সুষমার পদতলে-
অস্থির একটা সময়ে আমরা বেড়ে উঠেছি। ছোটবেলায় একটা স্লোগান- খুব করে কানে বাজতো। ‘রুশ ভারতের দালালো হুঁশিয়ার সাবধান’। সে সময়কার ভারত ও রাশিয়া মিলে একটা জোট ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্ষমতার পালা বদলে তাদের বড় রকমের হাত থেকে থাকবে, সেখান থেকে এন্টি ইনডিয়ানরা এ স্লোগানের উৎপত্তি।
সময় বদলে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের পশ্চাৎদেশ নিজেরা মেরে রক্তাক্ত করেছে। মহা মৌলবাদী সমাজতন্ত্রীরা তাদের রীতিনীতি পাল্টেছে। পুঁজিবাদকে নানা রকমের তরিকায় জায়েজ করেছে সমাজতন্ত্রীরা। তাতে খারাপ কিছু হয়েছে বলে মনে করি না।
কারণ পুঁজি ছাড়া মানুষের লড়াই অসম্ভব। যদিও আমরা সবাই শ্রেণী বিভক্তির বিপক্ষে। কিন্তু এ কথা তো সত্য সবার মাথায় সমান ‘মাল’ থাকে না। যদি থাকতো তাহলে মাও সেতুং, চে, হো চি মিন কিংবা ফিদেলের মতো নেতা সব দেশেই হতো।
বাংলাদেশে একটি স্বাধীন দেশ- এ কথাটা আমরা পড়েছি। জেনেছি। সম্ভবত ১৯৯৪ কিংবা ১৯৯৫ সালের দিকে ভোরের কাগজের বর্ষ শুরু সংখ্যায় একটা লেখা লিখেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, এখনকার ‘রাবিশ’ মন্ত্রী। তার লেখার মূল ভাবনা ছিল- প্রযুক্তির কারণে বিশ্ব একটা গ্রামে পরিণত হবে। যেটাকে তিনি ইংরাজিতে ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বলেছিলেন।
সে সময় তিনি বলেছিলেন- রাষ্ট্রের সীমানা থাকবে, কিন্তু প্রযুক্তি সে সীমানা উতরে যাবে। কথা সত্য এবং সেটি আমরা এখন দেখছি। ‘রাবিশ’ মন্ত্রীকে আমি মনে রাখছি তার ভিশনারি চিন্তার জন্য। যদিও এখন সে চিন্তা ‘বন্ধক’ রাখা আছে।
ক্ষমতা নিয়ে কথা বলছিলাম। ক্ষমতার স্বাদটা ৩৫ কেজি ওজনের স্লিম তরুণীর মতো। যাকে কোলে পিঠে, বুকে, সব জায়গায় রাখা ও আদর করা যায়। এ কথাটা কেনো বললাম- বলছি। এ কারণে ক্ষমতার সাথে নারীর একটা সম্পর্ক আছে।
সাধারণত পুরুষরা, যাদের পকেটে মাল কড়ি জমে থাকে, তারা রাজনীতি, ক্ষমতা চর্চার সাথে সাথে নারী-শরীর নিয়ে মেতে থাকেন।
তবে এখানে নারীকে আমি প্রতীকীভাবে ক্ষমতার সাথে সংযুক্ত করেছি।
বাংলার মসনদ কার দখলে থাকবে; তা নিয়ে যুগে যুগে যুদ্ধ বিগ্রহ হয়েছে। প্রাণহানি হয়েছে। আমি যদি ভুল না করে থাকি তাহলে পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বাংলার মীর জাফররা লর্ড ক্লাইভদের মধ্যাঙ্গ চোষা প্রকাশ্যে শুরুর পর আমাদের লজ্জা-শরম সেই যে গেলো, তাকে আর ফেরানো গেলো না।
এ দেশের রাজনীতিতে সিরাজউদ্দৌলারা বীর ঠিকই তবে মীরজাফরদের চরিত্রটা অনুসরণ করে বঙ্গদেশের রাজনীতিকরা। নিজেদের সুবিধামত, সব কিছু সাজায়। প্লট তৈরি করে, ঘটনা ঘটিয়ে বলে আহা আমি আবার কী করলাম।
তবে মীরজাফরদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হয়েছে। এ যুগেরে মীর জাফররা পুরস্কৃত হচ্ছেন।
সে আলোচনা থাক না। যে কথা বলতে চাই- সুষমা স্বরাজ। নামটা অতিশয় সুন্দর। তার দল এখন ক্ষমতায়। যাদের একবার দু’বার দিল্লির বস্তিতে যাবার সুযোগ হয়েছে, তারা জানবেন সে দেশে বাংলা ভাষা বলার কারণে কলকাতার বাইরে বাংলাভাষিরাও কতটা নিপীড়িত।
সেই দল এখন নতুন মোড়কে ক্ষমতায়। ব্যবসায়ীদের প্রিয় দল বিজেপি। কিন্তু বাংলাদেশকে শোষন-চোষনে ভারত সব সময় আগের ভূমিকায় থাকবে, এটা নিয়ে কারো কোনো সংশয় নেই।
তারপরেও আমরা ভারতের দ্বারস্থ। কেনো এমন হচ্ছে তার জাবাব- নিশ্চয় ক্ষমতা।
অস্থিরতা সাব কন্টিনেন্টে ছিল সব সময়। ১৯৪৫ আগস্ট মাসে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান হলো। তারপর পাকিস্তানের শোষণে নিগৃহীত আমরা আলাদা হতে চাইলাম।
১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হলো একটি স্বাধীন দেশ- বাংলাদেশ। সে দেশের মেরুদণ্ড খাড়া করা নেতা বঙ্গবন্ধু খুন হলেন ১৯৭৫। এর সাথে ইন্ডিয়া ও আমেরিকার নেপথ্য ভূমিকা ছিল বলে দুর্মুর্খেরা বলে থাকেন। কিন্তু সেটি আমাদের বিশ্বাস করতে হয়- কারণ ১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ভারতের ভূমিকা ছিল- আছি, কিছু লাগলে খবর দিস টাইপের।
কংগ্রেস কিংবা বিজেপি একই খাঁচায় দুটো কাল সাপ। এরা ইনডিয়ান, আমাদের মত চোদনা না। যদি তাই হতো তাহলে এরা দেশের স্বার্থ সবার আগে দেখে। সে জন্য তারা অন্যায়, অবিচার , অমানবিকতারও আশ্রয় নেয়।
ওদের দেশ প্রেমের কাছে মানবিকতাও পরাজতি। ফারাক্কার বাঁধ, তিস্তার পানি আটকে রেখে এদেশের লক্ষ কোটি মানুষকে কাঁদানো দেশটি কখনোই অনুতপ্ত হয় না। বরং এটা ওটা নন্টে ফন্টে করে দিন গুজরান করে।
সীমান্তে মানুষ হত্যা করে গরুবেপারী বলে চালিয়ে দিয়ে নেয় দায়মুক্তি। কখনোবা চোরাকারবারী। বিএসএফ’র গুলিতে গরুবেপারী মারা যায়। কিন্তু মাদক কিংবা নারীপাচার বেপারীরা মারা যায় না।
সেই দেশের সুষমা স্বরাজ এসেছেন। তাকে আমরা অভিনন্দন জানাই। কিন্তু তাকে ঘিরে রাজনীতি ও মিডিয়ার যে বিকার দেখলাম, তাতে নিজেকে একজন বাংলাদেশি হিসাবে খুব অসহায় মনে হলো।
সুষমা স্বরাজের সাথে দেখা করার জন্য সবাই উদগ্রীব। রুশ ভারতের দলালেরা হুঁশিয়ার সাবধান স্লোগান নিপাত গেছে। বিম্পি নেত্রী সোনারগাঁ হোটেলে ছুটে গেছেন। দেশের খারাপ অবস্থার কথা তার কাছে বলেছেন। এটাকে ‘নালিশ’ হিসাবে দেখেছেন অনেকে। দেখবেন- তাতে অপরাধ নেই।
আম্লীগ নেত্রী আরো সুসম্পর্ক চেয়েছেন। জামদানি পাঠিয়েছেন। রসুন ম্যাডামও তার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। জামাত তার সাক্ষাতের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। এরশাদ কাগুরে ৫ জানুয়ারী হারাম ইলেকশন হালাল করার জন্য দাবিনামা সই করতে বাধ্য করা সুজাতা আফার সফরের পর এবার গোণায় ধরা হয়নি বলে তার মনে আফসোস।
এ রকম একজন লোক সুষমা যার সাক্ষাৎ এতো লোভলীয় এবং তার কাছে সব আবদার, বিচার-আচার-সালিশ। এরপরেও নিজের দেশের রাজনীতিকদের বিবেক উন্মুক্ত, ক্ষমতার কোনো লোভ নাই জাতীয় শব্দমালা কেমন শোনায় বলুন তো? সানি লিওনের ‘আমি ভার্জিন’ বাক্যটার সাথে এর কি কোনো ফারাক আছে? আমার কাছে নেই।
এরপর সুষমার সফর নিয়ে মিডিয়া যে যার অনুগত দলের চামচামির সুযোগ নিলো। কী নোংরা মনোবৃত্তি দেখালাম!
আমরা জনগণ কে? আমাদের কথা কে শোনে? বিম্পি, আম্লীগ, জাতীয় পার্টি, না জামাত? তাহলে আমরা কি করবো? আসলেই কী করবো? কিছু না। কারণ আমাদের হাতে কিছু টাকা জমেছে। আমোদ-ফূর্তির আয়োজন আছে। সে সবে ডুবে থাকো। আর দেশ গোল্লায় যাক। তাতে কার বাপের কি?
পেটি ক্যাশ পাওয়ার ধান্ধায় ব্যস্ত আমরা। ফাঁকে রাজনীতিকরা দেশের সম্মান, সম্ভ্রম, সার্বভৌমত্ব লুটিয়ে দিচ্ছেন অন্যের পদতলে। কী লজ্জা, অপমান! কিন্তু আমাদের সে সব সয়ে গেছে। কারণ ঐশ্বরিয়ার কন্যা আরাধ্যা এখন কেমন আছে, ক্যাটরিনার বুকের মাপ কতো, সানি লিওন সামনে কোন সিনেমায় আসছেন- এ সব হিসাব করেই তো শেষ করতে পারছি না। দেশ নিয়া ভাববো কখন!