নে ঘুমা! নাকে ত্যাল দিয়া ঘুমা! আমি আছি না! – গোলাম মওলা রনি

নে ঘুমা! নাকে ত্যাল দিয়া ঘুমা! আমি আছি না!  – গোলাম মওলা রনি

দাদা বাবু কহিলেন- অনেক তো হইলো-নে ঘুমা! আমি বলিলাম কি করিয়া ঘুমাইবো- ঘুম তো আসিতেছে না। চোখ মুদিলেই রাজ্যের সব অনাচার, অবিচার আর অত্যাচার দল বাঁধিয়া আমা পানে ছুটিয়া আসে। উহারা বেশ কিছুক্ষন আমার বুকের ওপর উঠিয়া উল্লাস নৃত্যের তান্ডব শুরু করে- আমার বুকের ধড়ফড়ানি বাড়াইয়া দেয়। তারপর উহারা আমার মুখ মন্ডল, কপাল, ঠোঁট, কান প্রভৃতি স্থানে উঠিয়া স্বগর্বে হাটা চলা করে। প্রথম দিকে আমি যখন উহাদের দেখিতাম তখন তেমন একটি পাত্তা দিতাম না। উহারা খুব বেশী যাতনা করিলেও বেদনা অনুভব করিতাম না-বড় জোর চুলকানি অনুভব করিতাম। রাগে বা বিরক্তিতে নয়-বরং ইচ্ছা করিয়াই মাঝে মধ্যে উহাদেরকে ডলা দিতাম এবং পিষাইয়া মারিয়া ফেলিতাম।
golam maula rony
এ কাজে আমার কোন ডর, ভয়, ক্লান্তি বা কষ্ট ছিলো না। কারন উহাদেরকে আমার বড় জোর পিপড়া বা উকুনের চেয়ে বড় কিছু মনে হইতো না । বরং মারিবার সময় অদ্ভুত এক মজা অনুভব করিতাম। উহাদের চিৎকার বা আর্তি আমার কর্নকুহুরে প্রবেশ করিত না। আমি যখন উহাদিগকে মারিবার জন্য ডলা দিতাম তখন উহারা মরিবার পুর্বে ফাটিয়া যাইতো। পুট করিয়া একটি শব্দ হইতো বড়ই অদ্ভুত সুন্দর এবং মনোরম সেই শব্দ মালা ছিলো অনেকটা উকুন বা ঘামাছি ফোটানোর শব্দের মতন।

আমার সেই দিন বা সেই শুভদিন আর নাই। ইদানিং অত্যাচার, অনাচার আর অবিচারের পোকাগুলা আকারে বেশ বড় হইয়া গিয়াছে। আমি চেষ্টা করিয়াও উহাদিগকে আর ছোট ভাবিতে পারিতেছিনা। উহারা লায়েক হইয়াছে-উহাদের আকার আকৃতি বৃদ্ধি পাইয়া- গোবরে পোকা, বল্লা, বিছা, চ্যালা এবং ভীমরুলের মতো হইয়াছে। শুধু কি তাই- ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার খাইয়া উহাদের যৌন উত্তেজনা ভয়ানক বাড়িয়া গিয়াছে। ফলে গত অল্প কিছুদিনের মধ্যে উহারা ব্যাপকহারে বংশবৃদ্ধি ঘটাইয়া বিরাট এক অজেয় বাহিনীতে পরিনত হইয়াছে। উহারা বড় হইবে কিংবা বংশ বৃদ্ধি ঘটাইবে তা যেমন ভাবিতে পারি নাই তেমনি একথা ভাবিতে পারি নাই যে- উহারা নিজেরা নিজেরা সঙ্গী সাথী জুটাইয়া এতোবড় বাহিনী বানাইয়া ফেলিবে।

দাদা বাবু আমার কথা গুলো মনোযোগ সহকারে শুনিলেন। তারপর স্মিতহাস্যে আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দিলেন। বলিলেন- বাজারে লাল রংয়ের নবরত্ন ত্যাল আসিয়াছে। নাকে এবং মাথায় মাখিলে বেশ শীতলতা অনুভব হয়। তুই শুয়ে পড়-আমি তোর নাকে এবং মাথায় তেল মাখিয়া দেই। দাদার আন্তরিকতায় আমি বেশ মুগ্ধ্ কিন্তু সে আমার নাকের গভীরে আঙ্গুল ঢুকাইয়া ত্যাল মালিশ করিবে কিংবা মাথায় ত্যাল মালিশ করিয়া দিবে- এমনটা ভাবিতেই এক ধরনের ভয় এবং শংকা আমাকে পাইয়া বসিল। আমার মনে হইতে লাগিল- ত্যালের সহিত হয়তো বিষ মাখাইয়া দিবে। আমি বিষন্ন মুখে দাদা বাবুর দিকে তাকাইয়া বলিলাম- লাগিবে না! ও আমি নিজেই করিয়া নিতে পারিব- তোমার আর কষ্ট করিতে হইবে না। দাদা বাবু কি বুঝিল বলিতে পারিব না- তবে মুখ খানা ভার করিয়া অন্য কামরায় চলিয়া গেলেন।

আমি একা একা বসিয়া নবরত্ন ত্যালের বোতল লইয়া নাড়া চাড়া করিতে থাকিলাম এবং ভাবিতে চেষ্টা করিলাম- দাদাবাবুকে অবিশ্বাস করাটা কি ঠিক হইলো? ইদানিং যে আমার কি হইয়াছে তাহা আমি নিজেই জানিনা! তবে কিছু একটা যে হইয়াছে তাহা বিলক্ষন বুঝিতে পারি। আমি কাহাকেও বিশ্বাস করিতে পারিতেছি না। আবার অন্যরাও আমাকে বিশ্বাস করিতে পারিতেছেনা। আমার আশে পাশের কাছের মানুষগুলা আমার উপর এখন আর নির্ভর করিতে পারিতেছে না বা ইচ্ছা করিয়াই নির্ভর করিতেছে না। আমি যখন তাহাদের সামনে কথা বলি তখন তাহারা হয় মাথা নীচু করিয়া থাকে নতুবা অমনোযোগী হইবার ভান করিয়া এদিক ওদিক ইতি উতি করিয়া তাকাইতে থাকে। আমি অনেকটা বেহায়ার মতো তাহাদের চালাকি বুঝিবার পরও আমার বক্তব্য চালাইয়া যাইতে থাকি। ইহার পর আমি যখন আমার কর্মস্থলে ফিরিয়া দান খয়রাতের ভান্ড নিয়া বসি তখন সেই গুলা গ্রহন করিবার জন্য রং বে রঙ্গের মানুষের অভাব হয় না। ইহারা আসিয়া আমার পদতলে ঝাপাইয়া পড়ে। আমার মুখ পানে চাহিয়া হু হু করিয়া কাঁদিয়া ফ্যালে-আর বলে- আমার জন্য নাকি তাহাদের বড়ই মায়া এবং মহব্বত। তাহারা আমার জন্য তাহাদের জান কুরবানীর নিমিত্তে এতোটাই উদগ্রীব যে পারিলে তখনই গলার মধ্যে নিজেদের হাত ঢুকাইয়া কলিজাটা ছিড়িয়া আমার পায়ে বিসর্জন করিয়া ফ্যালে।
বহু বছর ধরিয়া আমি এই ধরনের ছলচাতুরী আর ভন্ডামী দেখিয়া আসিতেছি। ফলে মানুষ সম্পর্কে আমার ধারনা বড়ই নিম্নমানের। কত মানুষ আমার কাছে এলো-জ্ঞান বুদ্ধিতে কাহারো কাহরো মাথায় একটি চুল ও আর অবশিষ্ট নাই- বুদ্ধির চোটে সব উঠিয়া গিয়া পুরা মাথা সাহারা মরুভূমির মতো খা খা করে। কাহারো কাহরো পেট বুদ্ধির যন্ত্রনায় ভীষন ফুলিয়া উঠিয়াছে-ভাবখানা এমন অচিরেই পেট যদি লোহা-তামা বা স্বর্নরৌপ্যের পাত দিয়া মুড়াইয়া দেওয়া না হয় তাহলে উহা যে কোন সময় ফাটিয়া পৃথিবীতে প্রলয় ঘটাইয়া দিতে পারে। আমি ভয়ে ভয়ে উহাদিগের সঙ্গে কথা বলিতে আরম্ভ করি এবং অচিরেই বুঝিতে পারি তাহাদের মস্তিস্ক এবং পেট কি জিনিস দ্বারা ভর্তি রহিয়াছে। ইহার পরই আমার বমন বমন ভাবের উদ্রেক হয়- মনে হয় প্যাট ফুটা করিয়া দেই। কিন্তু দূর্গন্ধের কথা চিন্তা করিয়া কোন কিছুই করিতে পারিনা।

ধর্মে-কর্মে আমার দূর্বলতার কথা জানিয়া অনেক বক ধার্মিক আমার দরবারে ভীড় জমায়। তাহারা লম্বা দাড়ি রাখিয়া, সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা পরিয়া মাথায় মস্তবড় এক কিস্তি টুপি বসায়। ইহারা হাতে তছবীহ রাখে, গায়ে আতর মাখে এবং কথায় কথায় সুবাহান আল্লাহ বলে চিল্লা মারে! তাহাদের চিল্লা বিল্লা শুনিলে মনে হয় উহারা বোধ হয় মারেফাতের সর্বোচ্চ মাকামে পৌছিয়া গিয়াছে! উহারা মহান আল্লাহর প্রেমে ফানাফিল্লাহ হইয়া গিয়াছে। রাসুল (সঃ) এর জিয়ারত না করিয়া উহারা বোধ হয় সকালের নাস্তা খায়না। কিন্তু কোরান, হাদিস, ইজমা, কিয়াসের জ্ঞান গরিমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করিলে উহারা বড় বড় হেচকি তুলিয়া কেরামতি দেখাইবার চেষ্টা করে। উহাদের ব্যক্তিগত নৈতিক জীবনের অনাচার, ব্যভিচার এবং নাফরমানির কথা শুনিয়া শুনিয়া আমি মানুষজনের ধর্মকর্মের প্রতিই বিশ্বাস হারাইয়া ফেলিয়াছি। প্রথম প্রথম আমি চুপ করিয়া থাকিতাম। পরে উহাদেরকে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলাম। শেষমেষ ব্যর্থ হইয়া শাস্তি দানের মাধ্যমে ঠিক করিতে না পারিয়া বিচ্ছুদিগকে উঠিতে বসিতে অপমান করিতে শুরু করি ইতর প্রানীদের মতো। ইহার পরও উহারা থামিয়া যায় নাই বরং পাঞ্জাবী – পাজামা আরো সাদা করিয়াছে-নতুন নতুন আতর মাখিতেছে এবং চুল দাঁড়িতে খেজাব মাখিয়া আমার গৃহের আশেপাশে ঘুর ঘুর করিতেছে।

কিছু সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবি নিত্য আমার দরবারে হাজিরা দেয়। ইহারা কিসের সাংবাদিক এবং কিসের বুদ্ধিজীবি তা আমি আজ অবধি বুঝিতে পারিলাম না। সাংবাদিকেরা কোন পত্রিকায় চাকুরী করে না। দু’ কলাম লিখেনা। এমনকি ফেইসবুক বা টুইটারে একটি স্টাটাসও দেয়না। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম তোমরা কর কি? উহারা বলিল – আমরা চেতনার দন্ড লইয়া ঘুরাফিরা করি; দন্ডটিতে তৈল মর্দন করি এবং যায়গা বেজায়গায় সুযোগ পাইলে বিনামূল্যে দন্ডের ব্যবহার করি। তা আর কি কর? দাঁত বাহির করিয়া উহারা বলিল-দেশ জাতি নিয়া সর্বদা চিন্তাভাবনা করি; সাংবাদিক সমাজের ভালোমন্দ নিশ্চিত করি। আমাদের মতো আত্মত্যাগী প্রানী এই পৃথিবীতে নাই। আমাদের আত্মত্যাগ গরু-ছাগল ও মুরগীর চেয়েও উত্তম। এসব প্রানী জন্ম নেয় কেবল অন্যের খাদ্য হইবার জন্য। মরিলে মাংশ দেয় আর বাঁচিয়া থাকিলে দুধ দেয়, ডিম দেয়, গোবর, লাদি, বিষ্ঠা দেয়। সাংবাদিকদের মধ্যে যাহারা কাজ করে আমরা বেকার থাকিয়া উহাদের কর্মের পরিবেশকে প্রতিযোগীতাহীন করি। উহারা দিবারাত্র কর্ম করে বলিয়া নিজেদের কথা এবং স্ত্রী-কন্যা-বোনদের কথা ভাবিতে পারে না। তাই আমরা কর্মজীবি সাংবাদিকদের অরক্ষিত ধন সম্পদ, পরিবার পরিজন, মান সম্মান এবং অন্যান্য স্বার্থ সমুহ মাথায় করিয়া লাফাইতে থাকি। আমাদের চরিত্র-ফুলের মতো পবিত্র। আমরা নামাজ পড়িতে পড়িতে কপালে দুইটা করে দাগ বানাইয়া ফেলিয়াছি। আমি চুপ থাকিয়া উহাদের কথা শুনিলাম এবং বমন বমন অবস্থার ইঙ্গিত অনুভব করিয়া বেসিনের নিকট গেলাম। ফিরিয়া আসিয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের পানে তাকাইলাম। উহাদের পোশাক পরিচ্ছদ, অবিন্যস্ত কেশ, দাড়ী আর মোচ দেখিয়া হাইকোর্ট মাজারের কথা স্মরনে আনিলাম। কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করিতে আর সাহস পাইলাম না-
মানুষের কর্মযোগ, বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং অন্যান্য সুকুমার বৃত্তির ওপর আমি বিশ্বাস হারাইয়া ফেলিলাম কিছু শয়তান রুপী মানুষ পদবাচ্য পশুর কারনে। এইসব পশুর তান্ডবে সত্যিকার ভালো মানুষেরা অভিমান করিয়া আমায় ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। আমি প্রথমে বুঝিতে পারি নাই- কিন্তু যখন বুঝিলাম তখন চোখ মেলিয়া দেখি সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে। আমি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা পড়িলাম। বুঝিবার চেষ্টা করিলাম- জাহান্নামে বসিয়া কিরুপে পুস্পের হাসি হাসিবো। অনেক চেষ্টা করিয়াও ইদানিং আমি হাসিতে পারিতেছি না। হাসার ভান করি যাহা হয়তো ভ্যাটকানী কিংবা বালখিল্যা বলিয়া প্রতিয়মান হইতে পারে- কিন্তু কিছুতেই নির্মলও পবিত্র হাসির মর্যাদা পায়না। আমি যখন দেখিলাম – মন্দ মানুষের দ্বারা অবরুদ্ধ এবং পরিবেষ্ঠিত হইয়া গিয়াছি তখন প্রায়ই ধৈর্য হারাতে শুরু করিয়া দিলাম। কারনে অকারনে মন্দ লোকদেরকে গালাগালি, মারপিট এবং ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিলাম। কিন্তু এতে করিয়া ফলাফল যে এতোটা মারাত্মক আকার ধারন করিবে তাহা স্বপ্নেও কল্পনা করিতে পারি নাই। ভালো লোকদিগকে মন্দ কথা বলিলে উহারা মুখ ভার করিয়া ফেলে- কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। অনেকে আবার রাগ করিয়া চলিয়া যায়। কিন্তু মন্দ লোকদিগকে পিছা মারিলেও তাহারা হাসিবে। আমি যদি রাগ করিয়া তাহাদের কান কাটিয়া দেই তাহলেও তাহারা বলিবে-উত্তম কর্ম হইয়াছে। যদি প্রকাশ্যে বেত মারি কিংবা আরো নির্যাতন করি তাহলেও উহারা আমাকে ছাড়িয়া যাইবেনা। উহাদের ধৈর্য্য সৈহ্য দেখিয়া প্রথম দিকে বড়ই মজা পাইতাম-রাতে সুন্দর ঘুম আসিত; সকালে জাগ্রত হইলে নিজেকে তরতাজা মনে হইতো। কিন্তু ইদানিং সব কিছু উল্টা পাল্টা হইয়া গিয়াছে।

আমার জীবনে একান্ত গোপনীয় কিছু সুকর্ম রহিয়াছে। ঐগুলোর কল্যানে আমার বিবেক বোধ এখনো মরিয়া যায় নাই। তবে বিবেক প্রায়ই ঘুমাইয়া থাকে অনেকটা কুম্ভকনের্র মতো। তবে হঠাৎ হঠাৎ জাগিয়া উঠে এবং আমারে কিছু উচিত কথা শুনাইয়া দিয়া আবার ঘুমাইয়া পড়ে। তো সেইদিন বিবেক হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়া উঠিলো-আমার মন মস্তিস্ক এবং হৃদয় স্বল্প সময়ের জন্য হইলেও একত্রে কর্ম শুরু করিল। উহারা জানাইলো যে, মহা সর্ব নাশ ঘটিয়া গিয়াছে। আমি যাহাদের সহিত অর্থাৎ যেই সকল মন্দ লোকের সহিত রাগ, গালাগালি এবং মারধোর ও অত্যাচার করিয়াছিলাম- উহারা আমার সম্মুখ থেকে গিয়া সাধারন মানুষের উপর বেদম প্রতিশোধ নিয়াছে। অত্যাচার, অনাচার অবিচার, ব্যভিচার, দূর্নীতি, লুট পাট, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি-এহেন অপকর্ম নাই যে করে নাই। মন্দ লোকেরা যেহেতু আমার সহিত চলাফিরা এবং উঠাবসা করে সেইহেতু লোকজন সকল কিছুর জন্য আমাকেই দায়ী করিতেছে। বিবেকের কথামতো আমি খোঁজ খবর নেওয়া শুরু করিলাম এবং যাহা দেখিতে পাইলাম তাহা ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিব না। ইহার পর হইতেই আমি ঘুমাইতে পারিতেছি না। চোখ বুজিলেই আমার আশেপাশের মন্দ লোকদের দ্বারা আহত, নিহত, অত্যাচারিত, বঞ্চিত, নিস্পেষিত, প্রতারিত এবং শোষিত মানুষজনের প্রবঞ্চিত আত্মা পিপড়ার বেশে আমার ঘুমন্ত চোখ, মুখ মন্ডল, গলা ও বুকের উপর আসিয়া উল্লাস নৃত্য আরম্ভ করে। ঘুমের ঘোরে আমি ঐগুলোকে ডলা দিয়া পিষা মারিতাম। কিন্তু ইদানিং ঐগুলো যে কত বড় হইয়াছে তা আমি ইতিপূর্বেই বলিয়াছি।

দাদা বাবুর দেওয়া নবরত্ন ত্যালের শিশিটা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে আমি আমার জীবনের ঘটে যাওয়া উপাখ্যান সমুহ নিয়া ভাবিতে ছিলাম। হঠাৎ লক্ষ করিলাম দরজার ফাঁক দিয়া দাদা বাবু উকি দিয়া চলিয়া যাইতেছেন। আমি দ্রুত উঠিয়া বসিলাম এবং দরদ ভরা কণ্ঠে ডাকিলাম- দাদা বাবু!- একবার আসোতো! মাথাটা বড্ড ঘুরছে! ঘুমোতে সাহস পাচ্ছি না। আবার তোমার নব রতœ ত্যালও মাখিতে ভয় পাচ্ছি। দাদা বাবু ঘরে ঢুকিলেন আমার বিছানার এক কোনে বসিলেন- তারপর বলিলেন-একবার কি ভাবিয়া দেখিয়াছ কেনো তোমার ঘুম আসে না কিংবা ঘুমের ঘোরে নানাবিধ দুস্বপ্ন তোমাকে তাড়া করে? কেনোইবা রাজ্যের মন্দ মন্দ লোকগুলি তাহাদের আদি নিবাস নরকালয় ছাড়িয়া তোমার আলয়ে আশ্রয় পায় ? তোমার বচন পঁচিতে পঁচিতে উহার গন্ধ কতটা গগন বিদারী হইয়া উঠিয়াছে তাহা কি তুমি বুঝ ? ভালো লোকেরা তোমার ত্রি সীমানায় আসেনা মনোহরী পাক পাখালী তোমার বাগানে বসে না। প্রজাপতি, ফড়িং প্রভৃতি ফুল ফোটায় না – বর্ষা,বসন্ত কিংবা হেমন্তের নিমন্ত্রন নিয়ে বিধাতার বাতাস তোমার দক্ষিনের বাতায়ন দিয়ে প্রবেশ করে না। তুমি কি মনে করিতে পারো-কতকাল পূর্বে তুমি একটি হলুদিয়া পাখি দেখিয়াছিলে? কিংবা বউ কথা কও পাখির ডাক তোমার কানকে ধন্য করিয়াছিলো। মৌমাছির গুঞ্জন, জোড়া শালিকের ডাক, আর বকুল ফুলের সৌরভের অভাবে তোমার চিত্ত মরিয়া যাইতেছে!

দাদা বাবু আরো বলিলেন তোমার অস্থিরতার কারনে কেউ তোমাকে নির্ভরযোগ্য মনে করেনা। তোমার মিথ্যাচারের কারনে কেউ তোমাকে বিশ্বাস করেনা। তোমার অহংকারের কারনে বসুন্ধরার বৃক্ষ, লতা, তরুরাজি এবং নির্বাক জন্তু জানোয়ার তোমাকে অভিসম্পাত দেয়। দেবদূতগন তোমার বিরুদ্ধে বিধাতার নিকট নালিশ জানায়। তোমার ছল চাতুরীর জন্য তোমার আশে পাশের লোক তোমাকে ভয় পায় আর তোমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা তোমাকে তুচ্ছজ্ঞান করে। তোমার অমানবিক নিষ্ঠুরতা দিনকে দিন তোমার হৃদয়কে পাষান বানাইয়া ফেলিতেছে। পাষান হৃদয়ের কোন প্রানীর স্বাভাবিক চেহারা থাকে না-উহারা হাসিলে কান্নার মতো মনে হয়- আর কাঁদিলে আশে পাশের লোক সহানুভূতিশীল না হয়ে উল্টা উল্লাস প্রকাশ করিতে থাকে। পাষান পাষানীরা ক্রোধান্বিত হইলে উহাদের মুখ হইয়া যায় হায়েনার মতন আর শরীর হইয়া যায় সজারু সদৃশ্য। তোমার জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃসংবাদ হলো-তুমি যদি কাউকে অনুগ্রহ বা করুনা করতে চাও তবে সারা দুনিয়ার সকল প্রানী, বৃক্ষলতা তরুরাজি তোমার করুনার ধনকে ঘৃনা করতে থাকে-তারা সমাজ সংশারে অচ্ছুত হইয়া যায়। তাহার চাইতেও ভয়ংকর সংবাদ হইলো- তুমি যাহাকে তিরস্কার কর কিংবা ক্রোধান্বিত হইয়া অত্যাচারের স্টীম রোলার চালাইয়া দাও সেই লোকটির ভাগ্য খুলিয়া যায়। সারা দুনিয়ার মানুষ, পশু পাখি, বৃক্ষলতা, তরুরাজি এবং ফুলফল সমুহ ঐ মজলুমের পক্ষে তাদের বিধাতার নিকট ফরিয়াদ জানাতে থাকে।

দাদা বাবুর কথা শুনিয়া বহুদিন পর সত্যিকার অর্থেই আমার কান্না পাইয়া বসিল। তিনি আমার কান্নাকে পাছে অভিনয় মনে না করেন- এই ভয়ে বহু কষ্টে কান্না চাপাইয়া যাইতে চেষ্টা করিতে থাকিলাম। কিন্তু আমার দীর্ঘদিনের প্রশিক্ষিত চক্ষুদ্বয় আজ আর আমার শাসন মানিল না। উহারা অঝোরে অশ্র“ বর্ষন করিতে থাকিলো। আমি লজ্জায় আমার চক্ষুদ্বয় মুদিত করিলাম। দাদা বাবু পরম স্নেহে আমার মাথায় অনেকখানি নবরত্ন ত্যাল ঢালিয়া দিলেন। মাথা মালিশ করিতে করিতে আমার কানের কাছে মুখ আনিয়া ফিস ফিসাইয়া বলিলেন- আমার ট্যাপা মনি! নে ঘুমা! আরাম করিয়া ঘুমা। আজ সারারাত আমি তোর শিয়রে বসিয়া থাকিবো-তোর ঘুম পাহারা দিবো। আমি বাকী কথাগুলো আর শুনিতে পাইলাম না-কেবল এতটুকু মনে আছে যে, ঘুমাবার পূর্বে পাশ ফিরে শুয়েছিলাম।

 

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend