নেতাকর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন গুম-খুনসহ বিভিন্ন অপরাধে; ঘর সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগটানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসে তৃণমূল পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাড়ছে। অন্য দিকে একের পর এক গুম-খুন-অপহরণসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এবার গুম-খুন-অপহরণের তালিকায় নিজ দলের নেতাকর্মীদের নাম যুক্ত হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছে আওয়ামী লীগ। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের নাম উঠে আসছে, তারাও সরকারি দলের নেতাকর্মী হওয়ায় চিন্তিত দলের হাইকমান্ড। গুম-খুন- অপহরণের মতো অপরাধ করে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টির মাধ্যমে সরকারকে বিব্রত অবস্থায় ফেললেও নেতাকর্মীদের সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ দিকে গত সোমবার আওয়ামী লীগের যৌথসভায় দলের ভাবমর্যাদা ুণœকারীদের আওয়ামী লীগে স্থান না দিতে এবং নারায়ণগঞ্জ-ফেনীর ঘটনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট নেতা, এমপি-মন্ত্রীদের কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন দলীয় সভাপতি। এ ছাড়া জেলা-উপজেলাপর্যায়ে দলকে সুসংগঠিত করতে আওয়ামী লীগ শুদ্ধি অভিযানের পরিকল্পনা করছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।   দলটির হাইকমান্ড মনে করছেন, আওয়ামী লীগে দলের আদর্শবিরোধী লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এক ধরনের সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসী দলের মধ্যে প্রবেশ করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছে। ওই সুবিধাবাদীদের বলা হয়ে থাকে ‘স্থায়ী সরকারি দল’। সরকার বদলায় কিন্তু তারা বদলায় না। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে রানিং সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় কিছু লোক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ক্ষমতাসীন দলে প্রবেশ করে। এসব অনুপ্রবেশকারীকে চিহ্নিত করে ছেঁটে ফেলার পাশাপাশি যাদের ছত্রছায়ায় তারা রয়েছে ওইসব গডফাদারকে বহিষ্কার না করে দলে কোনঠাঁসা করে রাখারও চিন্তা করা হচ্ছে। নেতারা বলেন, শিগগিরই দল গোছানোর কাজ শুরু হচ্ছে। হাইকমান্ডের নির্দেশ রয়েছে অনুপ্রবেশকারীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার পাশপাপাশি জেলা-উপজেলায় কাউন্সিলের মাধ্যমে যারা গডফাদার নামে এলাকায় পরিচিত তাদের দল থেকে বাদ না দিয়ে পদবঞ্চিত করে রাখার। নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ঘটনা নিয়ে দলের হাইকমান্ডকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। নতুন কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী এবং তাদের ছায়াদানকারীরা যাতে স্থান না পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন নয়া দিগন্তকে বলেন, নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ঘটনা নিয়ে দলের ভাবমর্যাদা ুণœ হয়েছে। ওই ঘটনাগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, বিভিন্নভাবে আমাদের দলে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তারা গুম, খুন ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে দলকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যাদের ছত্রছায়ায় এবং যারা এসব অপরাধ করছে তাদের বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে ছেঁটে ফেলা হবে।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, গত সোমবারের বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকেরা তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে জেলা-উপজেলাপর্যায়ে সংগঠনের বর্তমান অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার নেতাদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া মাঠপর্যায়ে দীর্ঘ দিন ধরে দলের কাউন্সিল না হওয়ায় সংগঠনের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ার পাশাপাশি নতুন নেতৃত্ব উঠে না আসায় নেতাকর্মীরা যে যার মতো টেন্ডারবাজিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সংগঠনের ওই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে দলীয় প্রধান শুদ্ধি অভিযানের দিকে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী-নেতা-এমপিদের সতর্ক করে বলেছেন, কোনো ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে কেউ জড়িত হলে সে যত বড় নেতাই হোন না কেন, কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। দলের ভাবমর্যাদা ুণœকারী কারোরই আওয়ামী লীগে স্থান হবে না। দলীয় সভাপতি সাম্প্রতিককালে সংঘটিত ফেনী ও নারায়ণগঞ্জে খুনের ঘটনায় অসন্তোষ প্রকাশ করে দলকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেন। যেসব জেলা-উপজেলায় দলের কমিটি নেই, সেখানে দ্রুত কমিটি করার তাগিদ দিয়েছেন। যাদের কারণে দলের সুনাম ুণœ হচ্ছে, দলকে বিতর্কের মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে তাদের দল থেকে বাদ দিতে বলা হয়েছে। সম্মেলনের মাধ্যমে সারা দেশে কমিটি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সহযোগিতা করার জন্যও দলীয় এমপিদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র ও আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলামসহ সাতজনকে অপহরণের পর হত্যাকাণ্ডের রেশ না কাটতেই ফেনীতে প্রকাশ্য দিবালোকে আরেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হককে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এর এক দিন পরেই লক্ষ্মীপুরে আবারো ক্ষমতাসীন দলের দুই নেতাকে এবং বগুড়ায় যুবলীগ কর্মীকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এরপরই পাবনায় আওয়ামী লীগের তিন নেতাকে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এরপর গত মঙ্গলবার আবারো ফেনীতে সরকার সমর্থক এক নেতাকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করে। গত ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে আন্দোলনের চাপ না থাকলেও এসব ঘটনায় ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়েছে সরকার ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সন্ত্রাস দমনে প্রধানমন্ত্রীর ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি থাকলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণীপর্যায়ের একাধিক নেতা।
আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ উল আলম লেনিন নয়া দিগন্তকে  বলেন, আওয়ামী লীগে শুদ্ধি অভিযান বলতে কিছু নেই। সারা দেশে দল গোছানোর কাজ চলছে। ইতোমধ্যে পাঁচটি জেলায় সম্মেলন করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। যারা বিতর্কিত তাদের কমিটিতে স্থান দেয়া হবে না। কেউ যদি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে তার বিরুদ্ধে অতীতেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, আগামীতেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জ ও ফেনীর ঘটনা প্রমাণ করে না আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। তবে ওই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তারা কেউ রেহাই পাবে না। অপরাধী যেই হোক শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তাদের ছাড় দেয়া হবে না।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend