অস্তিত্ব সংকটে ঝিনাইগাতীর বেদে সম্প্রদায়
মোহাম্ম দুদু মল্লিক, ঝিনাইগাতী (শেরপুর) থেকে:শেরপুরের সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী উপজেলার ডেফলাই গ্রামের বেদে সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব বিলীন হতে চলছে। এ বেদেপল্লীতে ৭০টি পরিবারের প্রায় ৭শ’ বেদে’র বসবাস। ২০১০ সালে এ সম্প্রদায়ের লোকজন ১/২শতাংশ জমি ক্রয় করে বস্তি স্থাপন করে। এদের আদিবাস ঢাকার সাভারে। এরা প্রথমে ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের পানবর গরুচরন দুধনই গ্রামে বস্তি স্থাপন করে বসবাস করে আসছিল। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা, বন্যহাতির তান্ডব, চুরের উপদ্রব এবং এলাকাবাসীর অসহযোগীতার কারনে টিকতে না পেরে সেখান থেকে চলে এসে নলকুড়া ইউনিয়নের ডেফলাই গ্রামে বস্তি স্থাপন করে। তাদের আদিপেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে এসব বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন। বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের অভাব অনটন দুঃখ আর দুর্দশা যেন তাদের নিত্য সাথী। অতীতে এ পেশার উপর নির্ভর করে সাচ্ছন্দ্যে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করত। সমাজেও তারা এত অবহেলার পাত্র ছিল না। একসময় তারা নৌকাযোগে সারা দেশের নদ-নদী গুলোতে অবস্থান করত। কিন্তু জলবায়ূ পরিবর্তনের প্রভাবে নদ-নদী গুলো ঐতিহ্য হারানোর কারনে তারা এখন ডাঙ্গায় বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া বর্তমান ডিজিটাল যুগে আধুনিকতার ছোয়ায় তারা এ পেশা ধরে রাখতে পারছে না। ঝার ফুক সিঙ্গা ও তাবিজ-কবজের প্রতি মানুষের এখন আর আগের মত আস্থা নেই। তবুও জীবিকার তাগিদে এ পেশা ধরে রাখতে বাধ্য হচ্ছে এরা। বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে তাদের এসব দুঃখ দুর্দশার কথা জানা গেছে। বেদে সর্দার মোছন আলী জানান, এখানে তাদের লোকজন অতিকষ্টে জীবন-যাপন করছেন। ৭০টি পরিবারের মধ্যে অনেকেই ১/২ শতাংশ জমি ক্রয় করলেও অর্থের অভাবে বাসস্থান তৈরী করতে পারছে না। অনেক পরিবার তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে পেটভরে দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে পারে না। তিনি আরো জানান, এখানে স্থানীয় লোকজনের সহযোগীতা পাচ্ছেন। বেদেপল্লীর লোকজন জানান, তাদের যাতায়াতের কোন রাস্তা নেই। পল্লীর মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি ঝর্ণা। এ ঝর্ণা বেদেপল্লীকে দুভাগে বিভক্ত করে রেখেছে। এখানে একটি ব্রীজের দরকার। এ ব্রীজের অভাবে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করার জন্য নেই কোন স্কুল মাদ্রাসা। পাশের গ্রামে খ্রীষ্টান মিশনারী স্কুলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের পড়তে যেতে হয়। বর্ষা মৌসুমে কাদা মাড়িয়ে কোমলমতি ছেলেমেয়েদের স্কুলে যেতে চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। এ বেদেপল্লীতে রয়েছে বিশুদ্ধা খাবার পানির তীব্র সংকট। তাদের অভিযোগ বেদে সম্প্রদায় হওয়ার কারনে এরা পায় না কোন সরকারী সাহায্য সহযোগীতা। যেমন, ভিজিডি, ভিজিএফ, বয়স্কভাতা ও বিধবাভাতাসহ সরকারী কোন অনুদান। শিক্ষার অভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে নেই তাদের কোন ধারনা। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি পরিবারের ৫ থেকে ১২জন পর্যন্ত সন্তান। এটিও অভাবের অন্যতম একটি কারন। অর্থ সংকটের কারনে তারা কোন পেশা বেছে নিতে পারছে না। তাই জীবিকার প্রয়োজনে বছরের বেশি সময় থাকতে হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। বাড়ীতে থাকে বৃদ্ধ ও ছোটরা। পুরুষ বেদেরা বিভিন্ন গ্রাম ও বনজঙ্গলে সাপ ধরে ও হাটবাজারে সাপ খেলা দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে। সাপে কাটা রোগীদের ঝাড়, ফুক দেয়। পুকুর বা নদীতে স্বর্ণালংকার হারিয়ে গেলে তা উদ্ধার করে অর্থপার্জন করে। মহিলা বেদেনীরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে কোমর বা হাটুতে সিঙ্গা লাগিয়ে বিষব্যথা নিবারন এবং বিভিন্ন রোগের তাবিজ-কবজ বিক্রিসহ ঝাড়, ফুক দিয়ে অর্থপার্জন করে। এতে তাদের প্রতিদিন ১শ’ থেকে দেড়শ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। কোন কোন দিন শূণ্য হাতে বাড়ী ফিরতে হয় তাদের। বর্তমানে এসব বেদে সম্প্রদায়ের লোকদের অস্তিত্ব চরমভাবে বিলীন হতে চলেছে।