মোদি সরকার: কেমন হবে বাংলাদেশ নীতি
ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসের অন্যতম বড় বিজয় এসেছে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি)। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ৩০ বছর পর ভারত কোনো একটি দলকে এরকম গরিষ্ঠভাবে বিজয়ী দেখল। অন্যদিকে, কংগ্রেস ছাড়া প্রথম দল হিসেবে বিজেপির সর্বভারতীয় উত্থান ঘটল। কংগ্রেস হেঁটেছে গান্ধী পরিবারের হাত ধরে, সেই পরিবারতন্ত্রের দুর্গ তছনছ হলো ব্যক্তি মোদির উত্থানে। ৫ বছর ধরে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত কথিত প্রগতিশীল মোর্চা ভারতের শাসনে যে দুর্বলতা, স্থবিরতা, নীতি-পঙ্গুত্ব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নরমনীতি নিয়ে দেশ চালিয়েছে, তা পছন্দ করেনি ভারতের জনগণ। তারা চেয়েছে একটি শক্তিশালী সরকার। ড. মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চেয়ে থেকেছেন সোনিয়া গান্ধী-রাহুল গান্ধীর দিকে, জনগণ তা ভালোভাবে নেয়নি। নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্য জনসভায় বলেছেন, ‘আপনারা কি উন্নয়নের গুজরাট মডেল দেখতে চান, না কংগ্রেসের আরএসভিপি (রাহুল-সোনিয়া-ভদ্র-প্রিয়াংকা) মডেল দেখতে চান?’ জনগণ ব্যালটে কংগ্রেসের আরএসভিপি মডেল প্রত্যাখ্যান করে উন্নয়নের গুজরাট মডেলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন চালাবেন নরেন্দ্র মোদি? যে রাজপরিবারের হাতে দীর্ঘদিন শাসিত হয়েছে ভারত, সেই জায়গায় চা-ওয়ালা বাবা, বাসনমাজা-মা’র সন্তান, কেটলি হাতে রেলস্টেশনে চা বিক্রি করা নরেন্দ্র মোদি কতটা জনবান্ধব, উন্নয়নমুখী শাসন উপহার দেবেন ভারতকে? প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির নীতি কী হবে? পরাশক্তিগুলোর সঙ্গে কীভাবে ডিল করবেন মোদি? সাম্প্রদায়িক সংঘাত কি বাড়বে ভারতে? নাকি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথিত ‘গুজরাট-মডেল’ চালু হবে ভারতব্যাপী? এত নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জনপ্রত্যাশার চাপ কি সইতে পারবে বিজেপি? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখা যাক এবারের নির্বাচন, নির্বাচনী ফলাফলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো কী।
এক. প্রায় ৮১ কোটি ভোটার ছিল এই নির্বাচনে। পূর্ববর্তী নির্বাচনের চাইতে ভোটার বেড়েছে ১০ কোটি। ভোট পড়েছে শতকরা ৬৬ ভাগের বেশি। অর্থাৎ প্রতি ৩ জন ভোটারের দুইজন ভোট দিয়েছেন। শহরগুলোতে ভোট পড়েছে ব্যাপকভাবে।
দুই. নির্বাচনে বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ২৮৩টি আসন। দল হিসেবে বিজেপি ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় ১৬৭টি আসন বেশি পেয়েছে। অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছে ৩৩৭টি আসন। গতবারের নির্বাচনের তুলনায় এই জোটের আসন বেড়েছে ১৯৬টি। সব রকম নির্বাচনী ফলাফলের পূর্বাভাসের চাইতেও বেশি আসন পেয়েছে বিজেপি।
তিন. বিজেপির এনডিএ (ন্যাশনাল ডেমোক্রেটি অ্যালায়েন্স) জোট ভোট পেয়েছে ১৭ কোটি ১৬ লাখ ৫৭ হাজার ৫৪৯। ২০০৯ সালে এই ভোট ছিল ৭ কোটি ৮৪ লাখ ৩৫ হাজার ৩৮১।
শতকরা হারে ২০০৯ সালে বিজেপি জোটের ভোট ছিল ২৪.৬৩%, যা এবার বেড়ে হয়েছে ৩৮.৯%। ২০০৯ সালের তুলনায় বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোটের ভোট বেড়েছে ১৪.২৭%।
চার. নির্বাচনে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ (ইউনাইটেড প্রগেসিভ অ্যালায়েন্স) জোট পেয়েছে ৫৯টি আসন। ২০০৯ সালের নির্বাচনের তুলনায় ১৭৫টি আসন কম পেয়েছে। ২০০৯ সালের নির্বাচনের কংগ্রেস দলের আসন ছিল ২০৬।
এবার কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ৪৪টি আসন। দল হিসেবে কংগ্রেস গতবারের তুলনায় কম পেয়েছে ১৬২টি আসন।
পাঁচ. কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট এবার ভোট পেয়েছে মাত্র ১০ কোটি ৬৯ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২।
শতকরা হারে যা ১৯.৪ ভাগ। ২০০৯ সালের নির্বাচনে তাদের ভোট ছিল ১১ কোটি ৯১ লাখ ১১ হাজার ১৯। ২০০৯ সালে প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ছিল ৩৭.২২।
কংগ্রেস জোটের ভোট কমেছে ১৭.৮২%।
ছয়. ভোটের ফলাফল খুব সুস্পষ্ট। বিজেপি জোটের ভোট বেড়েছে ১৪.২৭%।
কংগ্রেস জোটের ভোট কমেছে ১৭.৮২%।
সাত. ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বেশিসংখ্যক আসন আছে যে ক’টি রাজ্যে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উত্তর প্রদেশ। সেখানে ৮০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৭১টি। উত্তর প্রদেশের বারানসি থেকে নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি পেয়েছেন ৫ লাখ ৮১ হাজার ২২ ভোট। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আমআদমি পার্টির অরবিন্দ কেজরিওয়াল পেয়েছেন ২ লাখ ৯ হাজার ২৩৮ ভোট, কংগ্রেসের প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ৭৫ হাজার ৬১৪ ভোট। উত্তর প্রদেশের আমেথি আসনে রাহুল গান্ধী অতীতে কয়েক লাখ ভোটের ব্যবধানে জিততেন। এবার সেখানে রাহুল গান্ধী পেয়েছেন ৪ লাখ ৮ হাজার ৬৫১ ভোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির স্মৃতি ইরানি পেয়েছেন ৩ লাখ ৭শ ৪৮ ভোট।
আট. এবারের নির্বাচনে খুব উল্লেখযোগ্য দুটি দিক হচ্ছে নতুন তরুণ ভোটাররা আকৃষ্ট হয়েছে নেতা নরেন্দ্র মোদির দিকে। সংখ্যালঘু মুসলমানরা কংগ্রেসের একক ভোট ব্যাংক হিসেবে হাজির হননি। যেখানে যে দল বা প্রার্থীকে ভোট দিলে তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে বলে ভেবেছেন, সেখানে সেভাবেই ভোট দিয়েছেন সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটাররা।
নয়. ভারতের নির্বাচনে সর্বভারতীয় দল হিসেবে বিজেপির উত্থান ঘটেছে। আঞ্চলিক দলনেতা বিশেষত জয়ললিতা, মমতা ব্যানার্জি নিজ রাজ্যে ভালো করলেও সর্বভারতে তাদের উত্থানের সকল সম্ভাবনা ভোটাররা বাতিল করেছেন।
দশ. ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসের দুর্নীতিপ্রীতি শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লিতে উত্থান ঘটেছিল আমআদমি পার্টির। আমআদমি দল হিসেবে সর্বভারতে কোনো জায়গা করতে না পারলেও ঘটনা হিসেবে, পরিবর্তনের অনুঘটক হিসেবে ভারতীয় রাজনীতিতে সাড়া ফেলে। দিল্লির বিধানসভায় কংগ্রেসের ১৫ বছরের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে বসে সরকার গঠন করে আমআদমি। এবারও লোকসভা নির্বাচনে রাজধানী দিল্লিতে বিজেপি পেয়েছে ৪৬.৪% ভোট, আমআদমি পেয়েছে ৩২.৯%, কংগ্রেস পেয়েছে মাত্র ১৫.১% ভোট। কংগ্রেসের সার্বিক পরাজয়ের সূচনা রাজধানী দিল্লি থেকে আমআদমির হাতেই ঘটে।
২.
এখন প্রশ্ন, নরেন্দ্র মোদি সিংহাসনে বসার পর ভারতের শাসন নীতিতে কী ঘটতে পারে?
এক. নরেন্দ্র মোদি যেহেতু একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তিন দশক রাজ্য শাসনের অভিজ্ঞতা তার আছে। রাজ্য এবং কেন্দ্রের শাসনের মধ্যে যে সমন্বয় ও সংঘাত গোটা দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে, মোদির সরকার সে বিষয়ে বড় পরিবর্তন আনবে। ইতোমধ্যে নরেন্দ্র মোদি একটি শক্তিশালী ফেডারেল রাজ্য গঠনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।
সাধারণত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ডাকা হয় না। নরেন্দ্র মোদি সেই রীতি ভাঙতে পারেন। কেন্দ্রের কোনো নীতি যদি রাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়, মোদি মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে সেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে হাজির করে তার মতামত শুনতে চাইবেন বলে শোনা যাচ্ছে। মোদির এই দৃষ্টিভঙ্গি কার্যে পরিণত হলে ভারতে কেন্দ্রের সরকার বনাম রাজ্যের সরকারের লড়াইয়ে সুশাসন বা উন্নয়ন যেভাবে ব্যাহত হতো, সেখানে একটা বড় গুণগত পরিবর্তন আসতে পারে।
দুই. ভারতে কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র সরকারের নীতিনির্ধারণে বড় প্রভাব ফেলেছে সব সময়। এবার তার ব্যত্যয় ঘটবে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে গঠিত সরকার যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং গুজরাটে মোদি যেভাবে আমলাতন্ত্রের ওপরে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, কেন্দ্রে সেই মডেলের উপস্থিতি দেখা যেতে পারে। ভারতে এবার আমলাতন্ত্রের বদলে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সরকারের শাসন দেখা যেতে পারে।
তিন. ভারতের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে এরকম নীতির উল্লম্ফন ঘটবে। বিদেশি বিনিয়োগের প্রাবল্য দেখা দেবে। নরেন্দ্র মোদি প্রথম দু’বছর ভারতের বাজারকে বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগের জন্য সহায়ক করে তুলবেন। তবে, মনমোহন ডকট্রিনের সময় যেভাবে বিদেশি বিনিয়োগ নীতি নেয়া হয়েছিল, তার পরিবর্তন ঘটবে। ভারতে চীন, জাপান, লাতিন আমেরিকার বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বাজারে একক আধিপত্য করার মালিকানার নীতিতে মনমোহন সিং যেভাবে খুচরা বাজারকে বিদেশিদের হাতে তুলে দিতে চেয়েছিলেন, নরেন্দ্র মোদি তা করবেন না। সেখানে ভারতের হিস্যা সুপ্রতিষ্ঠিত করবেন।
চার. মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে। নীতিভঙ্গুরতা বা সিদ্ধান্তহীনতার কারণে আন্তঃদেশীয় বাণিজ্যের সঙ্কট কাটবে। করপোরেট পুঁজি যেভাবে নরেন্দ্র মোদির পেছনে দাঁড়িয়েছে ভোটের আগে, ভোটের পরে মোদি করপোরেট পুঁজি বিকাশের সুযোগ দেবেন। গুজরাট সর্বক্ষেত্রে পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) মডেল সাফল্য পেয়েছে। এবার ভারতব্যাপী তার বিস্তৃতি ঘটতে পারে।
পাঁচ. আফ্রিকায় ভারতের বাণিজ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্র সহায়কনীতি নিয়ে দাঁড়াবে। মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ানোর নীতি নেবেন মোদি। প্রথম দু’বছর ব্যবসা-বাণিজ্য সহায়ক সরকার দেখা গেলেও তৃতীয় বছর থেকে সামরিক খাতে নরেন্দ্র মোদির আগ্রহ পরিলক্ষিত হবে। ভারতে সামরিক বাজেট বাড়তে থাকবে।
ছয়. নরেন্দ্র মোদির প্রথম কাজ হবে তার সাম্প্রদায়িক চেহারাটা উন্নয়নের পাখা দিয়ে ঢেকে ফেলা। ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অনুঘটকরা যেহেতু বিজেপি, আরএসএস-এর মধ্যেই বেড়ে উঠেছে, সেহেতু নরেন্দ্র মোদির শাসনকে নির্বিঘœ রাখতে তারা সচেষ্ট থাকবে। মুসলমানদের মনের ভয় তাড়াতে সচেষ্ট থাকবেন মোদি। তবে, হিন্দু জাতীয়তাবাদের পতাকা উড্ডীন রাখবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন অক্ষুণœ রাখতে।
৩.
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন কী ঘটবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে কতগুলো বিষয়ে মনোযোগ দেয়া খুব জরুরি।
এক. ভারতকে আমরা যে সমীহের চোখে দেখি, ভারত আমাদের সেই চোখে দেখে না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের দুর্বলতা আরও বাড়িয়েছে বাংলাদেশের আওয়ামী সরকার। যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে ভোটারবিহীন নির্বাচন করতে কংগ্রেসের যে আনুকূল্য শেখ হাসিনা পেয়েছেন, তার বিনিময়ে যেভাবে ভারতকে উজাড় করে ট্রানজিট-নিরাপত্তার সুযোগ দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন, সেই দুর্বলতা আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
দুই. অন্যদিকে ক্ষমতায় যাবার জন্য ভারতকে আপন করে পেতে চাইছে বিএনপি-জামায়াত জোট। যে কোনো শর্তে ক্ষমতায় যেতে ভারতকে পাশে পেতে চাইবে তারা। আওয়ামী লীগ-বিএনপির এই ক্ষমতার জন্য ভারত তোষণনীতিকে ভারতীয় আমলাতন্ত্র সুযোগ হিসেবে অতীতে নিয়েছে, ভবিষ্যতেও নেবে।
তিন. ভারতের ক্ষমতাকেন্দ্রে বসবাস করা মানুষদের সঙ্গে বাংলাদেশের চেনা-জানা অনেক কমেছে। বাংলাদেশবান্ধব কমিউনিস্ট নেতারা সেখানে জনগণের ম্যান্ডেট পাননি। যে গান্ধী পরিবারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য ছিল, সেই গান্ধী পরিবার এখন ক্ষমতা হারিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাঙালি মমতা ব্যানার্জিকে আমরা মিত্র হিসেবে হারিয়েছি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে তিস্তার পানি না পাওয়ার জন্য প্রকাশ্যে মমতা ব্যানার্জিকে দায়ী করে বক্তব্য রেখেছেন। সুতরাং গোটা ভারতবর্ষে ক্ষমতাবান সার্কেলে বাংলাদেশের স্বজন, বন্ধু, চেনাজানা মানুষের সংখ্যা এখন নেই বললেই চলে। সুতরাং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন চলবে পূর্ণভাবে কূটনৈতিক চ্যানেলে। বড় রাষ্ট্র বনাম প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক চ্যানেলেই চলবে দেয়া-নেয়ার পালা। এক্ষেত্রে আমরা কতটা সক্ষমতার পরিচয় দেই, কতটা যোগ্যতার সঙ্গে বিষয়টা এগিয়ে নিতে পারি, সেটাই এখন একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।
এই সূত্রগুলো মাথায় রেখে কতগুলো শঙ্কা এবং সম্ভাবনা আমরা সামনে দেখতে পাই।
এক. তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন বিষয়ে আমরা অগ্রগতি চাই। তিস্তা চুক্তির বিষয়ে মমতা ব্যানার্জিকে অধিকতর গুরুত্ব দেবেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি-মমতা ব্যানার্জি বাহাস থাকলেও নরেন্দ্র মোদির কাছে অগ্রাধিকার পাবে মমতা ব্যানার্জি ও পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৯% ভোট পেয়েছে বিজেপি। সেখানে বামপন্থিদের অবস্থা প্রায় নিভু নিভু। এ সুযোগটা নেবে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সংগঠনকে আরও সংগঠিত করতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মন জয় করতে চাইবেন নরেন্দ্র মোদি।
সুতরাং তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়ে শেখ হাসিনার সরকার বড় কোনো সাফল্য পাবে বলে মনে হয় না।
দুই. সীমান্তে হত্যা আগের চেয়ে কমবে। নরেন্দ্র মোদির একক কমান্ড এক্ষেত্রে সুফল দেবে। ভারতের স্বার্থের প্রতিকূল চোরাচালানি কমবে।
তিন. বাংলাদেশ থেকে ভারতে যেসব বাঙালি মুসলমান গেছেন, তাদের নিয়ে আসাম-ত্রিপুরায় যে অস্থিরতা চলছে তা আরও বাড়বে। কূটনৈতিকভাবে নরেন্দ্র মোদির সরকার এ বিষয়টি ফয়সালা করতে চাইবে। ভারতে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের একটা বড় অংশকে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। তাদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে চাপ তৈরি হতে পারে। কূটনৈতিকভাবে এটি বাংলাদেশের সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তথ্য, উপাত্ত, যুক্তির সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে ফয়সালা করতে না পারলে বাংলাদেশের ওপর নতুন চাপ তৈরি হবে।
আসামের নির্বাচনে ১৪টি লোকসভা আসনে বিজেপি পেয়েছে ৭টি আসন। প্রাপ্ত ভোট ৩৬.৫%।
কংগ্রেস পেয়েছে ৩টি আসন, ২৯.৬% ভোট। এখানে ভোট বাড়াতে বাঙালি মুসলমান বিতাড়ন ইস্যুকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে বারবার ব্যবহার করবে বিজেপি।
চার. বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চিহ্নিতকরণ সমস্যা সমাধানে এবং ছিটমহল হস্তান্তরে বিজেপির অতীত নীতি অক্ষুণ্ন থাকবে। ফলে, বাংলাদেশকে কম জমি দিয়ে বেশি জায়গা নেয়ার চেষ্টা চালাবে ভারত সরকার। ছিটমহল বিনিময়ের সুরাহা করতে নতুন শর্তে ভারত চাপ দেবে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সরকার কতটা শক্তির সঙ্গে তা মোকাবেলা করতে পারবে সেটা বিবেচ্য।
পাঁচ. মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে কর্মসংস্থানের জন্য আগ্রাসী নীতি নেবে নরেন্দ্র মোদির সরকার। সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান, কুয়েত, কাতার, লিবিয়া সর্বত্র ভারতীয় নাগরিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। উভয়পক্ষের ব্যবসা-বাণিজ্যের নয়ানীতিতে ভারতের জন্য এই সুযোগ যত বাড়বে তত কপাল পুড়বে বাংলাদেশের। শেখ হাসিনার সরকার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক যে জায়গায় নিয়েছেন তার পরিবর্তন না ঘটলে এক্ষেত্রে বড় সুযোগ নেবে মোদি সরকার। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
ছয়. পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সুসম্পর্ক বাড়বে। উভয়ের স্বার্থ বিবেচনায় আমেরিকার এশিয়ানীতি এগিয়ে থাকবে। নরেন্দ্র মোদির লক্ষ্য থাকবে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়ে ভারতের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক তাৎপর্য বাড়ানো। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুষ্ঠু নির্বাচন, ন্যায্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাম-ডান মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ রুখতে আমেরিকার বিদেশনীতির সঙ্গেই হাত মেলাবে মোদি সরকার।