কেন ব্রাজিল কেন আর্জেন্টিনা: কেন নয় আনিসুল হক
‘মানুষের কাজের দুটো ক্ষেত্র আছে৷ একটা প্রয়োজনের, আর একটা লীলার৷ প্রয়োজনের তাগিদ সমস্তই বাইরের থেকে, অভাবের থেকে; লীলার তাগিদ ভিতর থেকে, ভাবের থেকে৷ বাইরের ফরমাশে এই প্রয়োজনের আসর সরগরম হয়ে ওঠে, ভিতরের ফরমাশে লীলার আসর জমে৷’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, যাত্রীতে৷রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, অনেকটা এই রকম একটা কথা—মানুষের উচ্চতা সাড়ে তিন হাত, কিন্তু ঘরবাড়ি সে সাড়ে তিন হাত উঁচু করে বানায় না, আরও বড় করে বানায়৷
তার গানের মধ্যে পাই:
‘রাতের বাসা হয়নি বাঁধা দিনের কাজে ত্রুটি
বিনা কাজের সেবার মাঝে পাইনে আমি ছুটি৷’
মানুষ একটা আশ্চর্য প্রাণী৷ সে কেবল খেয়ে-পরে বাঁচতে চায় না, বিচিত্রভাবে, দারুণভাবে বাঁচে, বর্ণিলভাবে জীবন যাপন করে৷ ‘বিনা কাজে’ ব্যস্ত থাকে, তাই ছুটি পায় না৷ যার সবটা ব্যাখ্যাও হয়তো করা যায় না৷ তেমনি একটা অব্যাখ্যাত ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের মানুষের ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা-ভক্তি৷ প্রতি বিশ্বকাপের সময় পত্রিকায় খবর বের হয়, খেলা দেখতে গিয়ে উত্তেজনায় হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে কোনো ফুটবল-ভক্ত মারা গেছেন, এই বাংলাদেশে৷ প্রিয় দলের পরাজয়ে আত্মহত্যার খবরও আসে৷ ধরা যাক, বাংলাদেশের একজন মানুষ খুলনায় বা যশোরে, টেকনাফে বা তেঁতুলিয়ায় বসে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা, স্পেন কিংবা জার্মানিকে সমর্থন করছেন৷ তাঁর সমর্থিত দলটি জয়লাভ করলে তাঁর কী লাভ? তাঁর বেতন বাড়বে? তাঁর ব্যবসায় মুনাফা হবে? তাঁর ছেলেমেয়ের পরীক্ষার ফল ভালো হবে? কোনোই স্বার্থ নেই৷ কোনো বৈষয়িক লাভ নেই৷ তবু প্রিয় দলটি ভালো করলে মনে হয় এ যেন নিজেরই জয়৷ প্রিয় খেলোয়াড়টি গোল করলে মনে হয় যেন আমিই গোল করে ফেললাম৷ এটা কেন হয়?
একটা ব্যাখ্যা তো নিশ্চয়ই আছে যে বাংলাদেশের মানুষ জয়ের তেষ্টায় আঁকুপাঁকু করছে৷ জীবনের নানা ক্ষেত্রে মার খেতে খেতে আমরা খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরি তাকে, যে আমাদের জয় এনে দিতে পারবে৷ কিন্তু কথাটি কি সর্বক্ষেত্রে সত্য? বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে এই উপমহাদেশের অন্যত্র মাতামাতি দেখা যায়, যেমন দেখা যায় ভারতেও৷ ভারত তো ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জেতা দল৷ তারা কেন বিশ্বকাপ ফুটবল এলে আমাদেরই মতো ঘুম হারাম করে৷ পরের দিন সকালে অফিসে কিংবা ক্লাসে গিয়ে ঝিমায়৷
অন্যের পরিশ্রমে আনা জয় বিনা শ্রমে নিজের ঘরে তুলতে আমরা বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতি করি, কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়৷ তা না হলে কেন শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া আর রওশন এরশাদ তিনজনই ভক্ত ব্রাজিলের৷ কেন সাকিব আল হাসান আর্জেন্টিনা-অন্তঃপ্রাণ৷ এই দলগুলো তাদের জয় এনে দিতে পারবে বলে? আমার তা মনে হয় না৷ আমরা আসলে ফুটবল-ভক্ত জাতি৷ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির মধ্যে এই একটা ক্ষেত্রে দারুণ মিল, বিশ্বকাপ ফুটবল এলে এপার বাংলা-ওপার বাংলার মানুষ দিওয়ানা হয়ে যায় এবং ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা এই দুভাগে ভাগ হয়ে পড়ে৷ বাংলাদেশে এবং পশ্চিমবঙ্গে যত আর্জেন্টিনা-ভক্ত আছে, আর্জেন্টিনা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও নাকি তেমনটা নেই!
বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস ছেয়ে গেছে প্রধানত আর্জেন্টিনার নীল-সাদা পতাকায়, ব্রাজিলের হলুদে-সবুজে, কোথাও বা উঁকি দিচ্ছে জার্মানির তিনরঙা পতাকা, স্পেন-ইতালির লাল বা নীল৷ কোথাও বা মহাসড়কের ধারে মাইলের পর মাইল নীল-সাদা, কেউ বা তাঁর গোটা বাড়িই রাঙিয়েছেন নীল-সাদায় বা সবুজ-হলুদে৷ একটা মাস কোটি কোটি মানুষ ভুলে থাকবে জাগতিক অন্য সব দুঃখ-বেদনা, চাওয়া-পাওয়া৷ আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলের বিদায় নেওয়া মানে বহু বাংলাদেশির বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যাওয়া৷
বাংলাদেশ ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে ১৬৭৷ আমাদের জীবদ্দশায় বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে খেলতে পারবে, এই আশা আমি করি না৷ বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে এই স্বপ্ন দেখছে৷ ভিশন ২০২২৷ কাতারে বাংলাদেশ খেলবে৷ স্বপ্ন দেখা ভালো৷ ‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়৷’ গাছের মগডাল লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়লে অন্তত মাঝ বরাবর ঢিল তো পৌঁছাবেই৷ বাংলাদেশ খেলবে ২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপে, এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হলে তা হবে খুবই ভালো ব্যাপার৷ আর মাত্র আট বছর৷ হাতে হয়তো পাওয়া যাবে ছয় বছর৷ আমাদের ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফ ২০২২-এর স্বপ্নকে ইতিবাচক বলেই মনে করেন৷ আমার নিজের ধারণা, এখন যাদের বয়স ১০ থেকে ১৬, তাদের নিয়ে কাজ করলে ২০২৬-এ আমরা তার সুফল পেতে পারি৷ তবে সেটা কেবল ১১ জন বা ২২ জন খেলোয়াড়কে নিয়ে করলে হবে না, জাতি হিসেবেই আমাদের খেলোয়াড়সুলভ হয়ে উঠতে হবে৷ সারা দেশে খেলাধুলার অবকাঠামো দরকার হবে৷ আমাদের অ্যাথলেটিকসে ভালো করতে হবে৷ সে ক্ষেত্রে আমাদের স্কুল-কলেজগুলোয় মাঠ দরকার হবে, পাড়ায় পাড়ায় খোলা জায়গাগুলো ফিরে পেতে হবে৷ দৌড়, ঝাঁপ, সাঁতারে আমাদের চৌকস হয়ে উঠতে হবে৷ আনন্দের জন্য খেলার দিনও ফিরিয়ে আনতে হবে জনপদে জনপদে৷ লাগবে দেশজোড়া খেলোয়াড় উঠে আসার মতো প্রতিযোগিতা৷ স্কুলভিত্তিক প্রতিযোগিতা৷ ক্লাবভিত্তিক প্রতিযোগিতা৷ প্রশিক্ষণ আর প্রণোদনা৷
সেসবের জন্য ভিশন চাই—চাই স্বপ্ন, চাই দূরবর্তী লক্ষ্য আর চাই তা পূরণ করার মতো উদ্যোগ৷ আমরা আসলে খেলুড়ে জাতি নই৷ অপুষ্টি আর স্বাস্থ্যহীনতায় আমাদের শারীরিক বৃদ্ধি ঘটেনি সেইভাবে৷ আমরা হাঁটি না, ঘর হতে আঙিনা যেতে আমাদের দরকার হয় রিকশা৷ যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রিকশায় বসে থাকি, রিকশা থেকে নেমে পাঁচ মিনিট হেঁটে গন্তব্যে যাই না৷ আমাদের বাতাসে সিসা, খাদ্যে ফরমালিন, কার্বাইড আর বিষ৷ কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যদি ৩০ মিলিলিটার ফরমালিন ইনজেকশন হিসেবে নেয়, যাতে শতকরা ৩৭ ভাগ ফরমালডিহাইড আছে, তাহলে তার মৃত্যু হতে পারে৷ তার মানে, মাত্র ১১ মিলিলিটার ফরমালডিহাইডই একজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট৷ আর আমরা আমাদের ফলে, মাছে, দুধে, সবজিতে, বরফে নির্বিচারে এই বিষ মেশাচ্ছি৷ এবং তা আমাদের অনন্যোপায়ভাবে গিলতেই হচ্ছে৷ এই দেশ থেকে লড়াকু খেলোয়াড় বেরোবে কোত্থেকে?
তবে আশার কথা হলো, আমাদের সামর্থ্য বাড়ছে৷ আমরা এখন এই দেশে আর্জেন্টিনার মতো দলকে আনার খরচ নির্বাহ করতে পারি৷ অর্থনৈতিক সচ্ছলতা বহু সুযোগ সৃষ্টি করে৷ তবে এর সঙ্গে লাগে ঐতিহ্য, যেটা ক্রিকেটের ক্ষেত্রে আছে এই উপমহাদেশের৷ আমাদের ফুটবলের ঐতিহ্যও খারাপ নয়৷ ১৯৫০ সালে ভারত জুলে রিমে খেলার জন্য ব্রাজিলে যাওয়ার ডাক পেয়েছিল৷ ‘সি’ গ্রুপে খেলবে তারা, ইতালি, প্যারাগুয়ে, সুইডেনের সঙ্গে৷ ভারত যায়নি৷ প্রচলিত আছে, এবং ওই দলের একজন খেলোয়াড় সাক্ষ্যও দিয়েছেন যে, ভারত যায়নি, কারণ তারা খালি পায়ে খেলার অনুমতি পায়নি৷ হঠাৎ করে জুতা-পায়ে খেললে তারা পারবে না, এই ছিল আশঙ্কা৷ যদিও আনুষ্ঠানিক কারণ ছিল, ব্রাজিলে গিয়ে বিশ্বকাপ খেলাটা তাদের কাছে খুব বড় কিছু মনে হয়নি, তার চেয়ে বড় মনে হয়েছিল সেখানে যাওয়ার খরচটা জোগাড় করার ঝক্কি৷ বুঝুন তাহলে অবস্থাটা৷ ১৯৫০ সালে ভারত ব্রাজিলে বিশ্বকাপ খেলতে যায়নি যাতায়াত খরচ জোগাড়ের ঝামেলার কারণে৷ আর আজকে ক্রিকেট বিশ্বকাপ দিনের কোন সময়টায় অনুষ্ঠিত হবে, তা নির্ধারণ করার সময় মাথায় রাখা হয়, ভারতের মানুষ কখন টেলিভিশনের সামনে বসতে পারবে৷ কারণ, ভারতের ক্রিকেটের পেছনে আছে টাকা৷
বাংলাদেশ নানা দিক দিয়েই এগোচ্ছে৷ পঁুজি গড়ে ওঠার কালে যে নৈরাজ্য, যে লুটপাট দেখা যায় দেশে দেশে, ঐতিহাসিক কারণেই, তার ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি৷ আমাদের গণতন্ত্র দুর্বল, বিরোধী দলকে নাকি ফরমালিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে, আমাদের জবাবদিহির সংস্কৃতি নেই, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে৷ ভাঙা হাঁড়িকুড়ি বেচতেন যাঁর বাবা, তিনি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে লোপাট করে দেন৷ আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য ভাড়ায় খুন করেন এবং একজনকে মারতে গিয়ে সাতজনকে মেরে ফেলেন৷ আমাদের নেতারা প্রকাশ্য ঘোষণা দেন তার পাশে দাঁড়ানোর, যার নাম শুনলে মানুষের কলজে কেঁপে ওঠে৷ কিন্তু তার পরও দেশের উন্নতি অব্যাহত আছে, মানুষ তার সৃজনশীলতা দিয়ে জীবনের নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে, তার মাধ্যমে এগিয়ে নিচ্ছে দেশকেই৷ আমাদের আর্থিক সংগতি বাড়ছে৷ ১৯৭২-৭৩ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছিলেন, সেখান থেকে এবারের বাজেট দুই লাখ ৫১ হাজার কোটি টাকা৷ কাজেই আমরা কেবল খেয়ে-পরে বাঁচব তা-ই নয়, আমরা আনন্দের সঙ্গে বাঁচব, আমরা গাইব, খেলব, আঁকব, রচনা করব, নির্মাণ করব, সুন্দর করে তুলব নিজেকে ও চারপাশকে৷
বিশ্বকাপ ফুটবল আমাদের সেই সুন্দরভাবে, আনন্দপূর্ণভাবে বাঁচার একটা উপলক্ষ দেয়৷ যা কোনো কাজে লাগে না, তা-ই তো শিল্প৷ বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রিয় দলের বিজয়ের আনন্দ, পরাজয়ের দুঃখ আমাদের কোনো পার্থিব প্রয়োজনে লাগে না, সে কারণেই ফুটবল সম্ভোগ হলো শিল্পের সম্ভোগ৷ শিল্প হলো মানুষের মহত্তম আচার, মহত্তম প্রকাশ৷ শিল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ নাকি কবিতা৷ আর বলা হয়, শিল্পের সঙ্গে যদি খেলাকে তুলনা করা যায়, তাহলে ফুটবল হলো কবিতা৷
ফুটবলকে আমরা গণতান্ত্রিক খেলাও বলি৷ ফুটবল খেলতে সরঞ্জাম কিছুই লাগে না, একটা কাঠের টুকরা, একটা দেশলাইয়ের বাক্স হলেই হলো৷ কিন্তু ফুটবলে প্রতিপক্ষ লাগে৷ গণতন্ত্রেও বিরোধী দল লাগে৷ সেই কথাটা যেন আমরা ভুলে না যাই, ঘরে এবং বাইরে৷ আমাদের ঘরে-বাইরে ব্রাজিল থাকলে তাই আর্জেন্টিনা লাগে, মোহামেডান থাকলে লাগে আবাহনী, বার্সেলোনা থাকলে এসে পড়ে রিয়াল মাদ্রিদ৷ তেমনি সরকার থাকলে বিরোধী দল লাগবে৷ একইভাবে আমরা যখন নিজের ঘরে বসে বিশ্বকাপ দেখি, তখন ব্রাজিল-ভক্তটি পাশের আর্জেন্টিনা-ভক্তটির সঙ্গে মনে মনে হলেও লড়াইয়ে মাতেন৷ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কোনো দোষ নেই৷ এটা খেলারই অংশ মাত্র৷ কিন্তু ফুটবলে যেমন প্রতিপক্ষকে শারীরিকভাবে নির্মূল করতে চাওয়ার নিয়ম নেই, দরকার হয় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড এবং নিয়মকানুন মানানোর জন্য রেফারি, গণতন্ত্রেও দরকার আইনের শাসন, দরকার স্বাধীন বিচার বিভাগ, দক্ষ প্রশাসন, অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান এবং স্বাধীন সংবাদমাধ্যম৷ কিন্তু সবার আগে দরকার খেলোয়াড়ি মনোভাব, কিংবা গণতান্ত্রিক মানসিকতা৷ আমাদের যে সেটারই বড় অভাব৷
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।