শিক্ষকের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু -আনিছুজ্জামান

শিক্ষকের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধু -আনিছুজ্জামান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পড়েছেন কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক ছিলেন সাইদুর রহমান। ইসলামিয়া কলেজে তখন মুসলিম শিক্ষার্থীরাই পড়াশোনা করত। আই এইচ জুবেরি ছিলেন কলেজের অধ্যক্ষ। পরবর্তী সময়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য হয়েছিলেন। সাইদুর রহমান কলকাতার বেকার হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে তিনি হোস্টেলে এবং ক্লাসরুমে খুব কাছে থেকে দেখেছেন। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে সাইদুর রহমান ‘শতাব্দীর স্মৃতি’ নামক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ছাত্র হিসাবে শেখ মুজিব তেমন মেধাবী না হলেও রাজনীতিতে, বিশেষ করে সংগঠক হিসেবে সে ছিল অত্যন্ত দক্ষ। সে যে একদিন জননেতা হবে, সেটা তখন থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল। তবে এত বড় নেতা হবে অতটা ধারণা করা যায়নি।’ কলেজের শিক্ষার্থী হিসেবেই তখন তিনি ছাত্র এবং জাতীয় রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ক্লাসরুমের চেয়ে রাজনীতির মাঠ তাঁর প্রিয়। রাজনীতির মধ্য দিয়ে মানুষের সেবা তাঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দী ও মুসলিম লীগের সমর্থক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দৃঢ়তা ও দক্ষতার কারণেই বাঙালি জাতি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ পেয়েছে। আর তিনি পরিণত হয়েছিলেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নেতায়।
্বক্ততবকত
কলকাতার বেকার হোস্টেলে রাত ৯টার মধ্যে ফেরা বাধ্যতামূলক হলেও বঙ্গবন্ধু ফিরতেন অনেক দেরি করে। রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন শেষে তাঁকে ফিরতে হয়েছে। হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট তাঁকে প্রথমে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টকে বলেছিলেন, তাঁর পক্ষে রাত ৯টার মধ্যে ফিরে আসা সম্ভব নয়। কারণ তাঁর বাইরে কাজ থাকে। সাইদুর রহমান খোঁজ নিয়ে জানলেন, রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে সত্যিই তাঁর আসতে দেরি হয়। বঙ্গবন্ধুকে তিনি দেরি করে হোস্টেলে ফেরার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যেকোনো পরিস্থিতিতে সত্য কথা বলতেন।

বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তার কারণেই বেকার হোস্টেলে থাকা অবস্থায় শিক্ষকরা তাঁকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। সাইদুর রহমানের ভাষায়, একরোখা স্বভাবের হলেও মন ছিল তাঁর পরিষ্কার। আপসের নীতি বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে ছিল না। সমস্যা যত কঠিনই হোক তিনি দৃঢ়তার সঙ্গেই তা মোকাবিলা করতেন। পলায়নপর নীতি তিনি কখনো অনুসরণ করেননি। তাঁর ছিল দুর্দান্ত সাহস এবং অসাধারণ নেতৃত্বের গুণাবলি। সাইদুর রহমান ছাত্র সম্পর্কে মূল্যায়ন করে লিখেছেন, ‘অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সৎসাহস ও দৃঢ় মনোবলই শেষ পর্যন্ত মুজিবকে বাঙালি ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতার মর্যাদা এনে দিয়েছে।’

ইসলামিয়া কলেজ কর্তৃপক্ষ ১৯৪৫ সালে ৪০ জন শিক্ষার্থীকে টেস্ট পরীক্ষা ছাড়াই আইএ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের একজন। তাঁদের বেশির ভাগই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পরীক্ষা দিতে পারেননি। পুঁথিগত বিদ্যা অর্জনের চেয়ে তাঁরা মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করতেন। জীবন থেকে তাঁরা শিক্ষা নিয়েছেন; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে তাঁরা কখনো অবহেলা করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের সম্মান করতেন। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি সে সময়ের কথা উল্লেখ করে সাইদুর রহমান লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় লক্ষ করতাম, সে তার একসময়কার শিক্ষকের জন্য কোনো কিছু করতে পারলেই যেন খুশি।’ শিক্ষকের ভাষায়, বঙ্গবন্ধু ‘জনসেবা থেকে ছাত্র সংগঠন, যা করত আন্তরিক এবং সৎভাবেই করত।’

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে বাংলাদেশে চলে আসেন। সাইদুর রহমান ইসলামিয়া কলেজ থেকে ঢাকায় চলে আসেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। প্রিয় ছাত্রটিকে তিনি সব সময় পরামর্শ দিয়েছেন, সাফল্যে তিনি আনন্দিত হয়েছেন। শিক্ষক ও ছাত্র দুজনেরই লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলের মানুষের মুক্তি। এই মুক্তি চিন্তার মুক্তি, এই মুক্তি স্বাধীনতার।

১০ মার্চ স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার পথে সাইদুর রহমানের বাড়ি ‘সংশয়’-এর সামনে বঙ্গবন্ধুর গাড়ির গতি কমে গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই। বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি তখনো শিক্ষককে তিনি মাঝেমধ্যে গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যেতেন। প্রিয় শিক্ষকের পরামর্শ শুনতেন।

বঙ্গবন্ধু ধূমপান করতেন; কিন্তু শিক্ষকের সামনে কখনো ধূমপান করেননি, এমনকি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও। এ সম্পর্কে সাইদুর রহমান লিখেছেন, ‘গণভবনের সেদিনকার একটি ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। মুজিব ছিল ধূমপায়ী। আমার সঙ্গে আলাপের সময় তার পাইপ টানার ইচ্ছা জাগে। কিন্তু আমার সামনে সে আগে ধূমপান করেনি। কাজেই আমার সামনে কী করে পাইপ টানবে তা নিয়ে রীতিমতো দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় সে। হয়তো তার তামাকের তৃষ্ণাটা প্রবল হয়ে উঠেছিল; তাই বলেই ফেলে, স্যার একটু বেয়াদবি করছি। আপনি অনুমতি দেন, তাহলে আমি পাইপ ব্যবহার করতে পারি।’ বঙ্গবন্ধু শুধু সাইদুর রহমানের প্রিয় ছাত্র ছিলেন না। ইসলামিয়া কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আই এইচ জুবেরি বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। অন্যান্য শিক্ষকের সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর সৎভাব ছিল।

১৯৭৫ সালে দেশে-বিদেশে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর এশিয়ার পিতৃস্থানীয় নেতা হয়ে ওঠাকে আমেরিকা সহজভাবে নিতে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি পথ খুঁজছে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে বাংলাদেশ থেকে মুছে ফেলার। প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে সাইদুর রহমানের সমাজের বিভিন্ন অংশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। সে সময় তৎকালীন সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে সাইদুর রহমানের দেখা হয়েছিল। সাইদুর রহমান লিখেছেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রশ্নে মুজিবের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সে শুধু দ্বিমতই পোষণ করে না, রীতিমতো ক্ষুব্ধ।’ সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা সাইদুর রহমান জানতেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদের অবস্থানও তিনি জানতেন, বিশেষ করে ড. কামাল হোসেনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করাকে খন্দকার মোশতাক আহমেদ সহজভাবে নিতে পারেননি। প্রিয় ছাত্রের বিপদের আশঙ্কা করে তিনি তাঁকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের অরক্ষিত বাসভবন থেকে সরকারি নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

১৫ আগস্ট সাইদুর রহমান ছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে। চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর তিনি ১৬ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে বসেই শুনেছেন। প্রিয় ছাত্রের নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে বিমর্ষ হয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এত বড় আঘাত আর কখনো পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। দোষে-গুণে মুজিব একজন মানুষ ছিল।’ ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু সাইদুর রহমানের জন্য দুঃসংবাদ নয়- বাংলাদেশের, বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষের জন্য দুঃখের। ১৫ আগস্ট সাইদুর রহমান তাঁর সন্তানতুল্য রাষ্ট্রনেতাকে হারিয়েছেন। আর বাঙালি জাতি হারায় তার পিতাকে।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend