বেশি করে ভালো কাজ করলেই তো হয়- আনিসুল হক
কথাটা শোনা গিয়েছিল নির্বাচনের আগে আগে। যখন এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে বিএনপি ও তার জোট নির্বাচনে আসছে না, আওয়ামী লীগ তার সঙ্গীদের নিয়ে একটা একতরফা নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে চলেছে। তখন আমরা এই রকম একটা কথা শুনলাম, আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় আসবে, তারপর খুব ভালো ভালো কাজ করবে, এতসব ভালো কাজ যে জনগণের হৃদয় তারা জয় করে ফেলবে, এতটাই জয় করবে যে তারপর নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনে যত শক্তিশালী প্রতিপক্ষই অংশ নিক না কেন, নৌকা মার্কারই জয় হবে। শুনে দেয়ালবিহারী টিকটিকি টিক টিক করে উঠেছিল, আর ত্রিকালদর্শী হীরামন পাখি বলে উঠেছিল, হায়, জনচিত্ত জয় করার জন্য ভালো কাজ করার সদিচ্ছা ও ক্ষমতা যদি তাদের থেকেই থাকে, তাহলে তারা এই পাঁচটা বছর করল না কেন? তাদের একটা একতরফা নির্বাচনের দিকে যেতে হচ্ছে কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কেউ সেই তেপান্তরের মাঠে ছিলেন না।
কিন্তু আজকে, ওই নির্বাচনের এতটা দিন পরে, বারবার মনে হচ্ছে, সরকার ভালো কাজগুলো করুক, জনচিত্ত জয় করুক। এমন ভালো ভালো কাজ যেন তারপর নির্বাচন এলে জনগণ ভালোবেসে ফুলের মালা নিয়ে তাদের আবারও বরণ করে নেয়!
হায়, বিড়াল সাদা না কালো, সেটা যে বড় কথা নয়, বড় কথা বিড়াল ইঁদুর মারে কি না। গাছ নির্বাচিত নাকি অনির্বাচিত, তা বড় কথা বটে, তারও চেয়ে বড় কথা, গাছ সুফল দেয় কি না!
প্রসঙ্গটা এসেছে সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতির একটা উক্তিতে, যিনি কি না স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশের অনেক মানুষেরই প্রিয় একজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন প্রধানত তাঁর সুমিষ্ট ও সুরসিক বচনের মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, দেশের মানুষ ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মেনে নিয়েছে। ফলে দেশে এখন স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সেই পটভূমিতে বেজে উঠেছে বিবেকের কণ্ঠস্বর, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাকস্ফূর্তি—রাষ্ট্রপতি জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।
জাতিসংঘ একটা বিবৃতিও দিয়েছে, তাতে তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, সংসদে নেই, এমন বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার। এই বিবৃতির অভিপ্রায় আমরা সম্ভবত বুঝেছি।
আর বিএনপি, তার নেতা–নেত্রীরা, এমনকি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আওয়াজ তুলেছেন—সরকার যদি সংলাপ শুরু না করে, তাহলে আন্দোলন, তাহলে হরতাল। তাদের এই হুমকিকে আমরা মোটেও ফাঁপা ও ফাঁকা আওয়াজ বলে ধরছি না৷ কারণ, বাংলাদেশে হরতাল করতে পয়সা লাগে না, মোটা পেট ও ভারী পা নিয়ে রাজপথে নামতে হয় না নেতাদের, একটা প্রেস বিজ্ঞপ্তি গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়ে বললেই হয়, অমুক দিন হরতাল, জনগণ নিজ দায়িত্বে পিতৃদত্ত প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিজের মতো করে দিনটা পার করে, তাকে আমরা বলি হরতাল পালিত হওয়া। কিন্তু পুরো ব্যাপারটার মধ্যে একটা কেঁচো গণ্ডূষ ভাব আছে। যাকে বলা যায়, পুনঃমূষিক ভবঃ।
আসুন, পুরো ব্যাপারটা একবার রিক্যাপ করি—ধারাবাহিক নাটকের শুরুর ‘এর আগে যা ঘটেছিল’ অংশটির মতো। উচ্চ আদালতের আদেশ ছিল, দুটো টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকার চলতে পারে। কিন্তু আমরা বড়ই গণতন্ত্রপ্রেমী, সংবিধানের শুদ্ধতায় বিশ্বাসী। আমরা এক মুহূর্তের জন্যও অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে পারি না। সংবিধান সংশোধনের জন্য কমিটি গঠিত হলো, তারা দফায় দফায় বিভিন্ন স্তরের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করল এবং একটা প্রস্তাব মোটামুটি সবাই করলেন, আপাতত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাপারটা থাকুক। তবু ওই অনির্বাচিত, সুতরাং অসাংবিধানিক ক্যানসারটুকুন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংবিধান থেকে কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হলো। সে অনেক দিন আগের কথা। তার পর থেকেই বিএনপির জোট মানি না, মানব না করে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তারা অন্তত দুবার দিল ‘আলিটমেটাম’। এত তারিখের মধ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি না মানা হলে সরকার উচ্ছেদের এক দফার আন্দোলন। দিন যায়, আলটিমেটামের তারিখ পার হয়, সরকার আর উচ্ছেদ হয় না। তারপর এল সরকারের মেয়াদপূর্তির আগে ৯০তম দিবসের দিনটা। ওই তারিখের পর ‘সরকার’ অবৈধ, কাজেই তখনই হবে দুর্বার সর্বব্যাপী আন্দোলন। তার আগে সরকারের একজন-দুজন নেতা, একজন-দুজন সচিব বিমানবন্দর পেরোলেন বা পেরোতে গিয়ে ধরাও পড়লেন। সেই তারিখ গেল। আন্দোলনও হলো। শুধু সরকার পড়ল না। একটা নির্বাচন পরিচালনাকারী সর্বদলীয় সরকারের ডাক এল। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী আরেকটা আলটিমেটাম দিলেন। বললেন, এত তারিখের মধ্যে সংলাপ শুরু না করা হলে হরতাল৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সময় পেরোনোর আগেই বললেন, হরতাল প্রত্যাহার করুন৷ আসুন, সংলাপে বসুন। তখন খালেদা জিয়া ও বিএনপি হরতাল প্রত্যাহার করল না, সংলাপেও গেল না। কেউ কেউ মনে করেন, ওইটাই ছিল ‘ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট’। বিএনপি যদি সংলাপে অংশ নিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিয়ে নির্বাচনে যেত, তাহলে তখনই হাওয়া পাল্টে যেত, হাওয়া বুঝে সুবিধাবাদী সিদ্ধান্তপ্রণেতারা বিএনপির হাওয়া নিজেদের পালে লাগিয়ে নিত এবং বিএনপি আজকে ক্ষমতায় থাকত। ওই নির্বাচনে বিএনপির জোট যায়নি, তা প্রতিরোধ করার জন্য পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে, বহু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ভবন পুড়ে গেছে, বহু ট্রেন লাইনচ্যুত করা হয়েছে, বহু মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের দিনটি অতিক্রান্ত হয়ে গেছে এবং শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ, রওশন এরশাদের জাতীয় পার্টিসহ আমাদের গণতন্ত্র এখন ইস্পাতদৃঢ়।
এখন খালেদা জিয়া এবং মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন, সংলাপ দাও।
এত দিন পরে সংলাপ!
আচ্ছা মানলাম, সংলাপ হলো, সরকার বলল, আসুন, আপনারা নির্বাচনে আসুন, আবার নির্বাচন হবে। তখন প্রশ্ন হলো, নির্বাচন যে হবে, কোন পদ্ধতিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিতে, নাকি বর্তমান সংবিধানের আলোকে। বর্তমান সংবিধানের আলোকেই যদি হবে, তাহলে বিএনপি আগের নির্বাচনে অংশ নিল না কেন? মধ্যখানের এত হানাহানি, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি, এত আগুন, এত রক্তপাতের দায় কে নেবে?
কেউ কেউ বলেন, বিএনপির জোট আশায় আশায় ছিল, ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাদের বড় সুবিধা হবে। কারণ, কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গলায় গলায় প্রীতি। শুনে আমি হাসি, অাঁখিজলে ভাসি। বিজেপি যদি অসাম্প্রদায়িক কংগ্রেসের তুলনায় বেশি হিন্দুত্ববাদী হয়ে থাকে, তাহলে তারা কেন আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির বদলে বিএনপি-জামায়াত-জাগপার জোটকে বেছে নেবে। সুষমা স্বরাজ এসেছেন, বার্তা এই যে হাকিম নড়লেও হুকুম নড়ে না। সুসম্পর্ক অটুট থাকবে।
তাই বলে, জাতিসংঘের বিবৃতির তাৎপর্য বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। বিড়াল সাদা না কালো, তাতে বিড়ালের মালিকের হয়তো কিছু যায় আসে না৷ কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ বড়ই গণতন্ত্রপ্রিয়, নিজেদের ভোটাধিকার তারা নিজেরা প্রয়োগ করতে চায়। সেই চাওয়ার একটা প্রতিফলনও আমরা একদিন না একদিন ঘটতে দেখব।
তবে কথা হচ্ছে বর্তমান নিয়ে। অতীত না হয় আপাতত একটু ব্রাকেটবন্দী করে রাখি। সেই যে কথাটা ছিল, আওয়ামী লীগের সরকার একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় এসে এমন সব ভালো ভালো কাজ করবে যে জনগণ সব দুঃখ ভুলে গিয়ে ধন্য ধন্য করবে এবং ভোট এলেই দলে দলে গিয়ে নৌকা মার্কায় ভোট দেবে। এটারও একটা নাম পণ্ডিতেরা দিয়েছেন, মাহািথর পদ্ধতি। অর্থাৎ ক্ষমতার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দেশকে উন্নতির সোপান বেয়ে নিয়ে যেতে পারলে তা ভালো ছাড়া খারাপ কিছু নয়। আমরা সেই কথার কথাটাকেই আপাতত কাজে দেখতে চাই।
সরকার ভালো ভালো কাজ করুক না কেন? ২০০৮-এর নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পরে সত্যিকারের দিনবদলের সুবর্ণ সুযোগ মোটামুটি হেলায় এবং নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যস্ত থাকায় অপচয়িত হয়ে গেছে। এবারের সুযোগটা সুবর্ণ না হলেও একটা বাস্তব সুযোগ এবং সম্ভবত শেষ সুযোগ। এটাকে এই সরকার কাজে লাগাক। সুশাসনের নহর বইয়ে দিক। গডফাদারদের নির্মূল করুক। গুন্ডাপান্ডাদের শায়েস্তা করুক। কালো দাগগুলো সাফ করুক। আর দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজত্ব কায়েম না করে উন্নয়ন, অগ্রগতির ধারা প্রতিষ্ঠিত করুক। দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখুক।
সরকারের লোকজন কিন্তু খুব বলেন, আমরা কত ভালো ভালো কাজ করি, গণমাধ্যম তো সেসব নিয়ে কথা বলে না। খালি খারাপ দিকগুলো কেন তুলে ধরে৷ উত্তরে বলব, ভালো কাজ করাই সরকারের কাজ। কোনো বিমান ঠিকসময়ে যাত্রা করে ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাত্রীদের ঠিকঠাক পৌঁছে দিলে সেটা খবর হয় না, বিমানটা ভেঙে পড়লে সেই খবর না ছাপালে আপনারাই সেই কাগজটাকে ছি ছি করবেন। আর বাস্তবের জগৎটা চলে পারসেপশন দিয়ে, জনগণ কী মনে করে, তা দিয়ে, আপনি আসলে কী করেছেন, তা দিয়ে নয়। জনগণ মনে করে, নারায়ণগঞ্জের এই পরিবারটি একটা গডফাদারের পরিবার। আপনি দুধে ধুয়েও সেই পারসেপশন বদলাতে পারবেন না। সে েক্ষত্রে জনচিত্ত জয় করার উপায় হলো, তাদের বর্জন করা।
আমি জানি, অনেকেরই এই লেখা পছন্দ হবে না। তাঁরা বলবেন, অনির্বাচিত গাছের ফল আমরা খাব না। বা আরেক দল বলবেন, অরণ্যে রোদন করেন কেন? আপনার কথা কে শুনবে?
জানি শুনবে না। কিন্তু বলতে তো হবেই। যদি শোনে। যদি একটা ভালো কাজও সরকার করে, সেটা কিন্তু দেশের লাভ, জনগণের লাভ। তাই আমি বারবার করে বলব, ভালো ভালো কাজ করুন। জনগণের হৃদয় জয় করার চেষ্টা করুন। বেশি বেশি করে ভালো কাজ করুন। জনগণের মনের ভাষাটা পড়ার চেষ্টা করুন।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।