পার্বত্য চট্টগ্রাম দখলে নেয়ার প্রত্যয়
নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে সতর্ক বিজিবি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর মর্টার শেলে মিয়ানমারের কমপক্ষে ৪ সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন তিনজন। ৩০শে মে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির সময় বিজিবি ওই মর্টার ছোড়ে। ওদিকে, বাংলাদেশের মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে বার্মিজ ইউনাইটেড আর্মড ইউনিট (বিইউএইউ)।
তারা টেকনাফ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত দখলে নিতে বদ্ধপরিকর। বাংলাদেশের দৈনিক পত্রিকা মানবজমিন এ সংবাদ প্রকাশ করেছে।
এতে বলা হয়, ইয়াঙ্গনের এক মেজর বলেছেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে পশ্চিম গেটে বাংলাদেশীদের গতিবিধি লক্ষ্য করছে সে দেশের সেনারা। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ পেট্রল টিম (বিজিবিপিটি) সামনে অগ্রসর হলে তার কড়া জবাব দিতে প্রস্তুত বিইউএইউ। এতে আরও বলা হয়, মিয়ানমারের সেনাদের তুলনায় বাংলাদেশে রয়েছে এক-চতুর্থাংশ সেনা সদস্য। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কোন ব্যবস্থা নিলে মিয়ানমারের ‘তাতমাড’ (সেনারা) টেকনাফ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত তাদের দখলে নিতে বদ্ধপরিকর। নেপিড’র সূত্রমতে, বার্মিজ ইউনাইটেড আর্মড ইউনিটে রয়েছে আধাসামরিক বাহিনী, পুলিশ, বর্ডার গার্ড, নৌবাহিনী, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগ। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশী বিজিবির অগ্রগমন প্রতিরোধের জন্য মিয়ানমারের পশ্চিম গেট এলাকায় টহল দিচ্ছে। এ ঘটনায় পশ্চিমগেট (মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত) এলাকায় বসবাসকারী রোহিঙ্গারা ভয়াবহ এক পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। তাদের মিয়ানমারের বিইউএইউ-এর ভারি জিনিসপত্র বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা অধিবাসীরা আতঙ্কে রয়েছেন যে, তাদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার করতে পারে বিইউএইউ। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে বিইউএইউ-এর জন্য নির্ধারিত পোশাক পরিয়ে পশ্চিমগেটে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। বার্মিজ বর্ডার পুলিশ যে সব স্থানে তাদের তাঁবু পেতেছে ভয়ে সে সব স্থানের মানুষ পাহাড়ি জঙ্গল থেকে ফিরে আসছেন না। ওদিকে একই ওয়েবসাইট আরেক রিপোর্টে বলেছে, গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলেছে, বিজিবির মর্টারশেলের আঘাতে মিয়ানমারের কমপক্ষে ৪ সেনাসদস্য নিহত হয়েছে। সূত্র বলেছে, যখন বিজিবি নিহত নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানের মৃতদেহ গত বুধবার আনার চেষ্টা করে তখন মিয়ানমারের বাহিনী তাদের ওপর প্রকাশ্যে তিন দিক থেকে গুলি করে বর্ডার পিলার ৫২ এলাকায়। ওই সময় বিজিবি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ আহমেদ আলী, আঞ্চলিক কমান্ডার (চট্টগ্রাম)। তার সঙ্গে ছিলেন বিজিবির অন্য সিনিয়র কর্মকর্তা। এর মধ্যে ছিলেন কর্নেল ফরিদ হাসান খন্দকার, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শফিকুর রহমান। মিয়ানমারের আক্রমণের জবাবে বিজিবি পাল্টা হামলা চালায়। এতে পাঁচ ঘণ্টা লড়াই চলে। দু’পক্ষই ব্যবহার করে মর্টার, রকেট লঞ্চার ও ভারি মেশিন গান।
সীমান্তে উত্তেজনা কমেনি
রাসেল চৌধুরী, কক্সবাজার থেকে জানান, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে উত্তেজনা কমেনি। সীমান্ত এলাকায় অবস্থানরত গ্রামবাসীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখনও তাদের বাড়িতে ফেরেনি। এদিকে উত্তেজনার মুখে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের শক্তি বাড়ানোর খবরে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। স্থলসীমান্তে শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশী জলসীমার কাছাকাছি সাগরে তিনটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের খবরে সীমান্তের এপারে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। তবে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েনের খবর সত্য নয় বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার ১৭ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম। তিনি বলেন, এটি মিডিয়ার প্রচার। এ ধরনের কোন তথ্য তার জানা নেই। তবে এ ঘটনার পর থেকে সীমান্তে বিজিবি’র টহল জোরদার করা হয়েছে। চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রুমা, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন থেকে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য সীমান্তের বিওপিগুলোতে মোতায়েন করা হয়েছে।
সীমান্তের লোকজন জানিয়েছেন, গত রোববার লাশ হস্তান্তরের আগে ও পরে ৫২ নম্বর পিলারের কাছে শক্তি বৃদ্ধি করে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা। পাশাপাশি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে ওই এলাকাসহ পুরো সীমান্তে। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাভাবিক তৎপরতায় সীমাবদ্ধ রেখেছে সীমান্ত পাহারার ব্যবস্থা।
বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটি বিশেষ সূত্র জানিয়েছে, বঙ্গোপসাগরে মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের তিনটি যুদ্ধজাহাজ টহল দেয়ার খবর তারা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী এ ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের জলসীমায় নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের নিয়মিত টহল আরও জোরদার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লে. কাজী হারুন-উর রশিদ বলেন, মিয়ানমারের জলসীমায় তাদের নৌবাহিনীর তিনটি জাহাজ টহল দিচ্ছে বলে আমরা শুনেছি। তবে এর সত্যতা পাইনি। এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। তিনি বলেন, টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে যাত্রীবাহী জাহাজ ও ট্রলারগুলোকে কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর নির্দেশনা মেনে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
এদিকে নিহত বিজিবি’র সদস্য নায়েক মিজানুর রহমানের প্রথম জানাজা নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ন জোন সদর মাঠে গতকাল সোমবার সকাল ৯টায় হয়েছে। এরপর সকাল ১১টায় নাইক্ষ্যংছড়ি ৩১ বিজিবি থেকে হেলিকপ্টারযোগে কুমিল্লার দেবিদ্বারের বেলা নগর ঈদগা ময়দানে দ্বিতীয় দফা জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নির্ধারিত সময়ে দ্বিতীয় দফা জানাজা হয়।
হেলিকপ্টারে মিজানের লাশের সঙ্গে তার সহকর্মী ৩১ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের সুবেদার আবদুর রহমান ও মিজানের দুই শ্যালক জালাল হোসেন এবং মোবারক হোসেন ছিলেন।
বিজিবি’র কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খন্দকার ফরিদ হাসান জানিয়েছেন, ওই দিন দুপুর ২টায় জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মিজানুরের লাশ দাফন করা হয়। নাইক্ষ্যংছড়ি জোন সদরে মিজানের প্রথম জানাজায় সেনাবাহিনী, বিজিবি ও প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
মিজানের সহযোদ্ধারা জানিয়েছেন, পিতার মতোই অতি সাহসী ছিলেন নায়েক মিজান। অসময়ে সীমান্তের এ অতন্দ্র প্রহরীর চলে যাওয়া কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। বীরত্বের সঙ্গে চলে যাওয়া মিজান স্বর্ণাক্ষরে স্মরণীয় এবং ইতিহাস হয়ে রবে।
বিজিবি সদস্য মিজানের লাশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন
মো. রফিকুল ইসলাম রাজু, দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি জানান, বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)-এর সদস্যদের গুলিতে নিহত বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের (বিজিবি) নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সোমবার দুপুর আড়াইটায় নিজ গ্রাম কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার বেলানগর গ্রামের ঈদগা মাঠে বিজিবি’র ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন, পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। তার মরদেহ বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার যোগে বান্দরবান থেকে দুপুর ১.০৫ মিনিটে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার ছয়গড়িয়া নামক স্থানে আনা হয়। এ সময় বিজিবি’র সরাইল জোনের রিজিওনাল কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিসুর রহমান, কুমিল্লার জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, কুমিল্লা বিজিবি’র সেক্টর কমান্ডার কর্নেল জিল্লুল হক, ১০ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল শহিদুর রহমান, কুমিল্লা পুলিশ সুপার টুটুল চক্রবর্তী, দেবিদ্বার নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ হোসেন, দেবিদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান সহ বিজিবি’র পদস্থ কর্মকর্তা এবং চান্দিনা ও দেবিদ্বার উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরে বিজিবি’র একটি এম্বুলেন্সে মরদেহ ৬ কিমি দূরে দেবিদ্বারের বেলানগর গ্রামে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুর ২.৩০টায় বাড়ির পাশের ঈদগাহ ময়দানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন, বিজিবি’র পক্ষ থেকে কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। এর আগে শহীদ মিজানের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠানে বিজিবি কর্মকর্তাগণ ছাড়াও কুমিল্লা-৪ দেবিদ্বারের সংসদ সদস্য রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শহীদ ও মিজানের চাচা আবুল কাশেমসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখেন। বিজিবি’র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনিসুর রহমান জানান, শহীদ মিজানের পরিবারকে বিজিবি’র পক্ষ থেকে আপাতত নগদ ৫ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত ওই পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহায়তা দেয়া হবে। কুমিল্লা জেলা প্রশাসক মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত মিজানের সন্তানদের লেখাপড়াসহ সকল সহায়তা দেয়া হবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মিজানুর রহমানের পিতা আবদুল হাফিজ সেনাবাহিনীতে ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন। যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। এ সময় মিজানুর রহমান ছিলেন মায়ের গর্ভে। মিজানুর রহমান ১৯৮৮ সালে চাকরিতে যোগ দেন। গত ২ মাস আগে লালমনিরহাট থেকে তাকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে বদলি করা হয়। তিনি নাইক্ষ্যংছড়ির দোছড়ি ইউনিয়নের পানছড়ির বিজিবি ক্যাম্পে কর্মরত ছিলেন। নিহত মিজানের পুত্র সন্তান নেই। ৪ মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে ফাতেমা আক্তার বিবাহিত, দ্বিতীয় মেয়ে হালিমা আক্তার স্থানীয় ভৈষেরকোট দাখিল মাদরাসায় ৭ম শ্রেণীতে ও তৃতীয় মেয়ে সিমু ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে লেখাপড়া করছে। ছোট মেয়ে হাবিবা আক্তারের বয়স ৪ বছর। পরিবারের একমাত্র উপার্জনশীল ব্যক্তিকে হারিয়ে সন্তান ও বৃদ্ধা শাশুড়িকে নিয়ে মিজানের স্ত্রী শামীমা আক্তার পারুল এখন দিশাহারা। স্থানীয় বড়কামতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুন-অর রশীদ জানান, নিহত মিজান ছিলেন পরিবারটির একমাত্র অবলম্বন, তাই তিনি সরকারিভাবে ওই অসহায় পরিবারের জন্য সর্বোচ্চ আর্থিক সহায়তার দাবি করেন। নিহত মিজানের মা রাবিয়া বেগম জানান, ’৭১ সালে স্বামীকে হারিয়েছি, এখন দেশের জন্য জীবন দিয়েছে সন্তান, তবু কোন আফসোস নেই, কিন্তু মিজানের ৪ মেয়ে ও স্ত্রীর জন্য সরকার যেন আর্থিক সহায়তা এবং ভবিষ্যতে মেয়ের জন্য চাকরির পদক্ষেপ নেয়।