উন্নয়ন ও উদার গণতন্ত্র পরস্পরবিরোধী নয় -এবনে গোলাম ছামাদ
সারা বিশ্বে বাম আন্দোলনে ধস নেমেছে; কিন্তু বাংলাদেশে বাম চিন্তার এখনো বেশ কিছুটা সতেজ প্রবাহ বিদ্যমান থাকতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে কিছু কথিত বাম বুদ্ধিজীবী বোঝাতে চাচ্ছেন উদার গণতন্ত্র একটা বুর্জুয়া ব্যাপার। এর মাধ্যমে দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এক দলের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর এই এক নেতৃত্বে হতে হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এই দলটিকে হতে হবে শ্রেণিসংগ্রামের দর্শনে আস্থাশীল।
সারা বিশ্বে এখন শ্রেণিসংগ্রামবাদী বাম চিন্তার আবেদন আগের মতো হয়ে নেই। ১৯৯১ সালে ভেঙে পড়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর চীন এখন অনুসরণ করছে বাজার অর্থনীতি। খোদ রাশিয়ায় মানুষ এখন চাচ্ছে বহুদলীয় উদার গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। অন্য দিকে চীনে কম্যুনিস্টরা মতায় থাকলেও দেশটাতে এখন চেষ্টা চলেছে বেশ কিছুটা ধনতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাওয়ার। চীনের এই নীতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেশ কিছুুটা সহায়ক হতে পেরেছে বলেই মনে হয়। তবে চীনেও ভেতরে ভেতরে চলেছে বহুদলীয় গণতন্ত্রের আন্দোলন। হয়তো দেখা যাবে চীনেও এক দলের রাজত্ব আর থাকল না; কিন্তু বাংলাদেশে বলা হচ্ছে এক দলের রাজত্ব গড়ার কথা। ক’দিন আগে (৩ আগস্ট ২০১৪) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় পড়লামÑ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন, ‘আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র’। এটা সেই পুরনো কথিত মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশকে কতটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তা বিশেষ জিজ্ঞাসার ব্যাপার। প্রথমেই বলতে হয়, মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ সমার্থক নয়। মার্কসবাদের করা যেতে পারে একাধিক প্রকার ব্যাখ্যা। মার্কস অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উৎপাদনী শক্তির ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছেন। উৎপাদনী শক্তি বলতে মার্কস বুঝিয়েছেন, উৎপাদনকর্মে নিযুক্ত কাজজানা ব্যক্তি, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং শ্রমের হাতিয়ারকে। ইউরোপ এগিয়েছে কলকারখানার বিপ্লøবের মাধ্যমে। অর্থাৎ নতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করতে পারার ফলে; যা চলেছে মানুষের কায়িক শক্তির দ্বারা নয়, বাষ্পশক্তির দ্বারা। বিলাতে কয়লা ও লোহার খনি থেকেছে কাছাকাছি। এই কয়লা ও লোহা দিয়ে বানানো সম্ভব হয়েছে যন্ত্রপাতি। কয়লা উৎপাদন করেছে তাপশক্তি, যা দিয়ে উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে পানি ফুটিয়ে বাষ্প। আর বাষ্প দিয়ে চালানো সম্ভব হয়েছে নানা যন্ত্রপাতি, যা ব্যবহার করা হয়েছে জিনিসপত্র তৈরির েেত্র। এশিয়ায় এই যন্ত্রবিপ্লব ঘটেনি। ফলে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সে ইউরোপ থেকে পড়েছে পিছিয়ে। এ হলো অর্থনীতির এক দিকের বাস্তবতা। আর একদিকের বাস্তবতা হলো উৎপাদনী সম্পর্ক।
মানুষের সভ্যতার অগ্রগতি ঘটেছে উৎপাদনী শক্তির বিকাশের ফলে। আর সেই সাথে ঘটেছে উৎপাদনী সম্বন্ধেরও নানা রূপান্তর। সমাজে সৃষ্টি হয়েছে শ্রমবিভাজন। তাঁতি বানিয়েছেন কাপড়, আর কৃষক ফলিয়েছেন ফসল। কৃষক তার উৎপাদিত ফসলের এ অংশ প্রদান করেছেন তাঁতিকে আর তাঁতি তার বিনিময়ে কৃষককে দিয়েছেন কাপড়। এ হলো উৎপাদনী সম্পর্কের একটি বিশেষ নমুনা। অর্থনীতি যতই জটিল হয়, উৎপাদনী সম্পর্ক হতে থাকে ততই জটিল। বিলাতে কলকারখানার অর্থনীতি সৃষ্টি হওয়ার পর এক দিকে দেখা যায় কলকারখানার মালিক শ্রেণীর উদ্ভব হতে, অন্য দিকে দেখা যায় শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব হতে। শ্রমিক শ্রেণী কারখানার মালিকের কাছে শ্রমশক্তি বিক্রি করে পায় মজুরি; কিন্তু যথেষ্ট মজুরি নয়। ফলে তারা একদিন বিদ্রোহ করে ঘটাবেন সমাজবিপ্লব। তবে মার্কস আবার একথাও বলেছিলেন যে, বিলাতে শ্রমিক-মজুররা গণতান্ত্রিক উপায়েও মালিক শ্রেণীর প্রভুত্বকে খর্ব করে মতা দখল করতে পারে। মার্কস বিলাতের চার্টিস্ট (Chartist) আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। চার্টিস্টদের দাবি ছিল প্রাপ্তবয়স্ক সব পুরুষের ভোটাধিকার। গোপনে ভোট দেয়ার অধিকার। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন ও পার্লামেন্টের অধিবেশন। পার্লামেন্টের সদস্যদের বেতন প্রদান। মার্কস ছিলেন ভোটের পক্ষে অর্থাৎ মার্কস মনে করেছিলেন বিলাতে শ্রমিক শ্রেণী ভোটের মাধ্যমে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে; কিন্তু মার্কসের শিষ্য হিসেবে দাবিদার ভ্লাদিমির লেনিন মনে করতেন বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রিক মতা দখল করতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনা করবে কেবল কম্যুনিস্টরা। তাদের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠা পাবে শ্রেণিহীন সমাজ।
আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের আগ দিয়ে বলেছে, দেশে উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা; কিন্তু ১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগের নীতির পরিবর্তন ঘটে। শেখ মুজিব গড়েন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর বলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতির পরিবর্তে দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয় এবং দেশের সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে একক রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠন করা হয়। বাকশালে যোগ দেয় মণিসিংহের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ কম্যুনিস্টা পার্টি এবং অধ্যাপক মুজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ। বাকশাল গঠন করার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম্যুনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ল ই ব্রেজনেভের সাথে আলোচনা করেন। ব্রেজনেভের পরামর্শেই তিনি গঠন করেন বাকশাল; কিন্তু আওয়ামী লীগের সবাই বাকশাল গঠনকে সমর্থন করেন না। আওয়ামী লীগ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। সেনা বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটায় আওয়ামী লীগেরই এক অংশের সহযোগিতায়।
বর্তমানে আওয়ামী লীগে এ রকম বিভক্তি আছে কি না আমরা জানি না। তবে আগে উন্নয়ন ও পরে গণতন্ত্র অনেকের মনেই জাগিয়ে দিচ্ছে বাকশাল গড়ার স্মৃতি। যখন বাকশাল গঠন করা হয়, তখন মাত্র চারটি সরকারি সংবাদপত্র ছাড়া আর সব সংবাদপত্র প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ রুদ্ধ করে দেয়া হয় মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে। আজ আওয়ামী লীগ যা বলছে, তাতে মানুষের বাক ও ব্যক্তিস্বাধীনতা কত দূর বজায় থাকতে পারবে সেটা নিয়েও জাগছে জিজ্ঞাসা। শেখ মুজিব ভেবেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে পারবেন; কিন্তু বর্তমানে ঘটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি। রাশিয়ার অর্থনীতি এখন আর বাংলাদেশকে সাহায্য করার মতো অবস্থায় নেই। সে এসে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেনের সাথে একটা বড় রকমের সঙ্ঘাতের মধ্যে; কিন্তু তথাপি রদ্দি কম্যুনিস্ট কায়দায় আওয়ামী লীগকে বলতে শোনা যাচ্ছেÑ আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র; কিন্তু বর্তমান বিশ্বে যেসব দেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে আছে তাদের মধ্যে একমাত্র চীন ছাড়া আর সব ক’টি রাষ্ট্রেই বিরাজ করছে উদার গণতন্ত্র। উদার গণতন্ত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হলে এসব দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ত; কিন্তু তা পড়ছে না। তাই বলতে হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদার গণতন্ত্র একে অপরের পরিপন্থী নয়; বরং উদার গণতন্ত্রে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা বজায় থাকে। আর ব্যক্তি-উদ্যোগে হতে পারে একটা দেশের অর্থনীতির বিকাশ। তাই সিদ্ধান্ত করা চলে না, উদার গণতন্ত্র বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বিকাশের েেত্র প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। অন্য দিক থেকে বলা যায়, আজকের দিনে সব রাজনৈতিক দলই চায় দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। কোনো একটিমাত্র দল তাই দাবি করতে পারে না, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমমোক্তারনামা। সব দলেরই থাকতে হবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশ নেয়ার অধিকার। গণতন্ত্রের সাথে আইনের শাসনের ধারণা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের মাধ্যমে আসতে পারে আইন পরিষদ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে মতার ভারসাম্য। এক দলের রাজত্বে বিচার বিভাগ হয়ে পড়তে চায় মতাসীন দলের আজ্ঞাবহÑ যার ফলে একটা দেশের সুবিচার লাভ দুর্লভ হয়ে পড়ে।