একটা কিছু করি: মুহম্মদ জাফর ইকবাল

zafar+iqbalদশ বারো বছর আগের কথা। তখন জামায়াত-বিএনপি-হাওয়া ভবনের রমরমা রাজত্ব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন মানুষজনকে ভিসি-প্রোভিসি হিসাবে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা লেখাপড়া নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। নিজের দলের মানুষজনকে নিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ধরনের তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের একমাত্র কাজ। ‘দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়’ এরকম একটা কথা আছে, তাই আমরা দাঁতে দাঁত কামড়ে কোনোমতে টিকে আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কাজকর্ম দূরে থাকুক, একটা সূতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে পারি না। তখন হঠাত্ একদিন আমি একটা বিষয় আবিষ্কার করলাম, আমি দেখলাম যখনই আমরা কয়েকজন শিক্ষক একত্র হই তখনই চারপাশে কী কী খারাপ খারাপ ব্যাপার ঘটছে সেটা নিয়ে কথা বলি, তারপর সবাই লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলি! সবার ভেতরেই এক ধরনের ক্ষোভ, মন খারাপ করা হতাশা, আমরা একে অন্যের সাথে সেটা দেয়া নেয়া করছি। তাতে ক্ষোভ, হতাশা আর মন খারাপটুকু আরো কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমাদের সবার ভেতরেই বিদ্যাবুদ্ধি জ্ঞাননির্ভর এক ধরনের মানসিকতা আছে, কাজেই আমরা যখন একত্র হব তখন আমাদের একরকম বুদ্ধিভিত্তিক মুক্ত চিন্তার বিষয় নিয়ে কথা বলা উচিত। আমি তখন আমাদের শিক্ষকদের নিয়ে প্রতি মঙ্গলবার সন্ধ্যেবেলা একত্র হয়ে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। এটার নাম দেয়া হল “টুইসডে আড্ডা” এবং নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এটা এখনো টিকে আছে। এখনো মঙ্গলবার সন্ধ্যেবেলা আমরা একত্র হই, কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলি। কথাবার্তাগুলো যদি লিখে রাখা হতো তাহলে সেগুলো অত্যন্ত চমকপ্রদ সুখপাঠ্য একটা বিষয় হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অনেকদিন পর আমার এই “টুইসডে আড্ডা”র জন্মকাহিনী মনে পড়ে গেল, তার কারণ হঠাত্ লক্ষ্য করলাম আমি আবার একই বিষয় করে যাচ্ছি। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে আমার ভেতরে ক্ষোভ এবং হতাশা, আমি দিনের পর দিন সেই ক্ষোভ আর হতাশার কথা লিখে যাচ্ছি। (একটুখানি হলেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেছে, ভবিষ্যতে যদি আর কখনো প্রশ্নপত্র ফাঁস না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়, আমার ধারণা আমরা অনেকখানি অর্জন করেছি বলে দাবি করতে পারব।) কিন্তু আমি আর ক্ষোভ এবং হতাশার কথা লিখতে চাই না, স্বপ্নের কথা লিখতে চাই।

গত ১১ জুন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর দফতরে এই দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাবিদকে নিয়ে একটা সভা হয়েছে, এই সভায় আলোচ্য বিষয় হিসাবে যদিও “প্রশ্নপত্র ফাঁস” কথাটি ব্যবহার করা হয়নি, কিন্তু সবাই জানতো নিশ্চিতভাবেই এটা নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনা হয়েছে এবং মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সবার সামনে অঙ্গীকার করেছেন তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পাবার পর ভবিষ্যতে যেন প্রশ্নপত্র ফাঁস না হয়, সে ব্যাপারে যেটুকু করা সম্ভব হয় সেটা করবেন। আমরা তাই আপাতত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের জন্যে অপেক্ষা করছি।

১১ তারিখের সভায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক শিক্ষাবিদ উপস্থিত ছিলেন, তাদের অনেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কিছু কিছু বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমি তার কয়েকটা এখানে সবার জন্যে তুলে ধরছি;

(ক) আমাদের দেশে আর নতুন কোনো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের দরকার নেই। ষোল কোটি মানুষের কোনো একটি দেশে হয়তো আরো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা মেডিক্যাল কলেজ থাকা সম্ভব কিন্তু আমাদের দেশের জন্যে সেটি সত্যি নয়—তার কারণ এই দেশে এই মুহূর্তে নতুন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজে পড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই। ইতোমধ্যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে, জেনেশুনে সেটাকে আরো সর্বনাশ করার কোনো অর্থ নেই।

(খ) আজকাল পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে পাসের হার একেবারে আকাশ ছোঁয়া, বিষয়টা নিয়ে আমরা সবাই আনন্দ করতে পারতাম, এমনকী গর্ব করতে পারতাম। কিন্তু আসলে আমরা সেটা নিয়ে আনন্দ কিংবা গর্ব করি না, মুখ বুজে হজম করি। তার কারণ যারা পরীক্ষার খাতা দেখেন তাদেরকে অলিখিত কিন্তু কঠিনভাবে মৌখিক নির্দেশ দেয়া হয় সবাইকে শুধু উদারভাবে নয়, দুই হাতে মার্কস দিতে হবে। বিষয়টি এই দেশের সবাই জানে, কিন্তু আমরা খুবই অবাক হলাম যখন টের পেলাম শিক্ষা মন্ত্রণালয় সেটি জানে না। যদি সত্যি তারা না জানেন তাহলে বিষয়টা আরো ভয়ঙ্কর। তার অর্থ এই, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় নির্দেশের তোয়াক্কা না করে নিজেদের মত করে পরীক্ষা পাসের মচ্ছব বসিয়ে দিচ্ছে। বিষয়টা নানা কারণে হূদয়বিদারক, যার সব বিষয়ে জিপিএ ফাইভ পাবার কথা না, তাকেও যদি রীতিমত জোর করে জিপিএ ফাইভ দিয়ে দেয়া হয় তখন তার নিজের সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা হয়ে যায়। যখন এই অতিরঞ্জিত গ্রেড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সুযোগ পাওয়া দূরে থাকুক পাস পর্যন্ত করতে পারে না, তখন তারা খুব খারাপভাবে একটা ধাক্কা খায়। তাদের আত্মবিশ্বাস আত্মসম্মান একেবারে ধূলিসাত্ হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের এভাবে মানসিক নির্যাতনে ঠেলে দেবার কোনো মানে হয় না।

(গ) আমরা হঠাত্ করে আবিষ্কার করছি মাদ্রাসার পাঠ্যবইগুলোতে একধরনের সাম্প্রদায়ীকরণ করা হচ্ছে। বইয়ের বিষয়বস্তু, বইয়ের ছবিতে এক ধরনের কৃত্রিম বিভাজন নিয়ে আসা হচ্ছে। সাধারণ ছেলেমেয়ের ছবি নেই, সব টুপি পরা ছেলে হিজাব পরা মেয়ে। এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে মন্ত্রণালয় জানে না এবং এনসিটিবি নিজেদের উদ্যোগে সেগুলো করে ফেলছে—এটি হচ্ছে সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার। আমরা আমাদের শিক্ষানীতিতে খুব উচ্চকণ্ঠে বলবো—এই দেশটি সকলের জন্য, কিন্তু পাঠ্যবইগুলো ছাপাবো দেশ সম্পর্কে খুব ভিন্ন একটা ধারণা দেবার জন্য, সেটা তো হতে পারে না।

(ঘ) স্কুল পরিচালনা কমিটিগুলোতে যোগ্য লোকের খুব অভাব। সরকারি দলের অনুসারী কিংবা ক্ষমতাশালী লোকজন এই কমিটির সভাপতি হিসেবে থেকে স্কুলের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। নিয়োগ নিয়ে ভয়ংকর এক ধরনের বাণিজ্য হচ্ছে এবং শিক্ষক হিসেবে যোগ্য নয়, এরকম মানুষজন দুর্নীতি করে শিক্ষক হয়ে যাচ্ছে। একটা স্কুলে যদি ভালো শিক্ষক না থাকে তাহলে সেই স্কুলের আর থাকলোটা কী?

(ঙ) পৃথিবীর সব দেশে একটা স্কুল যে এলাকায় থাকে সেই এলাকায় ছেলেমেয়েরা সেই স্কুলটিতে পড়ার সুযোগ পায়। আমাদের দেশে সেটি ঘটেনি। এখানে যে স্কুলগুলোর ভালো স্কুল হিসেবে সুনাম আছে সবাই সেখানে পড়ার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সেই স্কুলে পড়ানোর জন্য বাবা-মায়েরা হন্যে হয়ে পড়েন, এমন কোনো কাজ নেই যেটা করেন না। অথচ প্রত্যেকটা স্কুল যদি একটা নির্দিষ্ট এলাকায় ছেলেমেয়ের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকতো তখন অন্য কোনো উপায় না দেখে সবাই তার এলাকায় স্কুলটাকে ভালো করে তোলার চেষ্টা করতো। সারাদেশে তখন একটি দুটি ভালো স্কুল না থেকে অসংখ্য ভালো স্কুল গড়ে উঠতো।

(চ) আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা এখন পরীক্ষার চাপে রীতিমত জর্জরিত। উঁচু ক্লাসে ওঠার পর পরীক্ষার ব্যাপারটি ঠিক আছে, কিন্তু নিচু ক্লাসগুলো থেকে পরীক্ষা পুরোপুরি তুলে দেয়া হোক যেন বাচ্চারা পরীক্ষার ভয়ে আতংকিত হয়ে লেখাপড়া না করে শেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে লেখাপড়া করে। (এই প্রস্তাবটি আমার খুব পছন্দ হয়েছে—লেখাপড়া ঠিকভাবে করানো হচ্ছে কিনা সেটি যাচাই করার জন্য পরীক্ষার একটা ভূমিকা থাকে, কিন্তু আমাদের দেশে সেটা বাড়াবাড়ি একটা পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার কারণে পরীক্ষাগুলোর আর কোনো গুরুত্ব নেই)।

এখানে আধ ডজন প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে, এছাড়াও আরো নানা ধরনের প্রস্তাব ছিল। মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে সবগুলো প্রস্তাব খুব গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে। যদি এগুলো সত্যি সত্যি কার্যকর করা হয় আমার ধারণা, এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় ধরনের পরিবর্তন হবে।

২.
আমাদের দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষরা শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে হলেই দুটো ভয়ংকর প্রতিবন্ধকতার কথা মনে করিয়ে দেন। তার একটি হচ্ছে গাইড বুক, অন্যটি হচ্ছে কোচিং সেন্টার। কিন্তু এই দেশের সব মানুষ কি জানে, মুখে গাইড বইয়ের বিরুদ্ধে কথা বললেও দেশের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকাগুলো যে ‘শিক্ষা সংক্রান্ত পাতা’-এর নামে পুরোপুরি গাইড বইয়ের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে? গাইড বই যেরকম ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে শেখায়, এই পত্রিকাগুলোও সেরকম প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করতে শেখায়। গাইড বই যেরকম টাকা দিয়ে কিনতে হয়, এই পত্রিকাগুলোও টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ব্যাপারটা কতো গুরুতর দেখার জন্য আমি আজকের (১ লা আষাঢ়, বর্ষার প্রথম দিন, ভেবেছিলাম সব পত্র-পত্রিকা তাদের প্রথম পৃষ্ঠায় কদম ফুলের ছবি দিয়ে বর্ষাকে স্বাগত জানাবে। জানায়নি, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলা সবকিছুকে তুচ্ছ করে ফেলেছে) একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হাতে নিয়েছি। পড়াশোনা সংক্রান্ত অংশের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বিজ্ঞানের প্রশ্ন হিসাবে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য প্রথম প্রশ্নটি এরকম: “আমাদের চারপাশে বিভিন্ন—ছড়িয়ে আছে।” আমাকে শূন্যস্থানটি পূরণ করতে দেয়া হলে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যেতাম, আমাদের চারপাশে অনেক কিছু ছড়িয়ে থাকতে পারে যার প্রত্যেকটিই শুদ্ধ উত্তর হওয়া সম্ভব। কিন্তু আমাদের গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকায় ‘গাইড বই’ ঠিক প্রশ্নটির নিচেই উত্তরটি লিখে দিয়েছে, ‘রোগজীবাণু’।

ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা করার জন্য প্রশ্নগুলো দেয়া হয়নি—তাহলে উত্তরটি অন্য কোথাও থাকতো—শূন্যস্থান পূরণ করে ছাত্রছাত্রীরা পরে মিলিয়ে দেখতো শুদ্ধ হয়েছে কিনা। প্রশ্নের ঠিক নিচে উত্তর লেখা আছে, চিন্তা করার কোনো সুযোগ নেই—মুখস্ত করার জন্য দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানের ২৫টি এবং ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষার ১৭টি প্রশ্ন ঠিক এরকম। জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেটের প্রশ্নগুলো বহু নির্বাচনী এবং সেখানেও একই ব্যাপার। প্রশ্নের সাথেই উত্তর, নিজেকে যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আমাকে সবাই অভিযোগ করেছে যে, সৃজনশীল পরীক্ষারও গাইড বই বের হয়ে গেছে। আমি এখনো নিজের চোখে দেখিনি, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকার শিক্ষা পাতায় এই প্রথম সৃজনশীল প্রশ্নের গাইড বই কী রকম হয়—সেটা দেখার অভিজ্ঞতা হল। ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজির একটি প্রশ্ন এরকমঃ What are Computers must from? অনেকে মনে করতে পারেন ছাপার ভুলে এরকম বিদঘুটে একটা ইংরেজি বাক্য লেখা হয়ে গেছে। আসলে ছাপার ভুল নয়, কারণ উত্তরটাও সাথে সাথে দেয়া হয়েছেঃ Computers are must from word processing to nuclear weapons. যিনি লিখেছেন তিনি এটাকে শুদ্ধ জেনেই লিখেছেন। পত্রিকা সেটা আরো গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে।

গাইড বই সরকার থেকে বেআইনী ঘোষণা করা হয়েছে। যদি এটা সত্যিই বেআইনী হয়ে থাকে তাহলে পত্রিকাগুলো যখন গাইড বইয়ের দায়িত্ব পালন করে, তখন সেটাকে কেন বেআইনী বিবেচনা করে তাদের বিরুদ্ধে আইনের ব্যবস্থা নেয়া যায় না? (আমি জানি আমার নির্বোধের মত কথা শুনে সবাই অট্টহাসি হাসছেন, যে সংবাদপত্রগুলো আমাদের দেশের মানুষের চিন্তাভাবনাকে একটা নির্দিষ্ট দিকে নিয়ে যায়, ওয়ার্ল্ড কাপ খেলার সময় অন্য সবকিছুকে গুরুত্বহীন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে, উঁচু জায়গায়, ভিনদেশি জাতীয় পতাকা উড়াতে গিয়ে তরুণেরা রুটিনমাফিক ইলেকট্রিক শক খেয়ে মারা যাবার পরও এই রাষ্ট্রবিরোধী কাজগুলোকে উত্সাহ দিয়ে যায়—সেই সংবাদপত্রগুলো গাইড বই হিসেবে দায়িত্ব পালন করার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা নিশ্চয়ই অনেক বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ!)

৩.
আমি নিশ্চিতভাবে জানি পদ্মা সেতু কিংবা মেট্রো রেল নয়, রূপপুর পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র কিংবা রামপালের কয়লা বিদ্যুত্ কেন্দ্র নয়—এই দেশের ছেলে-মেয়েদের সত্যিকারের লেখাপড়াই শুধুমাত্র দেশের সকল সমস্যার সমাধান করতে পারবে। জিডিপি-এর ৬ শতাংশ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্যে খরচ করা হবে সেরকম অঙ্গীকার করা হলেও বাংলাদেশ সরকার তার জিডিপি-এর মাত্র ২.২ শতাংশ শিক্ষার জন্যে খরচ করে। এই হিসেবে বাকি পৃথিবী যদি বাংলাদেশকে অশিক্ষিত অসভ্য এবং বর্বরদের দেশ হিসেবে গালাগাল করে, আমাদের সেটা মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। অনেক চেঁচামেচি করেও শিক্ষা খাতে বাড়তি টাকা আনা যাচ্ছে না, সেজন্যে আমরা মাঝে মাঝেই চিন্তা করি ব্যক্তি উদ্যোগ কিংবা স্বেচ্ছাশ্রমে আমাদের কিছু করার আছে কি-না। এ ব্যাপারে আমি সবচেয়ে বড় উত্সাহ পেয়েছি রাগীব হাসান নামে আলাবামা ইউনিভার্সিটির একজন তরুণ শিক্ষকের কাছ থেকে। ব্যাপারটি ঘটেছে এভাবেঃ

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে ব্রেইল বই দরকার, যে বইগুলো স্পর্শ করে পড়া যায়। বছরের শুরুতে সবাই নতুন বই পেলেও দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছেলে-মেয়েরা নতুন দূরে থাকুক কোনো বইই পায় না! তাদের কাতর অনুরোধ শুনতে কেউ রাজি নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তাদের পাঠ্যবইগুলো ছাপিয়ে দেয়া যায় কি-না সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা শুরু হলে এনসিটিবি থেকে পাঠ্যবইগুলোর ইলেকট্রনিক সফট কপি চাওয়া হলে তারা কোনো সাহায্য করতে পারল না। তাদের ওয়েবসাইটে সব পাঠ্যবইয়ের পি.ডি.এফ কপি রয়েছে কিন্তু সেগুলো থেকে ব্রেইল বই ছাপানো সম্ভব না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ হাল ছেড়ে দেয়, কিন্তু রাগীব হাসানের মত নতুন প্রজন্মের তরুণেরা হাল ছাড়ে না। সে নেটওয়ার্কে সারা পৃথিবীর সব বাংলাদেশি তরুণদের অনুরোধ করল বাংলা পাঠ্যবইগুলো টাইপ করে দিতে। শুনে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে—অল্প কয়েকদিনের মাঝে সবাই মিলে সেই বইগুলো টাইপ করে দিল। বছরের পর বছর কাতর অনুনয়-বিনুনয় করে এনসিটিবি থেকে যেটি পাওয়া সম্ভব হয়নি, বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণী অল্প কয়েকদিনে সেটা উপহার দিয়ে দিল! এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম। Crowd sourcing এটাও আমি রাগীব হাসানের কাছ থেকে শিখেছি। অসংখ্য মানুষ মিলে আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব একটা কাজ করে ফেলা!

এর পর থেকে আমার মাথার মাঝে অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে! বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণী দেশের জন্য কিছু করতে চায়, তাদের এই ভালোবাসা আর আগ্রহকে ব্যবহার করে আমরা কি শিক্ষার জন্য নতুন কিছু করতে পারি না? প্রতিবছর যে পাঠ্যবইগুলো লেখা হচ্ছে সেগুলো এখনো দায়সারা, সেই বইগুলো কি নতুন করে লেখা যায় না? বিজ্ঞানের নানা এক্সপেরিমেন্ট এর বর্ণনা থাকে, সেগুলো বাচ্চারা করার সুযোগ পায় না, অন্ততপক্ষে তার ভিত্তিগুলো কি তৈরি করা যায় না? কিংবা দেশের জন্য সবচেয়ে যেটা জরুরি, গাইড বই এবং কোচিং সেন্টারকে চিরতরে দূর করে দেয়া যায় না? আইন করে সেগুলো বন্ধ করা হয়তো কঠিন, কিন্তু তাদেরকে পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয় জঞ্জালে পাল্টে দেয়া তো কঠিন কিছু নয়।

গাইড বই মানে কী? যারা সেটা জানেন না তারা গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকার শিক্ষা পাতাগুলো দেখলেই এখন জেনে যাবেন, বাজার থেকেও বই আকারে সেগুলো কেনা যায়। ছেলেমেয়েরা সেখান থেকে প্রশ্ন আর উত্তর মুখস্ত করে। (অনেকে কৈফিয়ত দেয়ার জন্য বলে প্রশ্নটা কোন্ কাঠামোতে হয় সেটা দেখার জন্য তারা গাইড বই পড়ে!) ‘আমরা কি Crowd sourcing করে সারা পৃথিবীর আগ্রহী তরুণদের থেকে চমত্কার কিছু প্রশ্ন তৈরি করিয়ে নিতে পারি না? সেগুলো তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারি না?’ এই প্রশ্নগুলোর শেষে উত্তর দেয়া থাকবে না। তাই তারা কখনোই সেগুলো মুখস্ত করতে পারবে না, কিন্তু ইচ্ছে করলেই পরীক্ষা দিয়ে নিজেকে যাচাই করে নিতে পারবে, কোথায় দুর্বলতা—নিজেরাই বের করে নিতে পারবে! আমি শ’খানেক প্রশ্নের কথা বলছি না, হাজার হাজার প্রশ্নের কথা বলছি।

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার বিষয়টার খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছি, আমাদের শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে। যে কারণে সৃজনশীল গাইড (এবং গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক পত্রিকা!) এতো জনপ্রিয়। শিক্ষকদের কেমন সমস্যা হয় সেটি আমি জেনেছি আমার বোনের মেয়ের কাছ থেকে, সে যখন ছোট তখন একদিন তার ধর্ম স্যার ক্লাসের সব মেয়েদের বললেন, “ধর্ম পরীক্ষার জন্য তোরা সবাই সৃজনশীল প্রশ্ন করে আনবি—যারটা ভালো হবে সেটা আমি নিব, পরীক্ষায় দিবো!” বাচ্চ বাচ্চা ছেলেমেয়েরা মহাআনন্দে সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করে নিয়ে এলো, শিক্ষক সেখান থেকে বেছে বেছে নিয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করলেন। সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করতে শিক্ষকদের কালো ঘাম ছুটে যায় কিন্তু বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হয় না। তাই, যদি Crowd Sourcing করে সারা পৃথিবীর সব তরুণদের তৈরি করা সব বিষয়ের অসাধারণ কিছু প্রশ্ন জমা করে রাখা যায়, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা সেগুলো দিয়ে নিজের জ্ঞানটুকু পোক্ত করতে পারবে। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনে শিক্ষকরাও সেটা ব্যবহার করতে পারবেন। তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাও করে দেয়া যাবে, বাজে প্রশ্নের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবেন!

আমি খুব সৌভাগ্যবান কারণ আমি খুব উৎসাহী কিছু মানুষের আশপাশে থাকি, অসংখ্য ভাবনা চিন্তা আমাদের মাথায় কাজ করে। বাংলাদেশের তরুণদের নিয়ে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সাহায্য করা ঠিক এরকম একটা চিন্তা-ভাবনা। যদি এরকম একটা উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে কি দেশের তরুণরা এগিয়ে আসবে না? নিশ্চয়ই আসবে!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend