শেরপুরে ভরা বর্ষায় মাছ সংকট চরমে॥ নেই মাছ উৎপাদনের কোন উদ‌্যেগ

15এককালের মাছের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত শেরপুর এখন প্রায় মৎস্য শূন্য হয়ে পড়েছে। চাহিদার তুলনায় বর্তমানে যে সামান্য মাছ বাজারজাত হয় তা সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। এখন এখানে মাছের দাম স্বর্ণের দামের সঙ্গে তুলনীয়। আষাঢ় মাস শেষ হতে চললো, এই ভরা বর্ষাতেও মাছের চরম সংকট দেখা দিয়েছে শেরপুরে। এক দিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের বিভিন্ন ঋতুর পরিবর্তন ঘটেছে, যেমন বর্ষা মাসে বৃষ্টি নেই, আবার মওসুম ছাড়া প্রচুর বৃষ্টিপাত ইত্যাদি। অন্যদিকে জেলার বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ে পানি সংকটের কারণে মা মাছ সময় মতো ডিম ছাড়তে পারছে না তার উপর জেলার এসব নদ-নদী, হাওর-বাওর, খাল-বিল ও পুকুর-জলাশয় দিনে দিনেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বর্ষা মওসুমে যখনই জেলার বিল-হাওর ও জরাশয়ে একটু পানি জমে মা মাছেরা ডিম ছাড়ে বা পেনা মাছ ছুটাছুটি করতে শুরু করে তখনই জেলার কতিপয় মৎস্য শিকারি ও অসাধু মাছ ব্যবসায়ী হুমরি খেয়ে পড়ে ওইসব বিল-হাওর এবং জলাশয়ে। ফলে দিন দিন মাছের প্রজনন শূণ্যতার দিকে যাচ্ছে। এতে করে মাছের আকাল দিন দিন চরম আকার ধারন করছে। সরকারী ভাবেও এ ব্যপারে চোখে পড়ার মতো কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
বর্তমানে সারা দেশে চলছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ। জেলা মৎস্য অফিস থেকে নাম মাত্র বিভিন্ন পুকুর আর জলাশয়ে সামন্য কিছু মাছের পোনা অবমুক্ত করেই খালাশ হচ্ছেন তারা। অথচ জেলার প্রত্যন্ত ও বিভিন্ন বিল-হাওরে কারেন্ট জালের মাধ্যমে পোনা মাছ ধ্বংশ করা হলেও সে দিকে নজর নেই তাদের।

14
স্থানীয় মৎস্য বিভাগ থেকে জেলায় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির চমকপ্রদ ফিরিস্তি পাওয়া গেলেও তা সংশি¬ষ্ট বিভাগের ফাইলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি না পাওয়ায় মাছের জোগান প্রতিদিনের চাহিদার তুলনায় হ্রাস পাচ্ছে। একদিন দেশের অন্যান্য স্থান থেকে মাছের আমদানি না হলে জেলার মৎস্য ব্যবসায়ীদের ব্যবসা অচল হয়ে পড়ে। খাল-বিল সমৃদ্ধ প্রায় ১৪ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত শেরপুর জেলার মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুসারে মাছের বার্ষিক চাহিদা ২৭ হাজার ২৬৬ মেট্রিক টন। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয় ১৭ হাজার ৪৫১ ম্যাট্রিক টন। এতে ঘাটতি দেখানো হয়েছে ৯ হাজার ৮১৫ মেট্রিক টন। তবে চাহিদা ও ঘাটতির পরিমান আরো কয়েকগুন বেশী হবে মৎস বিষেজ্ঞরা অভিমত ব্যাক্ত করেছেন। মাছের চাহিদা ও জোগানের এ বিরাট ঘাটতি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আমদানি করে পূরণ করা হয়।

17সরকারি হিসাব মতে, জেলায় নদ-নদীর সংখ্যা ১২টি। এর আয়তন ১ হাজার ৩৯৮ হেক্টর। বিলের সংখ্যা ৩২টি, মৎস্য চাষের আওতাধীন সরকারি পুকুরের সংখ্যা ৭২টি এবং বেসরকারি পুকুরের সংখ্যা ২৯ হাজার ১৮৬টি, অভয়াশ্রম ২৩টি। এ ছাড়া ১টি সরকারি মিনি হ্যাচারি ও বেসরকারি ৫টি মিনি হ্যাচারি, ৯টি বীজ উৎপাদন খামার ও ১৫২ টি ছোট ছোট রেণু পোনা উৎপাদন নার্সারী রয়েছে। প¬াবন ভূমি রয়েছে ৬ হাজার ৪১৪ হেক্টর, সেখানে বছরে তিন থেকে ছয় মাস পানি থাকে। জেলায় মৎসজীবীর সংখ্যা রয়েছে ৫ হাজার ৭৩৭ জন। এরমধ্যে সার্বক্ষনিক ৪ হাজার ৬৫৩ জন এবং খন্ডকালিন ১ হাজার ৮৪ জন মৎস্যজীবী রয়েছে। এ বিপুল জলমহাল থাকা সত্ত্বেও জেলায় মাছ চাষ বাড়ছে না। শুধু মৎস্য বিভাগের নিষ্ক্রিয়তার কারণে এক সময়ের মাছের অঞ্চল হিসেবে খ্যাত শেরপুর আজ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে। অথচ এক সময়ের মালাঝি নদীর ঠোঁট রাঙা রূপালী পাবদা, ভাগনা, সরপুঁটি, বাচা, মৃগী নদীর বোয়াল, আইড়, দশানী ও ব্রহ্মপুত্র নদের রুই, কাতল, চিতল, কর্তী এবং বয়সা ও চুয়া বিলের রাঙা পেটের কৈ মাছ এখন প্রৌঢ় ও বৃদ্ধদের কাছে রসনাসিক্তকর শুধু মধুর স্মৃতি আর নবপ্রজšে§র কাছে গাল-গল্প। মাছের উৎপাদন হ্রাসের ব্যাপারে স্থানীয় মৎস্য চাষীদের অভিযোগ, বর্তমানে জেলার প্রধান নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়গুলো প্রকৃত জেলেদের হাতে নেই। এ ছাড়া নদ-নদী, খাল-বিল ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং ক্ষেতে-খামারে কীটনাশক ব্যবহারের কারণেও মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। অন্য দিকে বিদেশী রাক্ষুসে প্রজাতির মাছ চাষের কারণেও দেশী প্রজাতির মাছ দ্রুত বিলুপ্ত হচ্ছে। অপরদিকে জেলার একমাত্র ইন্দিলপুর সরকারি মিনি হ্যাচারিটিও বিদ্যুৎ সংযোগ এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে অচল হয়ে পড়ে আছে। এ প্রসঙ্গে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জানান, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে খরা পরিস্থিতি চলার ফলে এবং পলি জমে ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এখানকার নদী ও খাল-বিলগুলোতে পানির প্রবাহ কমে গেছে। ফলে মুক্ত জলাশয়গুলোতে মাছের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।

16জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা আকন্দ জানান, কারেন্ট জাল ব্যবহার বন্ধের লক্ষ্যে শীঘ্রই মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান চালানো হবে। এছাড়া বিভিন্ন জলাশয়ে পোনা মাছ অবমুক্ত করার কোন ফান্ড এখনও পাওয়া যায়নি। ফান্ড পাওয়ার চেষ্টা চলছে। ফান্ড পেলে পোনা মাছ অবমুক্ত করে বিল ও মুক্ত জলাশয়ে মাছ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হবে। এছাড়া বিভিন্ন নদী, খাল, বিল ও মুক্ত জলাশয় ভরাটের ব্যাপারে মৎস বিভাগের কিছু করার নেই বলে তিনি জানান। এ বিষয়টি সরকারের রাজস্ব বিভাগ দেখে থাকেন।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend