৪৩ বছর পরও ৩০ লাখ সংখ্যাটি সমাধান না হওয়া দুঃখজনক, তবে বিষয়টিকে শুধু সংখ্যার বিতর্কে দেখলে ফল পাওয়া যাবে না, বরং প্রাসঙ্গিক আলোচনাও করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি কিশোরী। ১০ এপ্রিল ১৯৭১-এ ভারতের উদ্দেশে শেরপুর শহর ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় হিন্দু রিফিউজির সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। আমার পিতা স্বর্গীয় সুরেন্দ্র মোহন সাহার নেতৃত্বে পাকিস্তানপন্থীদের সাথে কয়েক দফা মুসাবিদা শেষে চলে যাওয়ার জন্য ৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়। শতাধিক ট্রাক-বাস ভোরবেলায় রওনা হয়ে ১ ঘণ্টার রাস্তা ৬ ঘণ্টায় পাড়ি দিয়ে প্রথমে পৌঁছি ভারতের ডালু ক্যাম্পে। প্রচণ্ড খারাপ রাস্তায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কিতে নাড়িভুঁড়ি বের হওয়ার অবস্থা। তত দিনে ক্যাম্পে অসংখ্য রিফিউজি। আমরা পেলাম হলুদ রঙের তাঁবু, সাথে প্যাকেট খাবার আর কয়েকটা মোমবাতি। সতর্ক করা হলো সাপ ও হাতির ব্যাপারে। পড়েছিলাম বিশাল অজগর আর জোঁকের খপ্পরে। হয়তো সেদিনই কয়েকটা মৃত্যু হতে পারত। কয়েক দিন ক্যাম্পে থাকার পর মাসিক আট টাকা ভাড়ায় উঠলাম পাহাড়ের একটি বেতের ঘরে। তাঁবুতে আর থাকতে হবে না, আমরা সবাই খুশি। দেশ বিভাগের পর ওপারে চলে যাওয়া আত্মীয়ের সাথে দেখা হলে ক্যাম্পের অখাদ্য-কুখাদ্যের বদলে কিছু ভালো খাবার জুটল। পাহাড় থেকে প্রায় এক মাস পর ফুফাতো ভাইয়ের জিম্মায় চলে যাই বালুরঘাট, যেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। ক্যাম্পে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা।
সরাসরি যুদ্ধে কাউকে শহীদ হতে না দেখলেও দুই ধরনের মৃত্যু দেখেছিÑ ১. ক্যাম্পের অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে কলেরা, বার্ধক্য কিংবা রোগে মৃত্যু। ২. বালুরঘাটে রিফিউজি ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের ছোড়া শেলে মৃত্যু। এধরনের মৃত্যুকে শহীদের আমলে নেয়া হয়েছে কি না জানা নেই, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের জন্য না হলে অনেককেই মরতে হতো না। ক্যাম্পে বিচিত্র অভিজ্ঞতার অন্যতম, মৃতদেহ সৎকারের দৃশ্য। কলেরা লাগলে প্রতিদিনই অনেক মৃতদেহ চিতায় পুড়িয়ে ফেলা হতো। শ্মশানঘাটে আবিষ্কার করলাম আমাদের ৪০ বছরের ভৃত্য অতুলদাকে। অতুলদা মরা পোড়ায়। এই দৃশ্য দেখামাত্র কাঁদতে শুরু করি, পরে তাকে দেখলেই ভয়ে মরি। কলেরায় তার স্ত্রী ও শাশুড়ি মারা গেছেন, এ রকম বহু পরিচিতজনের মৃত্যু হয়েছে ক্যাম্পে। জানি, এ হতভাগ্যদের কথা কেউ বলবে না, বলবে শুধু নিজেদের কথা। ৯ মাস পর দেশে ফিরে যা শুনেছি, প্রচুর লিখেছি, এখনো লিখছি কূলকিনারা ছাড়াই। এ যেন অথৈ সমুদ্রে ঝড়ের বিরুদ্ধে সাঁতার কেটে যুদ্ধ করে কূলে ওঠার চেষ্টা। আশ্চর্য যে, ৪৩ বছরেও শহীদের তালিকা করা দূরে থাক, তাদেরকে অপমানের জন্য যা বাকি ছিল সেটাও করলাম, এবার মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্রেস্ট বানিয়ে স্বর্ণ চুরির বাণিজ্যে হাত দিয়েছি। এখানেই কি শেষ? চোরদের সায় দিয়ে কী বললেন সরকারপ্রধান! বিষয়টি দাঁড়াল, স্বর্ণকার মায়ের সোনা চুরি করলে মুক্তিযুদ্ধের নামে ক্রেস্টের স্বর্ণ চুরিও ঠিক। চোরদের নিয়ে বেশি কথা না বলারও উপদেশ দিলেন। দিনদুপুরে ডাকাতির পর সে সময়ের মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীও গায়ের চামড়া বাঁচিয়ে সাধু। এখন মনে হতে পারে, চোর আর শহীদ সব একাকার। বক্তব্যটি কেন আদালতের নজরে আসেনি!
সরকারি উদ্যোগে সংখ্যার বিষয়টি যদিও অনেক আগেই মীমাংসা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু হয়নি। চেতনাবাদী যারা স্বপ্ন দেখান, আমার প্রশ্নÑ মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে শহীদের তালিকা করা কি খুব কঠিন? মোটেও তা মনে করি না। কেন, প্রমাণ দিচ্ছি। তবে অতীতের সব সরকারই এই অবহেলার জন্য সমান দায়ী।
সংখ্যা এবং তথ্যবিভ্রাট
পাকিস্তান কারাগার থেকে সদ্য-ফেরত মুজিব কোনো তথ্য ছাড়াই তাৎণিকভাবে সংখ্যা নিয়ে যে বক্তব্য দিলেন, এতে করে ঝুলে গেল সংখ্যা উদ্ধারের সব চেষ্টা। ফলে মুজিবের কথিত সংখ্যাই প্রতিষ্ঠা পেল। বিষয়টি দাঁড়াল, তাকে সম্মান জানানোর জন্য শহীদদেরও অসম্মান করা যাবে। ফলে নেতার কথা দৈববাণী হওয়ায় ৩০ লাখ না কত, সে বিতর্কে আটকে আছি ৪৩ বছর।
শহীদের সংখ্যা আসলেই কত, তালিকা করা মাত্র এক সপ্তাহের কাজ। কারণ, দেশটি আকারে ছোট। বাজেটের আকার দেখলে মনে হয় না টাকা-পয়সার কোনো অভাব আছে। বেকার খুঁজে পাওয়াও সহজ। প্রতিটি ইউনিয়নে বিজিবি বা সৈন্য পাঠালে এক সপ্তাহের কাজ। বাজেটে কত পয়সাই তো অকাজে ‘ইয়ারমার্ক’ করা হয়, সোনালি ছেলেগুলো কথায় কথায় ৫-১০ হাজার কোটি টাকা মেরে দিচ্ছে, অর্থাৎ টাকার অভাব নেই। কিন্তু এই মহৎ কাজে কি বাজেটে কিছু অনুদান রাখা যেত না? সামান্য দিলেই জেলা প্রশাসকদের নেতৃত্বে ইউনিয়ন কেন, প্রতিটি ইঞ্চিতে তালিকা করা সম্ভব। জেলাপ্রশাসকেরা যে কত কর্মঠ, জেলে জোটকর্মীদের কোরবানির গরুর মতো গাদাগাদি অবস্থাই প্রমাণ। এরা কি প্রতিজ্ঞা করেছেন শহীদের তালিকা কখনোই করবেন না?
নুরেমবার্গ বিতর্ক
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তথ্যসন্ত্রাসীরা এখন ‘ইয়ারমার্কের’ টাকায় আরো বেশি তৎপর। শহীদের কথা উঠলে নুরেমবার্গের প্রসঙ্গটি টানবেনই কথিত বিশেষজ্ঞরা, যেন সব ক’টাই পণ্ডিত কালিদাস। কিন্তু এদের হাতে কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বা প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার ফল আছে? কেউ কেউ এমন আবেগে জর্জরিত, চাপড়ে টেবিল ভেঙে ফেলেন, সংখ্যা নিয়ে তবু অনড়। কিন্তু হলোকাস্টের মর্যাদা দেখে এ কথা বলতেই পারি, আমাদের শহীদদের যে পর্যায়ে অমর্যাদা করা হচ্ছে তা অবিশ্বাস্য। মন্ত্রণালয় পর্যন্ত ক্রেস্টের স্বর্ণ চুরির বাণিজ্যে জড়িয়ে গেছে, সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি তা খোলামেলা সমর্থন করছেন। এর পরও শহীদদের অমর্যাদা করা হয়নি বলার সুযোগ নেই। ৩৪ বছর বাইরে থাকার সুবাদে ‘জেনোসাইড’ নিয়ে বহু তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করেছি, লিখেছিও প্রচুর। জেনোসাইড নিয়ে বিখ্যাত বই ‘প্রবলেম ফ্রম হেল’ গণহত্যাবাগিশদের জন্য জরুরি। বইটি হার্ভার্ড স্কলার সামান্থা স্মিথের লেখা, বর্তমানে যিনি জাতিসঙ্ঘে মার্কিন প্রতিনিধি। এতে রুয়ান্ডা, ইরাকসহ বিভিন্ন গণহত্যার কথা বিশদ লেখা থাকলেও বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়ে কিছুই লেখা হয়নি। বিশ্বজুড়ে এই গণহত্যা কেন অবহেলিতÑ ব্যর্থতা আমাদের। দেশে-বিদেশে ’৭১-এর গণহত্যা কখনোই প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। নিজের ঘরে শহীদদের নিয়ে এ পরিমাণ হেলাফেলা পৃথিবীর কোনো দেশেই নেই। ইন্দোনেশিয়া কিংবা রুয়ান্ডার বেলায় ৮০ হাজার থেকে এক লাখ। শুধু বাংলাদেশের বেলায় পার্থক্য ৩০ হাজার থেকে ৩০০ হাজার নয়, বরং ৩০ লাখ! হলোকাস্ট নিয়ে টকশোতে কথা বললে সরকার দাম দেয়, কিন্তু ওদের ভাগ্য ভালো পাইকারি মিডিয়ার দেশে চ্যালেঞ্জ করার মতো যথেষ্ট পড়ালেখা জানা প্রশ্নকর্তা নেই, থাকলে অনেকের ঘাম ছুটিয়ে দিত। যেসব তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন সেসব না দেয়াই ভালো, কিন্তু অত্যুৎসাহীরা মানছেই না। এদের বেশির ভাগই মুক্তিযুদ্ধের নাম ভাঙায়; ক্রেস্টের স্বর্ণ চোরাকারবারিরা তাই এতটা তৎপর।
হলোকাস্টের তালিকায় একসাথে দুই থেকে পাঁচ লাখ পর্যন্ত মৃত ইহুদির নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়। কিন্তু ৩০ লাখ শহীদ হলে এ ধরনের একটি তালিকাও কি ’৭১-এর বেলায় আছে? এমনকি নামীদামি ওয়েবসাইট, বিশেষ করে ভারত সরকারের ওয়েবসাইটেও যে চারটি ইন্দো-পাক যুদ্ধের কথা বলা হয় সেগুলো ’৪৮, ’৬৫, ’৯৮ ও ’৭১। ভারতীয় ওয়েবসাইটে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা অনুপস্থিত। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সরকারেরও মাথাব্যথা নেই। সজীব ওয়াজেদের বক্তব্যের পরেই একটি বড় পত্রিকাকে হেয় করার পাঁয়তারা হলে বিরাট পত্রিকাটি দায়িত্ব নিয়ে ইন্দো-পাক যুদ্ধের উৎসটি পর্যন্ত খণ্ডাতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের তথ্য সমতাও স্থূল বলে বিশ্বাস করি। বলছি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সজ্ঞানে যে যার মতো ফুটবল খেলছে।
হলোকাস্ট ভিকটিমদের যারা জীবিত, ৭০ বছর পরও ওদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ অব্যাহত। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ভূরি ভূরি প্রত্যদর্শী এখনো জীবিত, যাদেরকে কোনো কাজেই লাগানো হচ্ছে না। কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন, ‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ আমাদের প্রত্যদর্শীরা বুড়িয়ে যাচ্ছে, ফলে ফুরিয়েও যাচ্ছে। কিন্তু শহীদের তালিকা এবং আন্তর্জাতিক মানের জাদুঘর করার এখনই সর্বশেষ সময়। সেগুনবাগিচায় যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরটি রয়েছে, ঢেঁকুর তোলার মতো তেমন কিছুই নেই বরং পপাতদুষ্ট, যা এ ধরনের জাদুঘরের জন্য অগ্রহণযোগ্য। যেসব হাড়গোড় সংরণ করা হয়েছে, সন্দেহাতীত না হওয়ার কারণ, মুক্তিযুদ্ধে যারা মারা গেছেন (বাঙালি, বিহারি, ভারতীয়, পাকিস্তানি) ‘এথনিসিটি’ এক। অর্থাৎ এদের চেহারা, পোশাক, খাদ্য, কালচারও এক। ফলে লাশের স্তূপে সংরতি হাড়গোড়ের কয়জন মিত্রপ, কয়জন শত্র“প বিষয়টির মীমাংসা সম্ভব নয়, এবং হয়নি। এ ছাড়া আজ পর্যন্ত যে পরিমাণ কঙ্কাল, বধ্যভূমি ও তথ্য-প্রমাণ সংগৃহীত, অত্যন্ত অপ্রতুল হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকবেই। আজ পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে বিভ্রান্তির অবসানে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি, বরং বধ্যভূমিগুলো পর্যন্ত দখলদারদের খপ্পরে। ভিকটিমদের পরিবারকে সাহায্য করা নিয়েও টেন্ডারবাজি। চেতনাবাদীদের কি জানা নেই, হলোকাস্টের বেলায় এধরনের দুর্বৃত্তায়ন ভাবাই যায় না!
ওয়েবসাইট
গুগলে এসংক্রান্ত ওয়েবসাইটের অভাব নেই। চাইলে যত খুশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে পারেন। এ জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই। এনএসআইও কিছু বলবে না। কিন্তু এখানেও সংখ্যা নিয়ে সার্কাস। হলোকাস্টে নিহতের সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশের মতো সার্কাস নেই। ’৭১-এর গণহত্যা নিয়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পোস্ট করা তথ্য বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ার কারণ, বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি, বেশির ভাগই অনুমাননির্ভর এবং প-বিপরে বিতর্ক। সরকারি ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে শুধু নিরাশই হয়েছি। ’৭১-এর চেতনাবাদী সরকারের কাছে প্রশ্নÑ বিষয়টি কি এতটা তুচ্ছ হওয়া উচিত? অন্য দিকে অসংখ্য জেনোসাইডের তথ্য ওয়েবসাইটে। সামান্যও অনুধাবন করলে বাংলাদেশে যা হচ্ছে, মেনে নেয়া যায় না।
শেরপুর জেলায় শহীদের সংখ্যা
ওরা বলবে না তাই মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মতো পরো মুক্তিযোদ্ধাদের কথা নিজেরাই বলব। আমাদের সাফ অভিযোগ, ’৭১-এর পরে জন্ম নিয়েও অনেকে মুক্তিযোদ্ধা। এখন পর্যন্ত নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নামে কতই না অপকর্ম! দুই নেত্রীর মধ্যে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে কোথায় ছিলেন, অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেননি। বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে প্রধানমন্ত্রীর বেলায় এটুকু জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সম্ভাবনা যখন চরমে, অর্থাৎ ’৭০-এর নভেম্বর নাগাদ তিনি সন্তানসম্ভবা হলেন, জুলাইতে যখন গণহত্যা চরমে তখন ঢাকা মেডিক্যালে প্রসব হলো আমাদের ভাগিনা, সাথে পেয়েছিলেন নানী অর্থাৎ বেগম মুজিবকে। তার কোলে চড়েই বাসায় ফেরা। দুইজনের একজনও মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে থাকলে সেই ধরনের তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ বইটি থেকে জেনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাও ফরমান আলীর সাথে ড. ওয়াজেদ মিয়ার যোগাযোগ ছিল এবং তাদেরকে তিনি সাহায্য-সহযোগিতাও করতেন, অর্থাৎ তারা ভালোই ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সত্য-মিথ্যা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার মতো বিষয়টি আগেও লিখেছি। প্রসঙ্গটি তোলার কারণ, ৪৩ বছর পরও ‘মুক্তিযোদ্ধা’দের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু শহীদের তালিকা নিয়ে একজনেরও মাথাব্যথা নেই। অথচ বাস্তবে এদের ত্যাগেই অনেকের এত বিত্তবৈভব, মতা।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মতো পরো যোদ্ধাদের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। হিন্দু পরিচয়ের কারণে এক দিকে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে গিয়ে মানবেতর জীবন, অন্য দিকে চোখের সামনে রিফিউজি ক্যাম্পে পাকিস্তানিদের শেলে দফায় দফায় হত্যা। নকশালদের হাতে চোখের সামনে কোপানো হলো ফুফাতো ভাইকে, পুরো পরিবারই ধ্বংস হয়ে গেল। এ ছাড়াও আমার পরমপ্রিয় পিতা যখন জ্যৈষ্ঠের ১০৫ ডিগ্রি রোদে বসে কুচবিহারে টাকা বাট্টা করতেন, তার মনের অবস্থা ভুলব কেন? বাবাকে প্রায়ই কাঁদতে দেখেছি। সীমান্ত কাছে বলে প্রায় ১০ হাজার রিফিউজি যখন শেরপুরে ঢুকল, তখন আমাদের মতো ভলান্টিয়ারদের কাজ ছিল কলসের পানি দিয়ে তৃষ্ণা মেটানো। বড়দের কাজ ছিল ১০ হাজার হিন্দুকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রা করা। এপ্রিলের ১০ তারিখে ব্রহ্মপুত্রের ওই পাড়ে পাকসেনারা, মধুপুর থেকে গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। ১০ হাজার শরণার্থীর প্রধান অভিভাবক আমার বাবা। তার দতায় শেষমুহূর্তে ছাড় দিতে বাধ্য হলো পাকিস্তানপন্থীরা। সুতরাং আমার মতে, দুই ধরনের মুক্তিযোদ্ধাÑ ১. প্রত্য, ২. পরো।
বাবার জন্য না হলে শহরে কেন রক্তগঙ্গা বইত, সাী শেরপুরবাসী। দেশজুড়ে এ ধরনের লাখ লাখ পরো মুক্তিযোদ্ধা, কষ্ট করে কাউকেই আমলে নেয়া হয়নি। নিজেদের প্রমোশন দিতে যারা ব্যস্ত, এসব তুচ্ছ কাজে তাদের রুচি নেই বলেই ধরে নিয়েছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরাও বসে থাকব। আমার এই তালিকা দেখে যদি কারো মনে প্রশ্ন জাগে, অবশ্যই উত্তর দেবো। তবে কেউ কেউ হঠাৎ দেশে এসে কিছু অনুসন্ধান করে বইপত্র লিখে সরকারের বিরাগভাজন হয়েছেন, বইও নিষিদ্ধ হয়েছে। আমার তালিকাটি সে রকম নয়। শেরপুরেই জন্ম, মুক্তিযুদ্ধ আমার অভিজ্ঞতা। শহীদের সংখ্যা নিয়ে মাথাব্যথার কারণ, আমরা চাই ৪৩ বছর দেরিতে হলেও সরকারি উদ্যোগে তালিকা তৈরি করে সংখ্যা বিতর্কের অবসান করা হোক। সংখ্যার সত্য উপস্থাপনের সময় এখনই। আমাদেরকে যারা স্বাধীনতা এনে দিলো, তাদের প্রাপ্য আর্কাইভ, তালিকা এসবের মাধ্যমে প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। স্বর্ণ চুরির সাথে যখন মন্ত্রী জড়িত হন, তখন নেত্রী সাফাই না গাইলে বরং ােভ কিছুটা কমত। আমি কোনো গবেষক বা মুক্তিযোদ্ধা নই, কিন্তু অভিজ্ঞতা তো অস্বীকার করতে পারি না। সুতরাং ১০ হাজার মাইল দূরে বসে সংখ্যা নিয়ে মাথাব্যথা হওয়াই স্বাভাবিক।
টেস্ট কেস হিসেবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাঠপর্যায়ে কর্মী নামিয়ে আমার জেলার একটি তালিকা করার চেষ্টা করেছি, যার ৯৯ ভাগই সঠিক, এক ভাগ নিয়ে বিতর্ক থাকতেও পারে। এই তথ্য সংগ্রহে কেউ আমাকে কোনো অর্থ দেয়নি কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানও এর সাথে জড়িত নয়। স্থানীয়ভাবে সহযোগিতা করেছেন আমার ‘সাপ্তাহিক জয়’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান, তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আগেও প্রচুর কাজ করেছি, তালিকাটা আমার সর্বশেষ আইডিয়া। অনুসন্ধানের কাজে হাত দিয়ে মনে হলো তালিকা করার পদ্ধতি এত সহজ হলে ওরা কেন ৪৩ বছর বসে? ৩৪ বছর প্রবাসী হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, লাখো কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে পয়সা নষ্ট করার বদলে সংখ্যা বিতর্কের অবসান ঘটালে ভালো হতো। প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন পর্যন্ত চাুষ ব্যক্তি আছেন, যারা বলতে পারবেন এলাকার শহীদদের নাম-ঠিকানা। সরকারের উচিত এদের দিকে দৃষ্টি দেয়া, কারণ এটাই শেষ সুযোগ। ওরা চলমান ইতিহাস, অবিলম্বে যা ধরে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে, হলোকাস্ট এবং অন্যান্য গণহত্যার আর্কাইভ এভাবেই তৈরি হয়েছে। অন্তত এটুকু ১/১১-এর সরকার দেখিয়েছে, ঘরে ঘরে ভোটার আইডি করা যায়। ফলে শহীদের আইডিও করা যাবে। ভোটার আইডির তুলনায় শহীদের আইডি করা অনেক সহজ। আমার এলাকার আয়তন এবং শহীদের সংখ্যা, দুটোই দিয়েছি, সে মাফিক মনে হয়, দেশে গড় শহীদের সংখ্যা ৫০ হাজার থেকে এক লাখ হতে পারে। এ ছাড়াও স্থানীয় এমপিদের মাধ্যমে বহু আগেই শহীদের তথ্য সংগ্রহ করা উচিত ছিল। মতিয়া চৌধুরীর একটি এলাকার নাম সোহাগপুর গ্রাম, এক রাতে ১৮১ জন পুরুষকে গুলি করে হত্যা করলে নাম হলোÑ ‘বিধবাপল্লী’।
এক দশক আগে দুইবার গিয়ে বিধবাদের সাথে সারা দিন কাটিয়ে কিছু ভিডিও করলেও সেগুলো অগোছালো। বিধবাদের মানবেতর জীবনের কথা কী লিখব! এটা তো একটি উদাহরণ, এ রকম ভূরি ভূরি। আমার বিশ্বাস, মতিয়া চৌধুরীর এলাকার ১৮১ জনের নাম-ঠিকানার পূর্ণ তালিকা করে তাদের দেখভাল করছেন। কিন্তু আমার এই বিশ্বাসের ওপর ৪৩ বছর পরও কি আস্থা রাখতে পেরেছি? পারিনি, বরং মুক্তিযুদ্ধের নামে দুষ্কৃতকারীরা বারবার আমাকে বিস্মিত করেছে।
মুজিবের বক্তব্য সত্য হলে ’৭১-এর জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রতি ১৫ জনে একজন শহীদ (ইকোনমিস্টের তথ্য)।
কিন্তু আসলেই কি তা হয়েছে? কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতেও পারে, কিন্তু এই রিপোর্টটি একটি টেস্ট কেস, চাইলে অনেকেই নিজ নিজ জেলার তালিকা করে বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারেন। সামাজিক মাধ্যমেও উদ্যোগটি আসতে পারে। ১০ হাজার মাইল দূরে বসে কাজটি করার মাধ্যমে প্রমাণ করতে চেয়েছি, এটি সম্ভব। তবে শুধু তালিকা না করার জন্য নয়, ক্রেস্টের স্বর্ণ চুরির ঘটনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে যখন চুরির সমর্থনে বক্তব্য আসে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো কোনো অন্যায়কারীর েেত্র ‘হু ইজ হি’ বিবেচনায় আর কতকাল বিব্রত হবেন আদালত? অথচ কথায় কথায় আদালত অবমাননার কূলকিনারা নেই।
আমি বিশ্বাস করি, শহীদের সম্মানে ক্রেস্টের স্বর্ণ চুরিই নয়, তদন্ত প্রভাবিত করার মতো বক্তব্যের জন্য ভিভিআইপি’কেও আমলে নিয়ে আদালতের উচিত ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায় বিচারব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ‘হু ইজ হি’ আদালতের বিবেচ্য নয়, বরং আইনের চোখ সবার জন্য সমান। অন্যথায় ৩০ লাখ বিতর্ক থাকবে অনন্তকাল। আমরাও চাই ধোয়ামোছা শেষে পরিচ্ছন্ন একটি বাংলাদেশ।