আমের বাজারে রাত বাগান থেকেই বিষাক্ত!
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জমজমাট রাজধানীর অন্যতম ফলের আড়ত কারওয়ান বাজার। একটার পর থেকেই প্রাণ চঞ্চল হয়ে ওঠে এ আড়ত। শতশত কর্মচারী, নিলামকারীর হাকডাকে ব্যস্ত হয়ে ওঠে কারওয়ান বাজার।
আমের অবস্থা ভয়াবহ। সারি সারি আড়তে ট্রাক থেকে নামানো হচ্ছে ভিন্ন জাতের আম। রঙ সবুজ বা হলুদ, সবই পাকা। তবে প্রথমেই হোঁচট খেতে হবে আম কোথাকার, তা নিশ্চিত হওয়া নিয়ে।
বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ-সব জায়গার আমই বিক্রি হচ্ছে একনাম অর্থাৎ ‘রাজশাহী’র আম হিসেবে।
আড়তের কর্মচারীদের ভাষায়, বাগেরহাট-রাজশাহীর হিমসাগর। কি বললেন, জানতে চাইলে এবার একটু সতর্ক হয়ে বলেন, আমাদের কী দোষ! ব্যাপারীরা যেখান থেকে পাঠায়, আমরা সেখানের বলে-ই বিক্রি করি।
তবে আড়তের মালিক জানালেন, এখনো আড়তগুলোতে রাজশাহী বা চাপাঁইনবাবগঞ্জের আম আসা শুরু হয়নি। সাতক্ষীরার আমও শেষের পথে। এখন বাগেরহাট, মেহেরপুর, মাগুরা অঞ্চলের আমই বেশি আসছে।
তিনি বিভিন্ন ধরনের আম হাতে নিয়ে তার আড়তের আমের নমুনা দেখালেন। আমগুলো অতিরিক্ত হলুদ এবং গরম। কেমিক্যাল দেওয়া আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যবসায়ী বললেন, কেমিক্যাল বাদে কারো কাছে আম নাই।
তবে কারওয়ান বাজারের মৌসুমি এসব ফল দেখে বোঝার উপায় নেই কী পরিমাণ ফরমালিন এবং কেমিক্যাল (কার্বাইড এগুলোতে মেশানো হয়েছে।
সোমবার রাতভর বাংলানিউজের সরেজমিনে এবং অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এসব ফলের নানা অজানা ভয়ঙ্কর তথ্য।
ব্যবসায়ী পরিচয়ে একাধিক পাইকারি ফল বিক্রেতাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ফরমালিন মিশিয়ে কয়েকদিন ধরে ফল বিক্রি ও তা সংরক্ষণের পদ্ধতির কথা।
আর এ সময়ই সব গোমর ফাঁস করেন একাধিক পাইকারি ফল বিক্রেতা।
গাছ থেকে সংগ্রহের পর কোন পদ্ধতিতে আমে ফরমালিন এবং কার্বাইড মিশিয়ে ক্রেতাদের বোকা বানিয়ে বাজারে বিক্রি করতে হবে-একে একে সব কৌশলই বলতে থাকেন তারা।
পাইকারি আম বিক্রেতা মো. আলম বাংলানিউজকে বলেন, আপনাদের (ক্রেতাদের) কিছু করতে হবে না। গাছে মুকুল আসার পর থেকেই এই প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমের পোকা নিধনের নামে প্রথমে দেওয়া হয় এক ধরনের কীটনাশক। এরপর গুটি হতেই ওষুধ দিয়ে আমের বোটা শক্তিশালী করা হয়।
তিনি জানান, আম পাকার কয়েকদিন আগেই গাছ থেকে পাড়া (সংগ্রহ) হয়। এরপর গুদাম ঘরে নিয়ে মেশানো হয় ফরমালিন আর কার্বাইড। ফরমালিন দেওয়ার একদিন পর থেকেই আম প্যাকেট করে বাজারজাত করা শুরু হয়।
এদিকে রাতভর রাজধানীর বিভিন্ন আড়তে যেসব কাঁচা আম বিক্রি হচ্ছে সেগুলোর সবই ফরমালিন ও কেমিক্যাল দেওয়া বলে স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া একটি চমকপ্রদ তথ্য দিলেন রংপুরের কাঁচা আম বিক্রেতা আবদুল সামাদ।
তিনি জানান, প্রতিরাতে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ ট্রাক কাঁচা আম নাটোর, রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চল থেকে এই বাজারে আসছে। কিন্তু খুচরা বাজারে তেমন চোখে পরে না। কারণ কাঁচা আমগুলো কিনে নিয়ে কেউ বাড়িতে আবার কেউবা দোকান ঘরের এক কোনায় কেমিক্যাল দিয়ে কয়েক ঘণ্টা রেখে দেয় । এরপর একটু রঙ ধরলেই দ্বিগুণ দামে গাছপাকা আম হিসেবে তা বিক্রি করা হয়। এগুলো সাধারণত ছোট খুচরা ব্যবসায়ীরা করে থাকেন। বড় বড় ব্যবসায়ীরা বাগানে বসেই অপদ্রব্য মেশানোর কাজ সারেন।
একজন আম ব্যবসায়ী জানালেন, ঢাকায় কোনো কেমিক্যাল মেশানো হয় না। বাগান থেকে আম পেড়ে তা ফরমালিন মেশানো পানিতে চুবানো হয়। এরপর কার্বাইড দিয়ে প্যাকিং করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। গন্তব্যে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পথেই রং ধরে যায় ফলগুলো।
কেন এমন অসাধু পন্থা অবলম্বন করছেন?-এমন প্রশ্ন একাধিক বিক্রেতাকে করলে সবার কাছ থেকেই প্রায় একটাই উত্তর আসে।
তারা বলেন, কাঁচামাল পাকার পর এক থেকে দুইদিন পরই পচন শুরু হয়। তাই তারা বাধ্য হয়েই ওই কাজটি করেন।
রাজধানীর অন্যতম এই বৃহৎ ফলের আড়তে রাজশাহীর কিছু অঞ্চল থেকে সবে মাত্র আম আসতে শুরু হয়েছে। এছাড়া গত মে মাস থেকে সাতক্ষীরা অঞ্চলের হিমসাগর, ল্যাংড়া, গুটি আম বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা জানান, প্রতিকেজি পাকা হিমসাগর ও ল্যাংড়া আম পাইকারি ৩০ থেকে ৬০ টাকা, গুটি আম ১৫ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা আশ্বিনা ও গুটি আম কেজি প্রতি ২০ থেকে ৩০ দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
লিচুতেও স্বস্তি নেই:
পাবনার ঈশ্বরদী, দিনাজপুর, নাটোর ও রাজশাহী থেকে এসেছে লিচু ভর্তি ট্রাক। লিচুর ঝুড়ি নামাচ্ছেন শ্রমিকরা।
সোলায়মান নামে এক আড়তের মালিক জানালেন, লিচু এসেছে পাবনার ঈশ্বরদী থেকে। প্রতি ঝুড়িতে ১১শ করে লিচু আছে। তবে বিক্রি হবে এক হাজার হিসেবেই।
আগের রাতে এমন প্রতিটি ঝুড়ি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার টাকা। আজ এখনো বিক্রি শুরু হয়নি। ঝুড়ি খোলার পর সাইজ দেখে ব্যাপারীরা নিলামের মাধ্যমে ফল ব্যাবসায়ীদের কাছে লিচু বিক্রি করবেন বলে জানান তিনি। ওই ব্যবসায়ী বলেন, বাগানে আমাদের স্টাফ লিচু পাকার আগ থেকেই বাগানে নিয়োজিত আছে। বাগান দেখাশোনা ও তদারকির জন্য সেখানে অস্থায়ী ঘর করে তাদের নিযুক্ত করা হয়েছে।
বাগান পরিচর্যা, বিষ-ওষুধ ছিটানো ও লিচু পাড়া, কম দিয়ে আটিঁ বাধার জন্য তাদের দৈনিক চারশ টাকা করে সম্মানী দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি জানান।
আরেক ব্যবসায়ী বলেন, লিচু পাড়ার দিন সকালেই ফরমালিন, হরমোন ও এক ধরনের বিষ দেওয়া হয়। এতে রং গাঢ় লাল হয় এবং ফেটে রস বের হওয়া রোধ হয়। অন্যদিকে ফরমালিন পচন থেকে রক্ষা করে।
তিনি বলেন, বিষ ও ফরমালিন ছাড়া কোনো লিচুই আপনি পাবেন না। আর এটা দেওয়া হয় ফল গাছে থাকতেই।
জমিতেই বিষ মেশানো হচ্ছে আনারসে:
প্রায় দুই মাস হলো রাঙ্গামাটি ও বান্দারবনের আনারস পাওয়া যাচ্ছে রাজধানীর ফল বাজারগুলোতে। এরসঙ্গে গত দুই সপ্তাহ ধরে অল্প পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে মধুপুরের ক্যালেন্ডার জাতের আনারসও।
জমি থেকে সংগ্রহের এক থেকে দুইদিন আগেই এসব আনারসে দেওয়া হচ্ছে নিষিদ্ধ হরমোন ও বিষ। এতে এক দিনের মধ্যেই বুক টানটান হয়ে আনারসের। রং ধরতেও শুরু করে।
তবে ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, এই ওষুধ ক্ষতিকর নয়।
বিক্রেতারা জানালেন, বর্তমানে রাঙ্গামটি ও বান্দরবানের আনারস প্রতি ১শ পিস ১৮ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর মধুপুরের প্রতি পিস আনারস বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকায়।