ইসলামপুরে ইজিপিপি প্রকল্পে হরিলুট : ৬০ শতাংশ ভুয়া শ্রমিক : দিনে ভাগবাটোয়ারা সাত লাখ টাকা
ইসলামপুর (জামালপুর)প্রতিনিধি: ইসলামপুরে অতিদরিদ্রদের জন্য ৪০ দিনের কর্মসংস্থান সূচি (ইজিপিপি) প্রকল্পের ৬০ শতাংশ শ্রমিক ভুয়া ও ভিআইপি। অভিযোগ উঠেছে, এসব ভুয়া শ্রমিকের নামে উত্তোলিত টাকা ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। এভাবে প্রতিদিন বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সাত লাখ টাকার উপরে আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নদ-নদী ভাঙনকবলিত ইসলামপুর উপজেলার কর্মহীন অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থানের জন্য গত ২০০৬ সালে তৎকালীন সরকার দু’পর্যায়ে ১০০ কর্মদিবস নির্ধারণ করে কর্মসৃজন প্রকল্প চালু করে। পরর্বতিতে কর্মসূচির ২০ দিন কমিয়ে ৮০ কর্ম দিবসে নামিয়ে আনা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামপুরে এ কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সপ্তাহের শনি থেকে বুধবার পর্যন্ত পাঁচ কর্ম দিবস ধরে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৬৬টি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এতে ৫ হাজার ১৭৬ অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গত ৩০ এপ্রিল থেকে কর্মসংস্থান সূচি (ইজিপিপি) প্রকল্পের কাজ শুরুর কার্যাদেশ দেয়া হয়।
অভিযোগ উঠেছে, এরই মধ্যে উপজেলার সদর ইউনিয়নের তিনটি, চর গোয়ালিনীর ছয়টি, কুলকান্দীর পাঁচটি, সাপধরীর তিনটি, বেলগাছার পাঁচটি, চিনাডুলীর দুইটি, নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের পাঁচটি, পলবান্ধার পাঁচটি, চরপুটিমারী ইউনিয়নের সাতটি প্রকল্পে পাঁচ থেকে নয় কর্মদিবসে কাজ না করেই ৫০ লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্রে জানা যায়, কর্মসংস্থান সূচির প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে কাজে ১২ ইউনিয়নের ৬৬ প্রকল্পে প্রতিদিন ৫ হাজার ১৭৬ জন শ্রমিক মাথাপিছু ২০০ টাকা মজুরির ভিত্তিতে ৪০ কর্ম দিবস কাজের জন্য ৪ কোটি ১৪ লাখ ৮ হাজার টাকা ও নন ওয়েজ কস্টের জন্য ৪৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।
এদিকে সরেজমিনে দেখা গেছে, ভুয়া ও ভিআইপি শ্রমিকের কারণে প্রকল্পগুলোতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শ্রমিক অনুপস্থিত থাকছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এ সব ভুয়া শ্রমিকের নামে প্রতিদিনের বরাদ্দকৃত ৭ লক্ষাধিক টাকা উত্তোলণ করে চৌকিদার থেকে শুরু করে বড় কর্তা পর্যন্ত ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে। উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন মার্কেটের একটি দোকানে প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনরাত ভুয়া শ্রমিকদের মাস্টার রোল তৈরি করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্পে তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত (ট্যাক অফিসার) বিভিন্ন সরকারি দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, নিজে অফিসের দাফতরিক কাজে ব্যস্ত থাকায় প্রতিদিন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কর্মসংস্থান সূচি প্রকল্প দেখা সম্ভব হয়না। চর গোয়ালিনী ইউনিয়নের তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ট্যাক অফিসার) উপজেলা একাডেমিক সুপার ভাইজার মামুন অর রশিদ জানান, এখন পর্যন্ত প্রকল্প ও শ্রমিকের তালিকাই তিনি পাননি। কুলকান্দী ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, শ্রমিক উপস্থিতি দুঃখজনক। বেলগাছা ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, অফিসের নিজের কাজ শেষে প্রতিদিন যমুনা নদী পার হয়ে দূর্গম চরাঞ্চলের প্রকল্পে যাওয়া সম্ভব নয়। চিনাডলীর ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মেহেদী হাসান একদিনও প্রকল্পে যাননি। সাপধরী ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, সবগুলো প্রকল্প ৩০ কিলোমিটার দূরে যমুনার দূর্গম চরাঞ্চলে। তাই নিজের অফিসের কাজ করে প্রকল্প দেখা কঠিন কাজ।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, গত শনিবার সরকারি অফিস বন্ধ থাকায় ওইদিন কোন প্রকল্পে শ্রমিক থাকে না। রোববার চর গোয়ালিনী ইউনিয়নের কান্দার চর কফিল মাস্টারের বাড়ি-লালু সেকের বাড়ির রাস্তা মেরামত প্রকল্পে ৬০ জন শ্রমিকের মধ্যে শিশু রুবেল, আমু, নূর হানিফ ও সুজনসহ মাত্র আটজন শ্রমিক কাজ করছে। পূর্ব পিরিজপুর খেয়াঘাট-গুচ্ছগ্রাম রাস্তা মেরামত প্রকল্পের ১৪৫ জনের মধ্যে মাত্র ৩৫ জন শ্রমিক কাজ করছে। তাদের অধিকাংশই তালিকাভুক্ত শ্রমিক নয়। ওই প্রকল্পের শ্রমিক আশরাফ আলী জানান, তারা ৩৫ জন শ্রমিক চুক্তির ভিত্তিতে রাস্তার কাজ করছেন।
এছাড়া ডিগ্রিরচর ঈদগাহ মাঠ-ইউপি রাস্তা মেরামত প্রকল্পের ব্যাপারে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, কাগজে-কলমে ১০০ জন শ্রমিকের মধ্যে ৩০ জন শ্রমিক কাজ করলেও তাদের কেই বাস্তবে কাজ করে না। এছাড়া পশ্চিম পিরিজপুর খেয়াঘাট-ঈদগাহ মাঠ রাস্তা মেরামত কাজে ৯১ জন শ্রমিকের মধ্যে ১১ জন শ্রমিককে গাছের ছায়ায় বসে থাকতে দেখা যায়। তারা জানান, দৈনিক হাজিরা নয় চুক্তির মাধ্যমে কাজ করা হচ্ছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ইউনিয়নের একাধিক ইউপি সদস্য জানান, ৪৬১ জন অতিদরিদ্র কর্মহীন নারী-পুরুষ শ্রমিকের টাকা মেরে চুক্তিভিত্তিক ৯০ জন শ্রমিক দিয়ে কাজ করে প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। পাঁচবাড়িয়া কামেজের বাড়ি-ঈদগাঁহ মাঠ রাস্তা মেরামত ৫৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ২৫ জন এবং পচাবহলা কাজম আলীর বাড়ি-কুব্বাত মাস্টারের বাড়ি রাস্তা মেরামত প্রকল্পে ৫৯ জন শ্রমিকের মধ্যে ২৬ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এসব ঘটনার ব্যাপারে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আলাল উদ্দিনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, শীঘ্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা নিবার্হী অফিসার মোহাম্মদ মাসুমুর রহমান বলেন, বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।