মন্ত্রী, সচিবের অনিয়মের সুযোগ নেয় এনা
রাজধানীর উত্তরায় ফ্ল্যাট কেলেঙ্কারির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান। এ কেলেঙ্কারিতে তাকে সঙ্গ দেন ওই মন্ত্রণালয়ের সাবেক ও বর্তমানে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. খন্দকার শওকত হোসেন এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল হুদা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অদক্ষতার কারণে বাস্তবায়ন হয়নি সাড়ে ছয় হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প। ২০১৪ সালের মধ্যে এ ফ্ল্যাটগুলো বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও নানা দুর্নীতি ও অনিয়মে জড়িয়ে থাকা এ চক্র এ ব্যাপারে কোনো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়নি। আর এসব কারণে চার বছরে প্রকল্পটির পাঁচ শতাংশ কাজও শেষ হয়নি।
২০১৬ সালের মধ্যে ফ্ল্যাটগুলো গ্রাহকদের বুঝিয়ে দেওয়া হবে এমন কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া তো দূরের কথা স্বপ্নের সেই ফ্ল্যাট প্রকল্পের নির্মাণ কাজই সেই অর্থে শুরু হয়নি গত চার বছরে।
সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী, সাবেক গণপূর্ত সচিব ও সাবেক রাজউক চেয়ারম্যানের অদক্ষতা ও সীমাহীন দুর্নীতির কারণে আদৌ এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়েও দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা।
কারণ এই ত্রিরত্নের দুর্নীতির কারণে এ প্রকল্পের নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সরকারদলীয় সংসদ সদস্য এনামুল হকের ‘এনা প্রপার্টিজ’ নির্দিষ্ট সময়ে উল্লেখ করার মতো কাজও শেষ করেনি। অভিযোগ আছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক গণপূর্ত সচিব ও সাবেক রাজউক চেয়ারম্যানকে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েই এনা প্রপার্টিজ উত্তরা প্রকল্পের কাজের ক্ষেত্রে শুধু সময় ক্ষেপণ করেছে। শুধু তাই নয়, সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে চুক্তি অনুযায়ী যে ৩০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা, তাও দেয়নি এনা প্রপার্টিজ। ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার পেছনে মূলত সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক গণপূর্ত সচিব ও সাবেক রাজউক চেয়ারম্যানের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়টি জড়িত ছিল।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, উত্তরা প্রকল্পে ৪৯টি ১৬ তলা ভবন নির্মাণের জন্য রাজউক ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এনা প্রপার্টিজের সঙ্গে চুক্তি করে। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রকল্পের ৩৩ শতাংশ কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত পাঁচ শতাংশ কাজও শেষ করতে পারেনি এনা প্রপার্টিজ।
অভিযোগ রয়েছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক পূর্ত সচিব খন্দকার শওকত ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হুদার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এনা প্রপার্টিজ প্রকল্পের কাজ না করে ফেলে রাখে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এনা প্রপার্টিজ সময় ক্ষেপণ করে উল্টো রাজউকের বিরুদ্ধেই আদালতে মামলা ঠুকে দেয়। এ কারণে রাজউক উত্তরা প্রকল্পে এনা প্রপার্টিজের সঙ্গে সময়মতো চুক্তি বাতিল করে নতুন দরপত্র আহ্বান করতে পারেনি (যদিও শেষ পর্যন্ত চুক্তি বাতিল করেছে রাজউক)।
ফলে উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পকে যারা নিজেদের মাথা গোঁজার ঠিকানা হিসেবে আশা করা সারা জীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছিলেন, তারা এখন চরম বিপাকে পড়েছেন। এ ছাড়া প্রকল্পের নির্মাণ কাজের অনিশ্চয়তার কারণে এ প্রকল্পে ফ্ল্যাট কেনার জন্য যারা জামানত এবং প্রথম কিস্তির টাকা দিয়েছেন তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই নিশ্চিত করার জন্য সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে এ প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করে মহাবিপাকে পড়েছেন এর গ্রাহকরা। আদৌ ফ্ল্যাট বুঝে পাবেন কি না, তা নিয়ে তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। ভুক্তভোগীরা এখন টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির করছেন।
কিশোরগঞ্জের মুহাম্মদ সেলিম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘জীবনের সব সঞ্চয় বিনিয়োগ করেছিলাম। জামানত ও প্রথম কিস্তিসহ প্রায় ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম ফ্ল্যাটের জন্য। দুই বছরে ফ্ল্যাট বুঝে পাব এ আশায় বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর আশার গুড়ে বালি পড়েছে। এখন টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য ধরনা দিচ্ছি। কিন্তু কবে পাব তা জানি না। আর পেলেও এ টাকা থেকে একটা অংশ কেটে নেওয়া হবে বলে জানতে পেরেছি। এখন পথে বসার উপক্রম।’
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক সচিব ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে এ প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। অথচ এই তিন ব্যক্তি এনা প্রপার্টিজের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে পথে বসিয়ে দিয়েছেন।
শুধু সেলিম নন, এরকম প্রায় পাঁচ হাজার ব্যক্তি ফ্ল্যাটের জন্য টাকা জমা দিয়েছিলেন। তাদের সবারই এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা। রাজউক সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ শতাধিক গ্রাহক তাদের জামানত ও প্রথম কিস্তির টাকা তুলে নিয়েছেন। প্রতিদিন এ সংখ্যা বাড়ছে।
অনুসন্ধানে উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্পে সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক সচিব ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের অনিয়মের নানা কাহিনীও উঠে এসেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে রাজউকের সঙ্গে এনা প্রপার্টিজের চুক্তি হলেও সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের এ প্রতিষ্ঠানটি সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক গণপূর্ত সচিব ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যানের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বৃহৎ এ প্রকল্পের কাজ দেশি-বিদেশি একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে সাব-কন্ট্রাক্টে। নিজেরা কাজ না করে নগদ টাকা হাতিয়ে নেয়। তাদের এ অনিয়মের বিষয়টি জানার পরও রহস্যজনক কারণে সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান, সাবেক গণপূর্ত সচিব খন্দকার শওকত ও রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান এনা প্রপার্টিজের বিরুদ্ধে কোনোরকম ব্যবস্থা নেননি। ফলে উত্তরা প্রকল্পের মতো সরকারের একটি বৃহৎ প্রকল্প শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়ে।
জানতে চাইলে রাজউক বোর্ডের একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনা প্রপার্টিজ যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ দিয়েছে তার কিছুই তারা জানেন না। কারণ পুরো বিষয়টি সাবেক প্রতিমন্ত্রী, সাবেক গণপূর্ত সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান দেখভাল করতেন।
এদিকে রাজউক সূত্র জানায়, উত্তরা প্রকল্পের ‘এ’ ব্লকের পরিবর্তে একই আয়তনে ‘বি’ ব্লকে ৫৯টি ১৬ তলা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এনা প্রপার্টিজের মামলার কারণে যাতে এ প্রকল্পটি আটকে না যায়, সে জন্য এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এখন নতুন করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গেলে ব্যয় বেড়ে যাবে প্রায় ৪০ শতাংশ। আর এ জন্য বাড়তি খরচ হবে ৫৬০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, যা গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া হবে।
অবশ্য বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর এ ব্যাপারে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে। তিনি নিয়েই পরিদর্শন করেছেন এই উত্তরা প্রকল্প। প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী বলেছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এ প্রকল্পের ‘এ’ ব্লকের ফ্ল্যাট গ্রাহকদের হস্তান্তর করা হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে রাজউককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, যেসব ঠিকাদার সরকারের সঙ্গে করা চুক্তি ভঙ্গ করেছেন, তাদের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে।
বেশিসংখ্যক মানুষকে মাথা গোঁজার নিশ্চয়তা দেওয়ার লক্ষ্যে আগের মেয়াদের মহাজোট সরকারের সময় রাজধানীর উত্তরায় বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সরকার ২০১০ সালে উত্তরা ফ্ল্যাট প্রকল্প হাতে নেয়। লক্ষ ছিল চার বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের মধ্যে সাড়ে ছয় হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের।
বর্তমান গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রীর নির্দেশ পেয়ে রাজউকও তৎপর হয়ে উঠেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। যারা উত্তরা প্রকল্পে বিনিয়োগ করেছেন তাদের যত দ্রুত সম্ভব ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার সে লক্ষে কাজ করা হচ্ছে বলেও জানায় সূত্রটি।