ব্যবহার হচ্ছে ৫৭ রুট ; এত অস্ত্র আসছে কীভাবে
অত্যাধুনিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র যেন হাতে হাতে। কেবল আন্ডারওয়ার্ল্ডের ক্যাডার কিংবা পেশাদার সন্ত্রাসী নয়, বিদেশি নামি-দামি ব্র্যান্ডের আগ্নেয়াস্ত্র এখন সাধারণ পর্যায়ে। সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও গড়ছে অস্ত্রের মজুদ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে বিদেশি ব্র্যান্ডের এসব আগ্নেয়াস্ত্রের চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। চাহিদা মেটাতে দেশের প্রায় ৫৭ সীমান্ত রুট দিয়ে নিয়মিত ঢুকছে বিপুল সংখ্যক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। ভারতীয় অস্ত্রের পাশাপাশি চীন ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে মিয়ানমার হয়ে আসা অবৈধ অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীসহ সারা দেশে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ছয় মাসে অস্ত্রপ্রতি দাম বেড়েছে ৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। তবু চাঙ্গা অবৈধ অস্ত্রের বাজার। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এমন তথ্য জানিয়েছেন। ঢাকা মহানগর গায়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ছানোয়ার হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, উদ্ধার হওয়া অবৈধ অস্ত্রের মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশই বিদেশি। ইউরোপের দামি অস্ত্রের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও অবৈধ অস্ত্র আসছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে অবৈধ অস্ত্রের দাম বেড়ে গেছে। ভারতীয় অস্ত্রের দাম ১০ থেকে ১৫ হাজার এবং ইউরোপীয় অস্ত্রের দাম ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
অপর এক গোয়েন্দা সংস্থার এক পদস্থ কর্মকর্তা জানান, আন্ডারওয়ার্ল্ডে ভারতীয় ছোট অস্ত্রের চাহিদা ছিল এক সময় ব্যাপক। তবে বর্তমানে ইউরোপ থেকে বেশিরভাগ অস্ত্র আসছে বাংলাদেশে। রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার। মিয়ানমার থেকে উখিয়া ও টেকনাফ হয়ে অস্ত্রের চালান ঢুকছে বাংলাদেশে। মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে অস্ত্র আনতে মাছের ট্রলারসহ নানা কৌশল ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা। জেলেরা অর্থের লোভে অনায়াসে অস্ত্র বহন করছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর ও সুন্দরবনের বিভিন্ন রুট দিয়ে মাছের ট্রলারে অস্ত্রের চালান ঢুকছে বেশি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তের চিহ্নিত অস্ত্র চালানের প্রবেশপথগুলো বন্ধ করতে না পারায় দেশের অভ্যন্তরে অবৈধ অস্ত্রের মজুদ বাড়ছে। এছাড়া যেসব বিদেশি অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটিরই বিশেষ সিরিয়াল নম্বর আছে। সেসব নম্বরের সূত্র ধরেও অস্ত্রের কোম্পানি, কোম্পানি থেকে কেনা ডিলারের নাম-ঠিকানা, এমনকি খুচরা ক্রেতারও সব তথ্য জানা যাবে। কারণ নামিদামি ব্র্যান্ডের অস্ত্র কোম্পানি থেকে বৈধ ডিলাররাই কিনতে পারেন। সেসব ডিলারের কাছ থেকে যারা অস্ত্র কেনেন, তাদেরও নাম-পরিচয়সহ বৈধ কাগজপত্র থাকে। এর ব্যতিক্রম যেখানে হয়, মূলত সেখান থেকেই অস্ত্র অবৈধভাবে চোরাকারবারিদের হাতে যায়। এসব বিষয়ে ব্যাপক তদন্ত করা হলে অস্ত্র চোরাকারবারিদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সিন্ডিকেট শনাক্ত করা সম্ভব হবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তেমনভাবে গুরুত্ব দেয়া হয় না। আর তাই অস্ত্র চোরাকারবারির মূল হোতারা থেকে যায় লোকচক্ষুর অন্তরালে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, অবৈধ অস্ত্রের পেছনে আন্তর্জাতিক মাফিয়া ও চোরাচালানিদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক কাজ করছে। সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র পাচার বন্ধে বিজিবির মুখ্য ভূমিকা পালন করার কথা। তবে সেভাবে তাদের তৎপরতা চোখে পড়ে না। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য চোরাকারবারিদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নেয়। স্থানীয় প্রশাসন অস্ত্র পাচার বন্ধে ভূমিকা পালন না করায় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অস্ত্র প্রবেশের হার বেড়ে গেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, দেশে আনুমানিক ৩ লাখ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিভিন্ন পর্যায়ের সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা একশ্রেণীর নেতাকর্মীর হাতে আছে। সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে বড় ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রও। এগুলোর মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ ব্যবহার করে থাকে রাজনৈতিক দলের ক্যাডাররা, ৩০ ভাগ অস্ত্র আন্ডারগ্রাউন্ড সন্ত্রাসীরা। প্রায় ১০ ভাগ অস্ত্র চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইকারীসহ অন্যান্য অপরাধের কাজে ব্যবহার করছে। প্রায় ১০ হাজার পেশাদার সন্ত্রাসীর হাতে লাইসেন্স করা অত্যাধুনিক ৯ এমএম পিস্তল রয়েছে বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত করেছেন। তবে প্রতিদিন কী পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র দেশে আসছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্রের পরিমাণের সঠিক কোনো হালনাগাদ তথ্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে নেই। তাদের কাছে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সুনির্দিষ্ট কোনো তালিকাও নেই। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, ঢাকাসহ সারা দেশে আড়াই শতাধিক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী রয়েছে।
অবৈধ অস্ত্র নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার’ এর তথ্যমতে, বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায় ১২৮টি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সক্রিয়। সীমান্তপথে ভারত ও মিয়ানমার থেকে এসব রুটে সহজেই বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে অস্ত্রের চালান। এছাড়া চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ে দেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র তৈরি করা হয়। কম দাম ও সহজলভ্য হওয়ায় চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় এসব অস্ত্রের চাহিদা বেশি। এর মধ্যে দেশি এলজি, পিস্তল, পাইপগান, বন্দুক উল্লেখযোগ্য।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার এটিএম হাবিবুর রহমান বলেন, অস্ত্র চোরাকারবারিদের তৎপরতা আগের মতোই। অস্ত্র চোরাকারবারিদের নির্দিষ্ট ও সম্ভাব্য রুটগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। তবে অপরাধীরা কৌশলে অনেক সময় এসব রুট পরিবর্তন করছে। এ বিষয়ে র্যাব সার্বক্ষণিক তৎপর আছে।
যেসব রুটে ঢুকছে অস্ত্র : একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, স্থল ও জলপথের ৫৭ রুটে বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালান আনা-নেয়া করা হচ্ছে। অস্ত্রের সবচেয়ে বড় চালান ঢুকছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে। চট্টগ্রামের ৯টি রুট দিয়ে অস্ত্রের চালান আসছে। সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে অস্ত্র আনতে সন্ত্রাসীরা একাধিক রুট ব্যবহার করছে। যশোরের চৌগাছা, ঝিকরগাছা, শার্শা উপজেলার ২৪০ কিলোমিটারজুড়ে ভারতীয় সীমান্ত। শার্শার বেনাপোল স্থলবন্দর, চৌগাছা উপজেলার শাহজাদপুর, হিজলা, আন্দুলিয়া, মান্দারতলা, বেনাপোলের সীমান্তের গোগা, কায়বা, রুদ্রপুর, শিকারপুর ও দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অস্ত্রসহ বিভিন্ন চোরাচালান পণ্য দেশে ঢুকছে। সাতক্ষীরা সদরের কুশখালী, বৈকারী ও গাজীপুর ঘাট দিয়ে সাধারণত অস্ত্রের চোরাচালান আসে। বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ভোলা নদী হয়ে এবং মোরেলগঞ্জ ও কচুয়া উপজেলা দিয়ে বলেশ্বরী নদীপথে অবৈধ অস্ত্র আনা-নেয়া করা হয়। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, জীবননগর; দিনাজপুরের হিলি, কুড়িগ্রামের দুর্গাপুর, নাগেশ্বরী ও ফুলবাড়িয়া; খাগড়াছরির দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা; রাঙ্গামাটির বরকল ও বাঘাইছড়ি; ময়মনসিংহের হালুঘাট ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর। এছাড়া বাংলাবান্দা ভূরুঙ্গামারী, ঝিনাইগাতি ও তামাবিল দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের চালান দেশে ঢুকছে।
যেসব অস্ত্র আসছে : ইতালির তৈরি ‘পেট্রো বেরেটা’, আমেরিকার ‘স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন’ স্পেনের ‘এস্ট্রা আনকেটা’র এবং ভারতে তৈরি পিস্তল ও রিভলবার বিপুল পরিমাণে দেশে ঢুকছে। ছোট আকারের অত্যাধুনিক অস্ত্রের মধ্যে ইতালির পেট্রো বেরেটা, স্পেনের এস্ট্রা আনকেটা, অস্ট্রিয়ার গ্লোক পিস্তল-১৭, ভোলকেনিক ভলিশনাল রিপিটার, ওয়ালদার পিপি, পিপিকে/এস পিস্তল ও ফ্রান্সের বাউনিং হাইপাওয়ার সন্ত্রাসীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া আমেরিকার স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন (এসঅ্যান্ডডবিস্নউ) ব্র্যান্ডের কয়েকটি মডেলের রিভলবার-পিস্তল এদেশের সন্ত্রাসীরা বর্তমানে বেশি ব্যবহার করছে। এর বাইরে ভারতীয় পিস্তল ও রিভলবার।
অস্ত্রের দরদাম : পিট্রো বেরেটাসহ বিদেশি ওইসব অত্যাধুনিক অস্ত্রের মূল্য বৈধভাবে ৭০০ থেকে ১ হাজার ইউএস ডলার। এ অস্ত্রগুলোই বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অন্ধকার জগতে বর্তমানে অবৈধভাবে কেনাবেচা হচ্ছে সাড়ে ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। ছয় মাস আগেও এ অস্ত্রগুলো বিক্রি হতো ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকায়। ভারতীয় পিস্তল বেচাকেনা হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায়। মাস ছয়েক আগে ভারতীয় পিস্তলের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।
যে কৌশলে অস্ত্র আসছে : গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সন্দেহ এড়াতে অস্ত্র চোরাকারবারিরা মহিলাদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে বিশেষভাবে অস্ত্র রেখে তা ক্রেতা-বিক্রেতার কাছে সরবরাহ করছে। এছাড়া পেঁপে ও তরমুজের মধ্যে অস্ত্র রেখে তা এক স্থান থেকে আরেক স্থানে নেয়া হচ্ছে। এমনকি কাঁচা তরকারির গাড়িতে, শিশুদের স্কুলব্যাগে, বাসের সিটের নিচসহ নানা কৌশলে অস্ত্র বহন করা হচ্ছে। অস্ত্র বহনের জন্য রয়েছে নারী ও পুরুষের বিশেষ সিন্ডিকেট, যারা সামাজিকভাবে এবং প্রশাসনের কাছে সন্দেহজনক নয়। যারা অস্ত্র বহন করে তাদের ক্যারিং চার্জ হিসেবে দেয়া হয় বড় অঙ্কের টাকা।