আইভী কাউকে বাঁচাতে চাইছেন: শামীম ওসমান
চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় কথিত গডফাদারদের ওপর দোষ চাপিয়ে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী কাউকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। তিনি দাবি করেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট চন্দন সরকারসহ সাত খুনের ঘটনায় নূর হোসেন জড়িত। র্যাবকে দিয়েই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। সত্য প্রকাশ ও সাহসী ভূমিকার জন্য তদন্ত কমিটি আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনায় আমার দেয়া তথ্যই হুবহু প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত প্রশাসনিক তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের পর সাংবাদিকদের কাছে তিনি এ দাবি করেন। তিনি বলেন, এই মামলার কার্যক্রমে বোঝা যায় সর্ষের ভেতর ভূত আছে। আর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের লোকজন জড়িত আছে, তা আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পেরেছেন।
শামীম ওসমান বলেন, নজরুলসহ ৭ জনের হত্যাকান্ড নিয়ে আমি যে তথ্য দিয়েছিলাম তা আজ হুবহু প্রমাণিত হয়েছে। সে জন্য আমি আজ তদন্ত কমিটিকে বললাম আমার এই তথ্যের জন্য আমি ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। পরে তারা আমাকে এজন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী ওসমান পরিবারের সন্তান শামীম বলেন ,সে (আইভী) যদি আমাকে বা আমাদেরকে গডফাদার বুঝিয়ে থাকে, তাহলে তার উচিৎ ছিল তদন্তকারীদের কাছে তথ্যপ্রমাণ হাজির করা। এই সাংসদ দাবি করেন, নূর হোসেন তার দলের লোক হলেও তার লোক নন। বরং মেয়র আইভীই ওই কাউন্সিলরকে বড় বড় পদে বসিয়ে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন বলে তার অভিযোগ। নূর হোসেনকে আমার লোক সাজাতে চেয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করেন, সে কাকে সেইফ করতে চাইছে।
শামীম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেন ,আইভী যে দুর্নীতিবাজ- তা তিনি যে কোনো সময় প্রমাণ করে দিতে পারেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মামলার মীমাংসা করার জন্য আমার তরফ থেকে যা জানা ছিল আমি সব বলেছি। যাতে করে নজরুলসহ সকলের পরিবার সুবিচার পায়। আর দেশে যাতে এধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড না ঘটে।
নজরুলসহ ৭ জনের হত্যার ঘটনাটি এক ঘণ্টার মধ্যে জানতে পারলেন কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে শামীম ওসমান বলেন, আমি এক ঘণ্টায় নয় আধ ঘণ্টায় জানতে পারি। সেটা কিভাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে এলাকা থেকে লাশগুলো তোলা হয়েছিল সেটি আমার নির্বাচনী এলাকা। আর দেশের জনগণ কোন ঘটনা ঘটলে প্রথমে প্রশাসনের কাছে না গিয়ে জনপ্রতিনিধিদের কাছে জানায়। আমি সেভাবে জানতে পেরেছি। আর সঙ্গে সঙ্গে র্যাবের সিও সহ প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের সকলকে এ বিষয়টি অবহিত করি।
সেলিনা হায়াৎ আইভি আপনাকে নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসের গডফাদার বলে আখ্যায়িত করেছেন। সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইভি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ মিডিয়ার কাছে যে অভিযোগ করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সে অন্য লেভেলের লোক। তাকে আমি গুরুত্বই দেই না। তার বক্তব্য থেকে বোঝা যায় তিনি কাউকে না কাউকে সেফ করতে চাচ্ছেন। আমি গডফাদার হলে তিনি তদন্ত কমিটির কাছে বলতে পারতেন। আর তদন্ত কমিটিও আমাকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি।
সাতজনের শরীরে ইট বেঁধে পেট কেটে’ নদীতে ফেলে দেয়ার পর সবগুলো লাশ একসঙ্গে কীভাবে ভেসে উঠল- তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এই নেতা মনে করছেন, ওই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার কোনো ষড়যন্ত্র থাকতে পারে।
আর সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূর হোসেন কোনো না কোনোভাবে ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলেও তার বিশ্বাস।সাত খুনের ঘটনায় মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির জিজ্ঞাসাবাদের পর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সামনে এসে এসব বিষয়ে কথা বলেন শামীম।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম,তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম গত ২৭ এপ্রিল অপহৃত হন। পরে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
অপহরণের ঘটনার পরপরই নজরুলের পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূর হোসেনকে প্রধান আসামি করে একটি মামলা করা হয়। নূর হোসেন র্যাবকে ৬ কোটি টাকা দিয়ে সাতজনকে হত্যা করিয়েছেন বলে নজরুলের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম অভিযোগ করেন। শুরুতে অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ মাধ্যমে বক্তব্য দিলেও অপহৃতদের লাশ উদ্ধারের পর লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান নূর হোসেন। পরে দুই সহযোগীসহ তিনি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হন।
নূর হোসেন পালিয়ে যাওয়ার আগে সাংসদ শামীমের সঙ্গে টেলিফোনে তার কথোপকথনের একটি অডিও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে নূর হোসেনের সঙ্গে ওই ফোনালাপের কথা স্বীকারও করেন শামীম।
সোমবার নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকেও ওই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে তদন্ত কমিটি। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নারায়ণগঞ্জের গডফাদাররাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে’ সাত খুনে জড়িত।এই গডফাদার কারা জানতে চাইলে আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জে কারা গডফাদার তা দেশের সবাই জানে। এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলার কিছু নেই।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শামীম ওসমান সাংবাদিকদের বলেন, উনি এবার আমার নাম উচ্চারণ করেন নাই। প্রথম প্রথম আমার নাম বলতেন। এখন গডফাদার বলছেন। আগামীতে গাডফাদারও বলবেন না।মেয়রকে একজন করাপটেড মেয়ে মানুষ আখ্যায়িত করে এই সংসদ সদস্য বলেন, আমি ওকে এতো গুরুত্ব সহকারে বিবেচনাও করি না।
গণমাধ্যমে আসা অডিও টেপের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শামীম স্বীকার করেন,টেলিফোনে নূর হোসেনের সঙ্গে ওই কথোপকথনে তার কণ্ঠই শোনা গেছে।তবে ওই অডিও প্রকাশ করা হয়েছে আংশিকভাবে। সে বলেছে, আপনি আমার বাপ লাগেন, আমি লেখাপড়া করি নাই, আমারে মাফ করেন ভাই। তার কথাতেই প্রমাণ হয়, আমি তাকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেই নাই।আমি পরে কিছু কথা বলেছিলাম, আমি তাকে সারেন্ডার করতে বলেছিলাম, রেসগুলো ক্লিপে নাই।সাত খুনের ঘটনায় নূর হোসেন জড়িত বলে মনে করেন কি না- এমন প্রশ্নে শামীম ওসমান বলেন, আমার মনে হয়, কোনো না কোনোভাবে সে ইনভলভড, আগে হোক বা পরে।
তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিৎ মন্তব্য করে এই সাংসদ বলেন, আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে আজকেই নূর হোসেনকে দেশে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতাম।কমিটির জিজ্ঞাসাবাদ সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন দলের এই সাংসদ বলেন, ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যেই মন্তব্য করেছিলাম, সর্ষের মধ্যে ভুত আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুই একজন কর্মকর্তা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। আমরা কথা সত্য প্রমাণিত হয়েছে।
ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি কীভাবে এতোটা নিশ্চিত হলেন জানতে চাইলে শামীম বলেন, এক ঘণ্টা না, আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে জানতে পেরেছি। ওটা আমার নির্বাচনী এলাকা। আমার নির্বাচনী এলাকার পাগলও আমি চিনি। আর সাধারণ মানুষ কিন্তু এলাকার নেতাকেই আগে খবর দেয়। রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে গেছে তখন তারা তো আমার কাছেই আসবে।ওই সাহসী মন্তব্যের কারণে তদন্ত কমিটি ধন্যবাদ জানিয়েছে বলেও দাবি করেন শামীম।