ভেঙে যাচ্ছে ইরাক?
ইরাক ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সুন্নিপন্থি জঙ্গিগোষ্ঠী উত্তর ইরাকসহ পাঁচ প্রদেশের বেশ বড়োসড়ো এলাকা দখল করে নিয়েছে। পশ্চিমা কূটনীতিকরা মনে করছেন, এখন এ সংকট খুবই বাস্তব এবং তীব্র। ধর্মীয় তিন সম্প্রদায় সুনি্ন, শিয়া ও কুর্দিরা দেশটিকে যেন আবারও ধর্মীয় সামন্ত শাসনের মধ্যে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছে। এ সংকটের মাত্রা এখন এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছে যে, দেশটির তিন গোষ্ঠীর নেতারা এ সংকট সমাধানে বিলম্ব করলে একক রাষ্ট্র হিসেবে ইরাকের হয়তো টিকে থাকাই সম্ভব হবে না। হয়তো দ্রুতই তিন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়বে। আর এ বিষয়টি পুরো মধ্যপ্রাচ্যকেই হুমকির মুখে ফেলবে। প্রধানমন্ত্রী নূরি আল মালিকি সবসময়ই সুনি্নদের বঞ্চিত করে আসছেন। তার সরকার সুনি্ন সম্প্রদায়কে সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে এবং সেনাবাহিনীসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন। শুধু তাই নয়, সরকার সবসময়ই সুনি্ন সম্প্রদায়ের বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনকারীদের কঠোরভাবে দমন-পীড়ন করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই সুনি্নগোষ্ঠীর লোকজন তার সরকারের প্রতি একেবারেই ক্ষেপে রয়েছে। এই বিরোধ কমাতে নূরি আল মালিকি যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধ সত্ত্বেও কোনো চেষ্টাই করছেন না_ এমন অভিযোগও উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
সোমবারের সফরে কেরি ইরাকের অখণ্ডতা ধরে রাখতে কুর্দিস্তানের প্রেসিডেন্ট মাসাউদ বারজানিকেও অনুরোধ জানিয়েছেন। মাসাউদ বারজানি এরই মধ্যে মালিকি সরকারের সচেতন ‘ভুল রাজনীতি’কেই এই সংকটের জন্য দায়ী করেছেন। তিনি মনে করেন, ‘নতুন পরিস্থিতিতে নতুন ইরাকে’র সম্ভাবনাই জোরালো হয়ে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে ইরাকের আগের চেহারা ধরে রাখা খুবই কঠিন হবে। বারজানি কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন কেরির কাছে। আর এ জন্য জনগণের অভিমতের ওপরই তিনি নির্ভর করবেন বলে জানিয়েছেন এক সাক্ষাৎকারে। এ থেকে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার, দুই সপ্তাহ আগে ইরাকি নিরাপত্তা বাহিনী তেলসমৃদ্ধ কিরকুক ছেড়ে যাওয়ার পর শহরটির দখল নেওয়া কুর্দি বাহিনী এর নিয়ন্ত্রণ হয়তো সহজে বাগদাদের হাতে ছাড়বে না।
পশ্চিমা কূটনীতিকরা মনে করেছেন, ইরাকের নেতারা সংকটটা এখন বলা যায় বেশ বুঝতে পারছেন। তাদের এই বোধগম্যতা কি কোনো কার্যকরী পরিকল্পনা ও বাস্তবে রূপ পাবে? সেটাই বিরাট প্রশ্ন। এমনকি পশ্চিমারা মালিকি সরকারের ওপর থেকে যে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে_ এ কথাও উচ্চারণ করতে ভোলেননি তারা।
অনেকে মনে করছেন, ইরাক কার্যত এখন তিন গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং নিজেদের প্রভাব অনুযায়ী তলে তলে তিন খণ্ডে প্রায় ছিটকে পড়া একটি দেশ। অনেকেই মনে করছেন, এই তিন গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ও আইনি স্বীকৃতি দরকার। এই তিন গোষ্ঠীর ক্ষমতার ভাগাভাগি ছাড়া অন্য পথে ইরাকে শান্তি আসবে না। কেউ ভাবছেন, ইরাকের তিনটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে ভাগ হলেই ভালো। জাতিসংঘ মনে করছে ইরাকের উচিত একটি একক রাষ্ট্রের যে আইনি কল্পনা তাকে আঁকড়ে ধরা। আর এই সমাধান অনেকটা বসনিয়া হারজেগোভিনার মতোই হবে। কেউ কেউ এর সমাধান অনেকটা এভাবে কল্পনা করছেন-
শিয়া, সুনি্ন এবং কুর্দিদের তিনটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের মধ্যে একটি সন্ধি হবে। এর জন্য সাংবিধানিক বিষয়-আশয় দেখার জন্য ইরাকের এবং আন্তর্জাতিক মহলের যথেষ্ট সংখ্যক আইনবিশেষজ্ঞ যুক্ত থাকবে। কিন্তু শেষ কথা হচ্ছে, তিন গোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দের ইচ্ছাশক্তি এর পক্ষে দৃঢ়ভাবে কাজ করছে কি-না। এমন একটা কনফেডারেশন গঠিত হলে এর কিছু সীমাবদ্ধতা ও আত্মপ্রতারণার দিকও থাকবে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে জাতিসংঘে ইরাকের জন্য তখনও একটি আসনই বরাদ্দ থাকবে। এটা আসলে অনেকটা তাইওয়ানের মতো হবে। তাইওয়ান আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এখনও এর কোনো বাস্তব ভিত্তি গড়ে ওঠেনি। অনেকে মনে করছেন, তিন গোষ্ঠী যদি এমন একটা কল্পনাকে প্রশ্রয় দেয়, তাহলে একটা শান্তিপূর্ণ অবস্থা ফিরে আসতে পারে ইরাকে। জাতীয় পর্যায়ের যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই তিন অঞ্চলের এবং এককভাবেও যে কোনো অঞ্চলের ভেটো ক্ষমতা থাকবে। আর তেল খাতে প্রাপ্ত রাজস্ব তিন অঞ্চলে সমানভাবে ভাগ হয়ে যাবে। এসব ভাবনার কোনো একটির বাস্তবায়ন ঘটানোই আজকের দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। আর আগামী সপ্তাহগুলোতে অবশ্যই ধর্মীয় এবং গোষ্ঠীগত বিরোধের এলাকাগুলো নির্ধারণ করে সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতির সীমানারেখা নির্ধারণ করতে হবে। তবে এটা খুবই কঠিন কাজ। একে ঘিরে বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে দাঙ্গা ও নিধনযজ্ঞ শুরু হতে পারে। একবার ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এবং শিয়া অধ্যুষিত এলাকা এবং দক্ষিণ বাগদাদে শিয়া-সুনি্ন সংঘর্ষ থেমে গেলে, ইরাক সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক এই প্রস্তাব সামনে আনতে হবে। সুনি্নগোষ্ঠীর অধিকাংশ লোকজনই ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড লেভান্তের (আইএসআইএল) প্রতি অনুগত নয়। তারা অবশ্যই একটি শান্তিপূর্ণ কনফেডারেশন গঠনের পথে তখন পদক্ষেপ নেবেন। আর তারা যদি ব্যর্থ হন, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রস্তাব কোনো কাজে আসবে না। বসনিয়া হারজেগোভিনার পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত তিন দলের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা রিচার্ড হলব্রুক এমন একটা চুক্তি বাস্তবায়ন করেছিলেন। ওই চুক্তিকে সঠিক সমাধান বলা কঠিন; কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ইউরোপে চলতে থাকা দীর্ঘকালের ওই রক্তপাত বন্ধ করতে সফল হয় এ চুক্তিটি। এ চুক্তি বাস্তবায়নের সময় হলব্রুকের উদ্যোগে বসনীয় সার্ভদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চলছিল। ইরাকের ক্ষেত্রে সুনি্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিমান হামলার বিষয়টিও যুক্ত থাকতে পারে। এই পদক্ষেপ আসলে কূটনীতিক পদক্ষেপের ব্যর্থতা নয় বলে মনে করেন অনেকে।