প্রশাসনের এক মহাদুর্নীতিবাজ: মালিক ১৮০০ কোটি টাকার, পাচার ৮০০ কোটি
এখন থেকে প্রায় সাড়ে চার বছর আগের কথা। ড. শওকত হোসেন তখন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। দ্রুত উত্থান হচ্ছিলো এই কর্মকর্তার। যুগ্মসচিব (এপিডি) থেকে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার। এরপর আরো উপরে উঠার প্রস্তুতি চলছিলো। পাশাপাশি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ এ্যাডমিন সার্ভিস এসোসিয়েশনের নেতৃত্বও তার হাতের মুঠোয়। এমন সময় সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজই প্রথম এই কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শীর্ষ কাগজের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এই কর্মকর্তার অতীত অপকর্মেরও সুনির্দিষ্ট তথ্য। কিন্তু, সংবাদপত্রের প্রতিবেদনকে মোটেই পাত্তা দিচ্ছিলেন না। কারণ, তার ওপর সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের বিশেষ আশীর্বাদ ছিলো। ফলে সবকিছুকেই মাড়িয়ে তর তর করে উপরে উঠে যাচ্ছিলেন। ওই সময়ই সিনিয়র ৯৮ জন কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পূর্ত সচিব পদের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব বাগিয়ে নেন। এরপর এক পর্যায়ে পূর্ণ সচিবও হন। পূর্ত সচিব পদে বসার পর তার দুর্নীতি-অপকর্মের মাত্রা আরো বেপরোয়াভাবে বেড়ে যায়। দীর্ঘসময় এই পদে থেকে তিনি শুধু বিপুল অবৈধ অর্থই আয় করেন নি, জীবনকেও পরিপূর্ণভাবে ভোগ করেছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন।
যতোটা জানা গেছে, পূর্তসচিব পদটি তার বহু কাঙ্খিত ছিলো। সে কারণে দীর্ঘসময় ধরেই এ পদে থাকলেন। যেহেতু সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের কেউ কেউ ছিলেন ড. শওকতের অতি ঘনিষ্ঠ, সেই সুবাদে অতি সহজেই তিনি এই পদে দীর্ঘ সময় ধরে থাকার ব্যবস্থা করেন। এ পদে থেকে গত প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে ব্যাপকহারে দুর্নীতি-অপকর্ম করেছেন। অবশেষে অনেক পরে এসে মিডিয়াগুলো, সরকার, দুদকও এই মহাদুর্নীতিবাজের অপকর্ম বুঝতে পেরেছে। সরকার তাকে এখান থেকে সরিয়ে সচিবালয়ের বাইরে অপেক্ষাকৃত কম আকর্ষণীয় মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং দিয়েছে। পাশাপাশি মিডিয়াগুলো তার নানা দুর্নীতি-অপকর্ম নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। দুদক তার বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতি সংক্রান্ত তিনটি মামলা দায়ের করেছে একই সঙ্গে।
সবশেষে দুদক এখন ড. শওকতের ১৮০০ কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে। এ নিয়ে বিস্তারিত তদন্ত শুরু হয়েছে। অবৈধভাবে অর্জিত এই অর্থের একটি অন্যতম অংশ বিদেশে পাচার করেছেন, যার পরিমাণ প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। দেশে যে সম্পদ রেখেছেন তারমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করেছেন ৪০০ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে স্ত্রী ও শ্যালকদের বিও একাউন্টের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছেন ৩০০ কোটি টাকা। রাজধানীর বনানীতে স্ত্রী ও শ্যালকের নামে আট কাঠার প্লট কিনেছেন। এর বাজার মূল্য ৩৮ কোটি টাকা। সাভার ও আশুলিয়ায় রয়েছে ১২০ বিঘা জমি, যার মূল্য ৭৫ কোটি টাকা। স্ত্রী আয়েশা খানমের নামে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে (রোড-৯, বাড়ি-১৩৪) ছয় কাঠা প্লটের ওপর ৬ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। এই জমির বর্তমান বাজার মূল্য ৮ কোটি টাকা। এখানে ভবন নির্মাণে প্রায় ৪ কোটি টাকা খরচ করেছেন। গুলশান-১ এর ১২ নম্বর রোডে একটি এ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন, যার মূল্য প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। এছাড়া ভালুকায় রয়েছে ১৬ বিঘা জমি। এর বাজার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। কক্সবাজারে সি-বিচ এলাকায় তিন বিঘা জমি কিনেছেন ভাইদের নামে, বাজার মূল্য প্রায় ১২ কোটি টাকা। মোহাম্মদপুরে নিচু এলাকায় ১৪ কোটি টাকায় ৭ বিঘা জমি কিনেছেন। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে ১৫ বিঘা জমি কিনেছেন। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। প্রশাসনের একজন কর্মকর্তার এতো বিপুল পরিমাণে সম্পদ অর্জন ও পাচারের ঘটনা ফাঁস হওয়া এই প্রথম। দুদকও ইতোপূর্বে কোনো কর্মকর্তার এতো বিপুল অবৈধ সম্পদের তদন্ত করেনি বলে জানা যায়।
উল্লেখ্য, চাকরি জীবনের শুরু থেকে যখন যেখানে চাকরি করেছেন প্রত্যেকটি পদেই তার বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ ছিলো। বিশেষ করে ঢাকা সিএমএম কোর্টে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে জামিন ব্যবসার অনেক অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নজরুল ইনস্টিটিউটের সচিব থাকাকালে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতির অভিযোগ উঠে। বর্তমান সরকারের শুরুর দিকে প্রায় এক বছর ঢাকার কমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন ড. শওকত হোসেন। এ সময় থেকে তিনি ব্যাপক হারে ঘুষ বাণিজ্য করেন। লোক নিয়োগ, এসি ল্যান্ড, কানুনগোসহ বিভিন্ন পদে বদলিতে অনেকটা প্রকাশ্যে ঘুষ বাণিজ্য করেন। ওই সময় সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজে ‘ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিসে জমজমাট তদবির বাণিজ্য’ ‘ঢাকা কমিশনার কার্যালয়ে এখন ঘুষ ফেরতের তদবির’ প্রভৃতি শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর ২০১০ সালের ৫ মে তিনি পূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান। সেই থেকে প্রায় সাড়ে তিন বছর এ পদে ছিলেন।
ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা যায়, সচিব পদে থাকাকালে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের পাশাপাশি জীবনকেও পরিপূর্ণভাবে ভোগ করেছেন ড. শওকত। সরকারের যেসব মন্ত্রণালয় তদবিরের স্থান হিসেবে পরিচিত তারমধ্যে সবচে’ ব্যস্ততম মন্ত্রণালয় হচ্ছে গৃহায়ন ও পূর্ত মন্ত্রণালয়। প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ নানান প্রয়োজনে এখানে আসেন। ফলে বলা যায়, হরেক রকমের তদবির এখানে হয়ে থাকে। আর এ কারণেই ড. শওকতের স্বপ্ন ছিল পূর্ত সচিব হওয়ার। ঠিকাদার ও তদবিরবাজদের কাছ থেকে প্রত্যেকটি তদবিরের বিনিময়ে অর্থের পাশাপাশি অন্য উপঢৌকনও নিয়েছেন তিনি। তা ভোগ করেছেন রাজধানীর অভিজাত এলাকার কোলাহলহীন বিভিন্ন আবাসিক বাড়িতে। যে কারণে ড. শওকত কোনো কোনো ক্ষেত্রে অন্য বিতর্কিত সরকারি কর্মকর্তাদেরও হার মানিয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠরা বলছেন।
সূত্রমতে, এসব কারণেই ড. শওকতকে প্রশাসনে অত্যন্ত বিতর্কিত এবং সমালোচিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। শুধু অবৈধ সম্পদ অর্জনই নয়, চারিত্রিকসহ আরো নানা কারণে তাকে নিয়ে এতো সমালোচনা! বিতর্কিত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে প্রশাসনের দ্বিতীয় শহীদুল আলম বলেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে সচিব শওকতকে। ইতোপূর্বে মহিলা সহকর্মী নিয়ে তৈরি হয়েছে তার অনেক মুখরোচক কাহিনী। এসব কাহিনী অনেকেরই মুখে মুখে।