২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বাজেট, জিডিপি ৭.৩%
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা ৩৬ মিনিটে বাজেট বক্তৃতা শুরু করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করছেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।
দেশের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় বাজেট প্রস্তাব এবং অষ্টমবারের মতো বাজেট প্রস্তাব করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট: অর্থমন্ত্রীর পুরো বক্তৃতা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রস্তাবিত এ বাজেটের আকার ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং বাজেট ঘাটতি থাকছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ।
দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর প্রথম বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বেসরকারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নতির চ্যালেঞ্জ গুরুত্ব পাচ্ছে বলে আগেই জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী।
নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ তাজুল ইসলামসহ অন্যান্য সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭.৩ শতাংশ
আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী বছরে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও গতিশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি, বিনিয়োগ ও রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। এ সময়ে আর্ন্তজাতিক বাজারে খাদ্যশস্য ও জ্বালানির মূল্য কিছুটা কমবে। পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাতে ঋণের প্রবাহ নির্বিঘ্ন রাখা হবে এবং বিনিয়োগ সহায়ক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হবে।
বাজেটে ঘাটতি ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা
২ লাখ ৫০ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা বাজেটের বিপরীতে রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা রয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকার। ফলে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট দেশজ উত্পাদনের তুলনায় ঘাটতি ধরা হয়েছে ৫ শতাংশ।
তবে অনুদান বাদ দিলে ঘাটতি গিয়ে পৌঁছববে ৬১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকায়। শতকরা হিসাবে যা ৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেটে ছয় হাজার ২০৬ কোটি টাকার অনুদান পাওয়া যাবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।
অর্থমন্ত্রীর বিরাট অঙ্কের বাজেটের মধ্যে উন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৬ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। আর অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার ২৪১ কোটি টাকা।
ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা একই, তবে বাড়ানো হয়েছে স্তর
করমুক্ত আয়ের সীমা চলতি বছরের সমান অর্থাৎ দুই লাখ ২০ হাজার টাকা রাখা হয়েছে। তবে নারী ও প্রতিবন্ধীদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি বছর নারীদের করমুক্ত আয়সীমা ছিল আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত। এবার অর্থমন্ত্রী তা দুই লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রতিবন্ধী করদাতাদের ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, চলতি বছর যা ছিল তিন লাখ টাকা।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবার পৃথক করমুক্ত আয়সীমা তৈরির প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি প্রস্তাব করেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ে কর দেবেন না।
প্রস্তাবিত ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে একটি ধাপ বাড়িয়ে ছয়টি স্তর করা হয়েছে। প্রথম দুই লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের ক্ষেত্রে কোনো কর দিতে হবে না। পরবর্তী তিন লাখ পর্যন্ত আয়ের জন্য ১০ শতাংশ, তার পরবর্তী চার লাখের জন্য ১৫ শতাংশ, তার পরবর্তী পাঁচ লাখের জন্য ২০ শতাংশ, তার পরবর্তী ৩০ লাখের জন্য ২৫ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের জন্য ৩০ শতাংশ হারে আয়কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
পদ্মাসেতুতে বরাদ্দ:
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পদ্মা সেতুর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৮ হাজার ১০০ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে (২০১৩-১৪) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) পদ্মা সেতুর জন্য ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫ হাজার ২৫২ কোটি এবং ভারতীয় অনুদান থেকে এক হাজার ৬শ কোটি টাকা ব্যয় করার কথা ছিল।
পিপিপি:
এদিকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ছয়টি খাতে মোট ৩৪টি প্রকল্প নীতিগতভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। যার মধ্যে ৩৩টি প্রকল্পে পরামর্শক নিযুক্ত করা হয়েছে।
পিপিপি’র আওতায় ৩৪টি প্রকল্পের বড় প্রকল্পগুলো হলো- পরিবহন খাতে ১২শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে মংলা বন্দরে দুটি জেটি নির্মাণ, ৩শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে শান্তিনগর-মাওয়া ফ্লাইওভার নির্মাণ, ১৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ, ঢাকা বাইপাসকে ৪ লেনে উন্নীতকরণ (জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুর), ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে মিরপুর স্যাটেলাইট হাউজিং স্থাপন, এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু ব্রিজে ডুয়াল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ, ১৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ এমজি রেলওয়ে ব্রিজ, ১৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম এক্সেস কন্ট্রোল্ড হাইওয়ে, দেড়শ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার পর্যটন ও বিনোদনকেন্দ্র নির্মাণ, একশ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রামের জাকির হোসেন রোডে পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণ, দুই’শ কোটি ব্যয়ে ধীরাশ্রমে নতুন আইসিডি নির্মাণ, ১৫শ’ কোটি ব্যয়ে পাটুরিয়া-গোয়ালন্দতে দ্বিতীয় পদ্মা পাল্টিপারপাস ব্রিজ নির্মাণ এবং ১২শ কোটি ব্যয়ে তৃতীয় সমুদ্র বন্দর নির্মাণ।
মূল্যস্ফীতি:
২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন নি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।
মূল্যস্ফীতি বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, জনজীবনে স্বস্তি বজায় রাখা ও মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে আমরা সফল হয়েছি। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল শেষে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কমে দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
তামাক ও তামাকজাত পণ্য:
উচ্চমান এবং তার পরবর্তীমানের সিগারেটের ওপর করভার হবে সমান অর্থাৎ ৭৬ শতাংশ। মধ্যম মানের করভার হবে ৭৫ শতাংশ এবং নিম্নমানের করভার হবে ৫৮ শতাংশ। অবশ্য, ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ এর ওপরে আরোপিত হবে। ১০ শলাকার বিদ্যমান মূল্যস্তরের চারটি স্ল্যাবের করভার ৫৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫৮ শতাংশ, ৭১ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ, ৭৪ থেকে বাড়িয়ে ৭৬ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।
বিড়ির বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশীয় শিল্পের শ্রমিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিড়িখাতের শুল্ক হারে বিগত ৫ অর্থবছরে কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। বর্তমানে ফিল্টারিবিহীন ২৫ শলাকার বিড়ির করসহ মূল্য ৫.৩৫৪ টাকা এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকার বিড়ির করসহ মূল্য ৬.০৫২ টাকা।
বিড়ি সেবন কমাতে এবারের বাজেটে সকল করসহ ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকার প্যাকেটের মূল্য ৬.১৪ টাকা এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকার প্রতি প্যাকেটের মূল্য ৬.৯৪ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করেন মন্ত্রী।
একই সঙ্গে জর্দা ও গুলের বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশের স্থলে ৬০ শতাংশে ধার্য করার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে যে সব পণ্যের দাম বাড়ছে
প্রস্তাবিত নতুন বাজেট (২০১৪-১৫ অর্থবছর) পাশ হলে ৬৩টি পণ্যের দাম বাড়বে। এগুলোর মাঝে রয়েছে- জ্বালানি তেল, সিগারেট, মোবাইল ফোনসেট, সিলিং ফ্যান, এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার, সেভিং ল্যাম্প, আমদানি করা বাইসাইকেল টিউব, হাইব্রিড গাড়ি, বাণিজ্যিক আমদানিকৃত সিবিইউ রঙিন টেলিভিশন, এয়ারকন্ডিশনারের আউটডোর ও ইনডোর ইউনিট, ফটোকপি ও ফ্যাক্স মেশিন, প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ, বুশবার ট্রাংকিং সিস্টেম, ৫ হাজার লিটার ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গ্যাস সিলিন্ডার, বিদেশি এমএস বার ও রড, বিদেশি বিলেটস প্রভৃতি পণ্যের দাম বাড়ছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব পণ্যের দাম কমছে
২০১৪-১৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ১৭০১ সিসি থেকে ২৭৫০ সিসি পর্যন্ত প্রাইভেট কার, সবধরনের প্রসাধনী, সুগন্ধি, সাবান, মোবাইল সিম কার্ড, টুথ ব্রাশ, আসবাবপত্র, দরজা-জানালা, এ্যালুমিনিয়াম স্যানেটরি ওয়্যারের দাম কমছে। এছাড়া টু স্ট্রোক ও ফোর স্ট্রোক বিশিষ্ট অটো রিক্সা, থ্রি হুইলার ইঞ্জিন, ফিল্টার, ইমিটিয়েশন জুয়েলারি, অমসৃণ হীরা, ট্রাক স্যুট, গার্মেণ্টস সামগ্রী, ওভেন, ফেব্রিক্স ও রেশম বস্ত্রের দাম কমছে। পটেটো চিপস, চকলেট, হিমায়িত মাছ, কাটা ছড়ানো মাছ, মাখন, দুগ্ধজাত চর্বি ও তেল, ডেইরি প্রোডাক্ট, সুইটি বিস্কুট, মেয়েদের ব্রেসিয়ার, রুমাল, শাল, স্কার্ফ, গ্লাভস, মাফলারসহ প্রায় ১৪৮টি পণ্যের দাম কমবে। এছাড়া এসব পণ্যের উপর থেকে সম্পূরক শুল্ক সর্বনিন্ম ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে।