্তিগুলো সবটাই নড়বড়ে। ফলে টাকা পয়সার লেনদেন হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে দেখতে গেলে এটাকে উন্নয়ন বলার কোনো সুযোগই নেই।
এবার দেখেন, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলো গুণগত মানহীন, অস্থায়ী এবং একেবারেই টেকসই নয়। ফলে মজুরি বা বেতন একেক জায়গায় একেক রকম। অধিকাংশ স্থানেই তা কম। চারজনের একটি পরিবারের দারিদ্র্যসীমার আয় এখন কমপক্ষে মাসে ১৮ হাজার টাকা। থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যয় মেটাতে এর চেয়ে বেশি লাগে। কিন্তু ১৮ হাজার টাকা বেতন তো শ্রমিক দূরে থাক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসকরাও শুরুতে পায় না। অনেকদিন কাজ করে তারপর তাদের বেতন হয়তো ওই পর্যায়ে যায়। শ্রমিকের তো কখনই না। অর্থাৎ সমাজের সুবিধাভোগী অংশগুলোই দারিদ্র্যসীমার নিচের আয় দিয়ে শুরু করে।
এজন্য আর কেউ একক আয় দিয়ে চলতে পারে না। পরিবারের একাধিক সদস্য রোজগার করেন। বেশি সময় খাটেন। গড়ে পাঁচ হাজার টাকা করে আয় ধরলে, পরিবারের দুজন সদস্য কাজ করলেও শ্রমিকদের দারিদ্র্যসীমার আয় হয় না। তখন তারা ওভারটাইম করে। এখন এটাকে দেখিয়ে যদি বলা হয় এই পরিবারের আয় দারিদ্র্যসীমার উপরে। তা কি ঠিক হবে? না। একজনের আয় দিয়ে পরিবার চলবে এবং তা হবে দারিদ্র্যসীমার আয়, এটাই নিয়ম। কিন্তু সরকার এটাকে ভুলভাবে দেখায়।
গ্রাম থেকে যে শ্রমিক শহরে এসেছে আগে হয়তো তার কাছে পাঁচশ’ টাকাও থাকতো না। এখন তার পকেটে তিন হাজার টাকা থাকছে। সে হয়তো ভাবছে যে, তার সচ্ছলতা বেড়েছে। সরকারও তাই বলছে। কিন্তু জীবনযাত্রার মান দেখেন। আগে সে কীভাবে থাকতো, এখন কীভাবে থাকছে, আগে সে কী খেতো, এখন সে কী খাচ্ছে, এগুলোর তুলনা হলে দেখা যাবে তার জীবনযাত্রার মান যতটা নেমেছে, বর্তমান আয় দিয়ে সে তা পূরণ করতে সমর্থ নয়। দেখা যাবে যে, তার পরিবারের পাঁচ বছর বয়সের শিশুটিও শ্রমে যাচ্ছে। প্রবীণরা ৬০ বছরে কর্মসীমা পেরোলেও ৮০ বছর বয়সেও দেখা যাবে সে কাজ কিছু একটা করছেই।
এবার আপনি সব ধরনের শ্রমিকের হিসাব নেন। দেখবেন, কোথাও কেউ দারিদ্র্যসীমার আয় করে না। নিরাপদ জীবন যাপন করার মতো আয় তাদের নেই। তারা আগে এক ঘণ্টায় যা খাটতো এখন সেই এক ঘণ্টাতেই সে অনেকগুণ বেশি খাটে। খুব কষ্ট করেও তারা বাঁচে একটা আশা নিয়ে। হয়তো, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে। তখন আর এ অবস্থা থাকবে না। কিন্তু শিক্ষার ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, সেই সুযোগটাও একেবারেই সঙ্কুচিত। ফলে শ্রমিকের ঘর থেকে নতুন শ্রমিক বের হচ্ছে। এক বৃত্তে আটকা পড়ে থাকছে তারা। সরকার এটাকে উন্নয়ন বলতে পারে, কারণ তাদের ভোট দরকার, যে কোনোভাবে ক্ষমতায় থাকা দরকার। কিন্তু আমি এটাকে কোনোভাবেই উন্নয়ন বলতে পারি না। উন্নয়ন মানে হচ্ছে নাগরিকের জীবন মান উন্নয়ন, তার নিরাপদ জীবন যাপনের ব্যবস্থা এবং ক্রমশ সচ্ছলতা বৃদ্ধি। তা এখানে গুটি কয়েকের হচ্ছে ঠিকই। সরকার হয়তো তাদেরই শুধু নাগরিক ভাবে।
সাপ্তাহিক: তেল গ্যাস খনিজসম্পদ বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে জানতে চাচ্ছি, আপনাদের কার্যক্রমে এখন ভাটা পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। এর কারণ কী?
আনু মুহাম্মদ: আমাদের সর্বশেষ বড় কর্মসূচি ছিল ঢাকা-সুন্দরবন লংমার্চ। তার পরই নির্বাচনকেন্দ্রিক দেশে একটা অরাজকতা শুরু হয়। জ্বালাও পোড়াও, অবরোধ, হরতাল, খুন খারাবি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। তার মধ্যে কোনো কর্মসূচি করাটা ছিল অসম্ভব। তখন আমরা ঘরোয়াভাবে কিছু কর্মসূচি পালন করি। মাঝে মধ্যে মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত বড় কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারিনি কারণ আমাদের শরিক দলগুলোর ব্যস্ততা। এই সময়টাতে তাদের প্রত্যেক দলেরই নিজস্ব একক কর্মসূচি ছিল অনেকগুলো। তিস্তা নদী রক্ষার আন্দোলনে সকলেই যে যার মতো করে কর্মসূচি পালন করেছে। ফলে আমরা কর্মসূচিতে যেতে পারিনি।
এই সময়ে আমরা মহেশখালী, ফুলবাড়ী, রামপালে তথ্যানুসন্ধান, প্রচারণা, লেখা, প্রকাশনা ও মতবিনিময়ের কাজ অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু বড় কর্মসূচিতে আমরা যেতে পারিনি। এর মধ্যে সরকার তার কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। রামপালে কাজ অগ্রসর হচ্ছে। সমুদ্রের বাইরে স্থলভাগের গ্যাসব্লক বরাদ্দ দেয়ার পাঁয়তারা করছে। রূপপুরে পারমাণবিক প্রকল্পের কাজ এগুচ্ছে। ওরিয়ন গ্রুপ আরেকটি প্রকল্প নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর বিদ্যুৎ কেন্দ্র করতে গেছে। তাদের সঙ্গী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। রামপালের প্রকল্পে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এখন চাইনিজদের নামও আসছে। পিএসসি সংশোধন করে বাড়তি সুবিধা দিয়ে সাগরে ভারতীয় কোম্পানি ও এনজিসিকে কাজ দেয়া হয়েছে।
কিছুদিন আগে গ্যাস উত্তোলক প্রতিষ্ঠানগুলো আরও সুযোগ সুবিধা দাবি করেছে। সেগুলো দেয়ার জন্য সরকার তো খাড়াই থাকে। এর সঙ্গে আছে রেন্টাল, কুইক রেন্টালের অব্যাহত লুটপাট। শেভরন অতি উৎপাদন করে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রকে সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার নানাভাবে শেভরনের কর্তৃত্ব বাড়ানোর কাজে সহযোগিতা করছে। অর্থাৎ বিদেশি কোম্পানিগুলোর আগ্রাসন বাড়ছে। সরকার তাদের দাবি পূরণ করছে উৎসাহের সঙ্গে। এখানে কমিশন ছাড়া আর কিছুই নেই। একদিকে তারা কমিশন খাচ্ছে। অন্যদিকে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে মার্কিন, ইইউ, চীন, ভারত, রাশিয়া, সবাইকেই সন্তুষ্ট করার জন্য যে যা চাচ্ছে তাকে তাই দেয়া হচ্ছে।
আমরা এর মধ্যে বড় কর্মসূচিতে যেতে না পারলেও কিছু প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। আলোচনা সভা, বিবৃতি, সমাবেশ, মিছিল অনেকগুলোই হয়েছে। শরিক দলগুলোর এই মহা ব্যস্ততার মধ্যেই এর মধ্যে আমরা সভা করেছি এবং বড় করে কিছু কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। রামপালে যে কোনো ধরনের প্রকল্পই আমাদের থামাতে হবে। তা ওরিয়ন হোক আর এনটিপিসি হোক। এর যে কোনো একটাই যথেষ্ট বন ধ্বংসের জন্য। বিষয়টা এখন এমন হয়েছে যে, একটা গরুর আগাম মৃত্যুর খবর যদি কোনো শকুনদলের কাছে পৌঁছায় তাহলে তারা যেভাবে দলে দলে উড়ে আসে, ঠিক তেমনই। সুন্দরবন ধ্বংস হবে বুঝতে পেরে সেখানে এখন সবাই ছুটে যাচ্ছে। যার যার ভাগটা বুঝে নেয়ার জন্য। বনের আশেপাশে এখন ভূমিদস্যুরা খুঁটি গাড়ছে। তারা জমি কিনছে, দখল করছে। সরকারি দলের লোকেরা অধিগ্রহণ করা জমিতে ঘের করছে। এদের সবাইকে প্রতিরোধ করতে হবে। সেজন্য এখন দুর্বার গণআন্দোলন দরকার।
আমরা ইতোমধ্যে খুলনায় কিছু ঝটিকা সফর ও মতবিনিময় সভা করেছি। আগামী ২ জুন খুলনায় অবস্থান কর্মসূচি, ৪ জুন বাগেরহাটে অবস্থান কর্মসূচি হবে। এর মধ্যে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও প্রচারমূলক গ্রুপ ওইসব এলাকায় সমন্বিত কর্মকাণ্ড চালাবে। এর মধ্যে ছোট ছোট কিছু মার্চ হবে। আরও কর্মসূচি যোগ হবে। তারপর অক্টোবরে আমরা আরও বৃহত্তর আকারে, আরও বিরাট শক্তি নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি লং মার্চ করবো। তারপরও যদি তারা না থামে, তাহলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ওই অঞ্চল অবরোধ করা হবে। এর পাশাপাশি রূপপুর ও মহেশখালী নিয়েও আমরা আমাদের প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সাপ্তাহিক: এই যে এতগুলো দিন গেল, কর্মী-সমর্থকরা তো দেখছে, দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে, কমিটির তেমন কোনো নড়াচড়া নেই। তারা কি হতাশ হচ্ছে না?
আনু মুহাম্মদ: হতাশ হলে তো হবে না। যদি তারা মনে করে, কমিটি ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না, তাহলে তাদের উচিত কমিটিকে চাপ দেয়া। কমিটিকে পরামর্শ দেয়া। তাদের চাপটা বাড়লে কমিটির জবাবদিহিতা বাড়ে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের সকলেরই গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়। আমাদের প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। একে অপরকে দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। কমিটির মধ্যে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন, পাঠচক্র গ্রুপ, সাহিত্য সংগঠন থেকে নানা ধরনের সংগঠন আছে। তাদের উচিত নিজেদের কাজগুলো জারি রাখা। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বাড়ানো। এগুলো করতে পারলেই আমরা লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৃঢ়তা অর্জন করতে পারব।