দুবাইয়ে বাংলাদেশী নারীদের দিয়ে দেহ ব্যবসার ফাঁদ
মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ে বাংলাদেশী নারী কর্মীদের দেহ ব্যবসায় বাধ্য করছে একটি চক্র। ওই চক্রটি ভাল কাজ দেয়ার কথা বলে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে নারী কর্মীদের দুবাই পাঠায়। তারপর নির্যাতন করে ওই নারীদের অসামাজিক কাজ করতে বাধ্য করে। এমন প্রতারণার শিকার হয়ে দেশে এসেছেন এমন একজন নারী জানিয়েছেন প্রতিনিয়ত সেখানকার দালালচক্রের শিকার হয়েছেন অসংখ্য নারী। তাদের কেউ দেশে ফিরেছেন। আবার কেউবা দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ফকিরাপুলস্থ মিনার এয়ার ট্রাভেলস এর অধীনে সমপ্রতি ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার শংকরপাশা গ্রামের ‘এস’ (৩০) আদ্যক্ষরের গৃহবধূ ও তার খালাতো বোন ‘আর’ (২৬) আদ্যক্ষরের তরুণী দুবাই যান। স্বামী কবির হোসেন স্বপ্ন দেখছিলেন দিন ফেরানোর। স্ত্রীকে দুবাই পাঠিয়ে নিজেও কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবেন। দুবাইয়ের নাগরিকত্ব পাবেন। দু’জনের আয়ে সচ্ছল জীবনযাপন করবেন। উপরন্ত দেশে কিছু টাকা পাঠিয়ে মাস শেষে কিছু সঞ্চয়ও করার চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে দুবাই থেকে গত ২৭শে জুন দেশে ফিরে এসেছেন কবির হোসেনের স্ত্রী। এসেছেন ঠিকই, তবে সম্ভ্রম হারিয়ে। একেবারে নিঃস্ব হয়ে। এখন যে অবস্থায় কবির ও তার স্ত্রী জীবন কাটাচ্ছেন তার নাম ‘যন্ত্রণা’।
একে তো লোকলজ্জার ভয়। অন্যদিকে স্ত্রীর এই অবস্থা। এ নিয়ে থানায় অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালীদের চাপে মামলা নেয়নি পুলিশ। বিচার না পাওয়ার হতাশা ও লোকলজ্জার ভয়ে কবির হোসেন স্ত্রীকে নিয়ে যাযাবর জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে নির্যাতিতা গৃহবধূর খালোতো বোনের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ মেলেনি। ধারণা করা হচ্ছে দুবাইয়ের অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেছে সে। তাকেও দেহব্যবসায় বাধ্য করা হয়েছে। দেশে ফিরে ঐ গৃহবধূ দুবাইয়ে বাংলাদেশী নারী কর্মীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। খুব কাছ থেকে দেখেছেন দিন ফেরানোর আশায় দুবাই যাওয়া বাংলাদেশী তরুণী ও গৃহবধূদের ওপর নির্যাতনের চিত্র।
ভুক্তভোগীর স্বামীর বক্তব্য: পল্টন থানায় দাখিলকৃত গৃহবধূর স্বামী কবির হোসেনের অভিযোগ থেকে জানা যায়, ট্রাভেল এজেন্সি মিনার এয়ার ট্রাভেলসের মাধ্যমে ‘এস’ ও ‘আর’ আদ্যক্ষরের দুই খালাতো বোন গত ৭ ও ৯ জুন দুবাইয়ে যান। ‘এস’ আদ্যক্ষরের নারীর স্বামী কবির হোসেন জানান, ‘আমার স্ত্রী ও তার খালাতো বোনকে দুবাইয়ে পাঠাতে মিনার এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনকে দুই কিস্তিতে মোট ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা দিয়েছি। আমাদের বলা হয় দুবাইয়ে গিয়ে তারা ক্লিনারের কাজ করবেন। মাস শেষে ৪৫ হাজার টাকা বেতন পাবে। সঙ্গে ওভারটাইম, বাড়তি সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। এমনকি ক’দিন পরে আমাকেও নিয়ে যাবে। কবির জানান, গত ৯ই জুন আমার স্ত্রীকে ও ৭ই জুন তার খালাতো বোনকে দুবাইয়ে পাঠানো হয়। ১১ই জুন আমার স্ত্রী মোবাইলে জানায়, বাংলাদেশী যে এজেন্সির মাধ্যমে তাদের পাঠানো হয়েছে তারা দুবাইয়ের এক দালালের কাছে তাকে ও তার খালাতো বোনকে বিক্রি করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তাদেরকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করাচ্ছে। কবিরের দায়েরকৃত অভিযোগ থেকে জানা যায়, ১৪ই জুন এ বিষয়ে পল্টন থানায় একটি অভিযোগ দাখিল করেন কবির। তাতে মিনার এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন ও শহীদ হোসেন, মোতালেব হোসেন, শাকিব হোসেনকে দায়ী করা হয়। এ বিষয়ে পুলিশ মিনার এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেনকে চাপ দেয় কবিরের স্ত্রী ও তার খালাতো বোনকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। ১৪ই জুন পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) ওবায়দুর রহমানের উপস্থিতিতে আনোয়ার হোসেন এ বিষয়ে একটি অঙ্গীকারনামা দাখিল করেন। তাতে আনোয়ার উল্লেখ করেন, পরবর্তী ৭ দিনের মধ্যে ভুক্তভোগী দুই তরুণীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু আনোয়ার কথা রাখেনি। গৃহবধূ ফিরে এলেও তার খালাতো বোনের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কবির জানান, গত ২৭শে জুন সকালে আমার স্ত্রী দেশে ফিরে আসে। তখন তার অবস্থা ছিল বিধ্বস্ত ও সঙ্কটাপন্ন। আমাকে সে জানায়, তাকে একের পর এক যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। সেখানে অবস্থা সঙ্কটাপন্ন হলে স্ত্রীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। গত মঙ্গলবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র দিয়েছে।’ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ডাক্তারি ছাড়পত্রে দুবাইয়ে নির্যাতিত ঐ গৃহবধূকে ‘সেক্সুয়াল অ্যাসাল্ট’-এর শিকার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যৌন নিগ্রহের ফলে তার শরীরে এইচআইভি’র (এইডস) জীবাণু আছে কিনা তা শারীরিক পরীক্ষার পর জানা যাবে। তবে সে এখন সুস্থ হলেও ঘটনার ভয়াবহতা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
নির্যাতিতা নারী যা বলেন: ভুক্তভোগী ওই নারী মানবজমিনকে বলেন, ৭ই জুন দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে একটি মাইক্রোবাসযোগে আমিসহ ১২ জন নারীকে বাংলাদেশী সাইফুল ইসলাম নামের একজনের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখান থেকে তিন-চারজন করে ভাগ করে বিভিন্ন অফিসে পাঠানো হয়। আমাকেসহ ৪ জনকে নাইজেরিয়ান এক মহিলার কাছে তুলে দেয় সাইফুল। সঙ্গে ছিল সাইফুলের স্ত্রী খায়রুন। আমি তখনও কিছুই বুঝতে পারিনি। সাইফুল ও তার স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায় সবকিছু ঠিক আছে। দু’দিনের মধ্যে তোমরা কাজে যোগ দেবে। আমাকেসহ ৪ জনকে নাইজেরিয়ান ওই মহিলার তিনতলার একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বাড়িতে প্রবেশ করেই কিছুটা সন্দেহ হয়। দেখি আমাদের মতো আরও অনেক তরুণী। তাদের পোশাক আঁটসাঁট ও আপত্তিকর। ১০ জন সবাই বাংলাদেশী তরুণী। তাদের সবার বয়স পঁচিশ থেকে ৩৫-এর মধ্যে। সাইফুলের স্ত্রী খায়রুন আমাকে নাইজেরিয়ান ওই মহিলার কাছে সোপর্দ করে (পরে জানতে পারি আফ্রিকান ঐ মহিলা আসলে ‘মক্ষীরানী’।
তার কাছে আমাকে বাংলাদেশী টাকায় ১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে)। কিছুক্ষণ পরেই আমাকে একটি সুসজ্জিত কক্ষে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সেখানে বিছানায় দেখি একজন ভিনদেশি পুরুষ আপত্তিকর অবস্থায় বসে আছে। এরপর একে একে ওই কক্ষে ৮ জন পুরুষ প্রবেশ করে। এদের মধ্যে আফ্রিকান কিছু লোক ছিল। এতে আমি ভয়ে ওই রুমে প্রবেশ করতে চাইনি। কিন্তু সাইফুলের স্ত্রী খায়রুনসহ দুই-তিনজন তরুণী মিলে আমাকে টেনেহিঁচড়ে রুমে নিয়ে যায়। এরপর আমাকে জোর করে এক ধরনের ওষুধ খাওয়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। ভুক্তভোগী নারী আরও বলেন, প্রথমে ওই পুরুষ আমার ওপর হামলে পড়ে। একে একে ৮ জন আমাকে পাশবিক নির্যাতন করে। প্রথম দিনেই কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সংজ্ঞা হারাই। রক্তপাত শুরু হয়। তবুও পাষণ্ডরা ক্ষান্ত হয়নি। এভাবে চলে ৮ দিন। খাওয়া নেই, ঘুম নেই। কেবলই শরীরের ওপর নির্যাতন। প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ জন আমাকে ব্যবহার করে। আমন্ত্রিতদের খুশি করতে না পারলে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যেতো। ভুক্তভোগী ওই গৃহবধূ বলেন, ওখানে (দুবাই) দেহ ব্যবসায় বাংলাদেশী নারীদের চাহিদা বেশি। সাইফুল নারী পাচারকারীচক্রের হোতা। দুবাইয়ে তার তিন স্ত্রী রয়েছে। তিনজনই বাংলাদেশী। তারাও দেহ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। নির্যাতিতা গৃহবধূ বলেন, ২০শে জুন পল্টন থানা থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমার সঙ্গে কথা বলেন। তখন তাকে শুধু বলেছি আমাকে দিয়ে এখানে দেহব্যবসা করানো হচ্ছে। এখান থেকে আমাকে নিয়ে যান। দেশে ফিরে সব বলবো। নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূর দাবি, দুবাইয়ে যেখানে তাকে দিয়ে দেহব্যবসা করানো হয়েছে সেটি বাংলাদেশী নারীদের দেহ ব্যবসার কেন্দ্র। ওই বাড়িতে তিনি যেসব তরুণী ও গৃবধূদের দেখেছেন তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশী। সচ্ছলতার আশায় দুবাই গিয়ে দেহ ব্যবসা করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তাদেরকে ১ থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে। এদের মধ্যে কুষ্টিয়ার রত্না (ছদ্মনাম) নামে এক তরুণী কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছেন। তবে তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেনি। এছাড়া ঢাকার মিরপুরের আঁখি ও কুমিল্লার রাজিয়াসহ আরও অন্তত আট থেকে দশজন এ বাড়িটিতে দেহব্যবসায় নিযুক্ত রয়েছে। তারাও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
জানতে চাইলে মিনার এয়ার ট্র্যাভেলসের স্বত্বাধিকারী আনোয়ার হোসেন উল্টো কবির হোসেনকে নারী ব্যবসায়ী বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমি নিজের উদ্যোগে ওর স্ত্রীকে ফেরত এনেছি। যদি আমার কোন সমস্যা থাকতো তাহলে তো আমি তাকে ফেরত আনতে পারতাম না। এ বিষয়ে কবির হোসেন বলেন, মান, সম্মান, অর্থ সব হারিয়ে ফেলেছি। ভাই আমরা এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অনেক আশা নিয়ে স্ত্রীকে দুবাই পাঠিয়েছিলাম। স্বপ্নতো শেষ হলোই, সেই সঙ্গে মানসিক যন্ত্রণাও বাড়লো। এ বিষয়ে পল্টন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওবায়দুর রহমান বলেন, মামলা না নেয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। কবির হোসেনের অভিযোগ পাওয়ার পর পরই সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহযোগিতা ও আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে তার স্ত্রীকে দেশে ফেরত এনেছি। ও যাতে ক্ষতিপূরণ ও ন্যায় বিচার পায় সেজন্য চেষ্টা করেছি। এখন কেউ যদি এসব বিষয় স্বীকার না করে তাহলে তো আমাদের করার কিছুই নেই।
পল্টন থানাকে মামলা নেয়ার নির্দেশ: এদিকে ভুক্তভোগী ওই নারীর স্বামীর দায়ের করা মামলা পল্টন থানার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এনামুল হক ভূঁইয়া। গত বৃহস্পতিবার ভুক্তভোগীর স্বামী কবির হোসেন এই আদালতে একটি অভিযোগ দাখিল করেন। উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শেষে আদালতের বিচারক এ মামলাটি নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য পল্টন থানাকে নির্দেশ দেয়।