জামায়াতের সঙ্গে আদর্শিক কোনো ঐক্য নেই, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে খালেদা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য ভারতকে নয়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থরক্ষায় আমাদের সরকারের ব্যর্থতা বা সদিচ্ছার অভাব দায়ী, যা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের পরপরই ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খালেদা জিয়া এসব কথা বলেন। সাংবাদিক সুভজিৎ রায়ের নেওয়া এ সাক্ষাৎকারটি গতকাল মঙ্গলবার পত্রিকাটির অনলাইনে প্রকাশ করা হয়।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক, দেশের চলমান পরিস্থিতি, ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন, দুই দেশের অমীমাংসিত বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। নয়াদিল্লির কাছে ভারতবিরোধী হিসেবে পরিচিত খালেদা জিয়া মনে করেন, বাংলাদেশের জনগণ আন্তরিকভাবেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়।
সুষমা স্বরাজের সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমরা দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। যেমন- সীমান্ত হত্যা। তিনি জানিয়েছেন সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার চেষ্টা চালানো হবে। তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে তিনি আশ্বস্ত করেছেন, এগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। দুই দেশের সম্পর্কের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। শুকনো মৌসুমে যখন পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন দেশের জনগণ ভারতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী। আমাদের দুই দেশের মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত, তাই কিছু সমস্যা হতেই পারে। কিন্তু এ জন্য মানুষ হত্যা, তা জনগণ মেনে নিতে পারে না। তিনি আমাদের উদ্বেগ ও অমীমাংসিত বিষয়গুলোর কথা শুনেছেন।’
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের মনোভাব কেমন হবে- এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘মোদি সরকার এখনো তাদের যাত্রা পুরোপুরি শুরু করেনি। আমি মোদিকে দুই দফা চিঠি পাঠিয়েছিলাম। একটি তিনি বিজয়ী হওয়ার পর, অন্যটি তিনি শপথ নেওয়ার পর। আশা করি, ভারতের নতুন সরকার দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে উদ্যোগ নেবে।’
মোদি কি আপনাকে ভারত সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন- এ প্রশ্নের জবাবে খালেদা বলেন, ‘হ্যাঁ, তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি তাঁকে শুভেচ্ছা জানানোর সময় তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়।’
ভারত সফরের পরিকল্পনা আছে কি না- এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা তো জানেন আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি। আমি এখন খুবই ব্যস্ত। দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই। দেশের ৯৫ ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে এবং তারা একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়।’
বাংলাদেশের গত নির্বাচনে ভারতের বিগত সরকার আপনাকে সমর্থন দেয়নি বলে আপনি কি হতাশ- এ প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সময় তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এইচ এম এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। অন্যথায় নির্বাচন হবে না এবং মৌলবাদীরা ক্ষমতায় চলে আসতে পারে। তিনি আমাদের দলকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। আমরা তাঁকে জানিয়েছিলাম, কেন আমরা নির্বাচনে অংশ নেব না। আমরা একটা রাজনৈতিক দল, কোনো আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি নই। নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ না হয়, তাতে অংশ নেওয়ার কোনো কথাই আসে না। পরে এরশাদও জনসম্মুখে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি নির্বাচনে যাবেন না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে কিভাবে যেন কী ঘটে গেল…। সুজাতা সিংয়ের এ ধরনের বক্তব্যের পর এতে কংগ্রেস সরকারের কোনো ভূমিকা ছিল কি না তা আমি জানি না।’
খালেদা জিয়া আরো বলেন, ‘তবে এরশাদ পরে বলেছেন, সুজাতা সিং নির্বাচনে অংশ নিতে তাঁকে চাপ দিয়েছিলেন। আর ভারতই হচ্ছে একমাত্র দেশ যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘও এই একতরফা নির্বাচনকে সমর্থন দেয়নি। তারা কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। তারা এ নির্বাচনকে মেনে নেয়নি। ওই সব দেশের জনগণও নির্বাচনকে মেনে নেয়নি। আর তাই এটি একটি অবৈধ সরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরেকটি দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।’
ভারতের কংগ্রেস সরকার বাংলাদেশকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি বলে মনে করেন কি- এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘এটাই বাংলাদেশের জনগণের ধারণা। প্রকৃতপক্ষে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর নিষ্পত্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থরক্ষায় আমাদের সরকারের ব্যর্থতা বা সদিচ্ছার অভাব দায়ী, যা বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।’
কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠতার কারণে কি বাংলাদেশ উপকৃত হয়নি- এর জবাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, ‘এটিও এখানকার মানুষের ধারণা। বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। দুই দেশের জনগণের স্বার্থকে ঘিরেই সে সম্পর্ক গড়ে ওঠা উচিত, এটা কোনো একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তি বিশেষকে কেন্দ্র করে নয়। এর জন্য আমি কাউকে দায়ী করছি না, কিন্তু আওয়ামী লীগ এটা করতে তাদের বাধ্য করেছে। এবং ভারত সরকার তাদের সমর্থন দিয়েছে। এরশাদ এ বিষয়টি নিয়ে এখনো কথা বলছেন। তিনি নির্বাচনে যেতে চাননি কিন্তু তাঁকে জোর করে নির্বাচনে নেওয়া হয়েছে। তিনি মনোনয়ন প্রত্যাহারের জন্য চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু তা গ্রহণ করা হয়নি। তাই একটা ধারণা হচ্ছে, ভারত সরকার এখানে (৫ জানুয়ারির নির্বাচন) একটা ভূমিকা পালন করেছে।’
তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়ার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাকে কিভাবে দেখেন- এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরকালে বলা হয়েছিল, তিস্তার পানিবণ্টনে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। যদিও বাংলাদেশের জনগণ এর বিস্তারিত কিছুই জানত না। অবশেষে মমতার বিরোধিতার কারণে এ চুক্তি হয়নি। বাংলাদেশের জনগণ জানে না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে… আমি মমতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিনি, আমি এও জানি না, কে এ চুক্তিতে বাধা দিয়েছে। এ কথা আমাদের সরকার বলছে। হাসিনাও তাই বলছেন।’
বিজেপি সরকার সীমান্তচুক্তি পাস করতে পারবে বলে মনে করেন কি- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘চুক্তিটি স্বাক্ষর হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বাংলাদেশ এটিকে সে বছরই অনুমোদন দেয়, কিন্তু ভারত এখনো সেটা করেনি। সীমান্তের মানুষগুলো অসহনীয় দুর্ভোগে দিন পার করছে। তারা দীর্ঘ সময় ধরে অনিশ্চিত এক জায়গায় বাস করছে। এটা আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে খুবই নেতিবাচক। এখন বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপি ক্ষমতায়, এটা আশা করা যায় যে, এ সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান হবে।’
বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ভারতের সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলো তৎপর হয়ে ওঠে কি- এমন অভিযোগের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এটা একটা ভুল ধারণা। এটা একটা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা, বিএনপি সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে এ প্রচারণা চালানো হয়। আমরা ভারতসহ যেকোনো প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আর এটা আমরা বাস্তবে প্রমাণ করেও দেখিয়েছি।’
সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘আমি সংখ্যালঘু শব্দটা পছন্দ করি না। আমি মনে করি- বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার রয়েছে। বিএনপি সরকারের সময় সবাই শান্তিতে ছিল। অবস্থা সবচেয়ে খারাপ আকার ধারণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। মন্দির ভাঙা হচ্ছে, কেউই নিরাপদ নয়।’
অবৈধ অভিবাসীদের ব্যাপারে মোদি সরকারের অবস্থানে আপনি কি উদ্বিগ্ন- এ প্রশ্নের জবাবে বিএনপি নেত্রী বলেন, ‘নির্বাচনী প্রচারণাকালে আমরা এ নিয়ে অনেক কথা শুনেছি। যেমনটা আমরা অতীতেও শুনেছি। কেউই প্রমাণ দিয়ে বলতে পারেননি বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীরা ভারতে বসবাস করছে। আর সুষমাও এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। নির্বাচনের সময় জয়ের জন্য মানুষ অনেক কথাই বলে, আমরাও অনেক কথা বলি। তার মানে এই নয় যে, যা বলা হবে তার সবই হবে। প্রচুর বাংলাদেশি ভারতে যাচ্ছে আমি এটা মনে করি না। বরং তারা এখানে বেশ ভালোই আছেন।’
জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তাদের সঙ্গে আদর্শিক কোনো ঐক্য নেই। বিএনপি একটি আধুনিক দল, আমরা না কট্টর ডানপন্থী, না কট্টর বামপন্থী। আপনারা যদি ইতিহাসের দিকে তাকান, দেখবেন, ১৯৮৬ সালে এরশাদ যখন নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন তখন আওয়ামী লীগ ও জামায়াত কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেছে। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচন কৌশলের জন্য। জামায়াত কিছু আসন থেকে নির্বাচন করে, আমরা কিছু আসন থেকে নির্বাচন করি। এর বাইরে আর কিছু নয়। তারা তাদের আদর্শে চলে, আমরা আমাদের আদর্শ অনুযায়ী চলি।’
সাক্ষাৎকারে রাজনীতিতে পরিবারের প্রভাবের বিষয়টি উঠলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাও মেনে নেন খালেদা। তিনি বলেন, ‘মুজিবুর রহমানের একটি ভূমিকা ছিল, জিয়াউর রহমানেরও ভূমিকা ছিল, সে জন্য তাঁদের পরিবারকে জনগণ শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে, তাঁদের ওপর জনগণ আস্থা রাখে।’