মুজিব হত্যা, খুনি মেজররা ও আমাদের দ্বিচারিতা- সোহরাব হাসান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনা একই সঙ্গে বেদনার ও আত্মসমালোচনার। বেদনার এ কারণে যে বাংলাদেশ এই দিনে তার স্থপতিকে হারিয়েছে। আর আত্মসমালোচনা এ কারণে যে সেই হত্যাকাণ্ডের নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হলেও সেদিন অনেকেই তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যাঁরা মুজিবের রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ আত্মরক্ষাকে উত্তম মনে করেছিলেন। আর বিরোধীরা দেশ ও গণতন্ত্র উদ্ধারের দায়িত্বটি কতিপয় মেজরের রক্তমাখা হাতে ন্যস্ত করে দারুণ আহ্লাদিত হয়েছিলেন। অনেকে দাবি করেন, একদলীয় শাসন তথা গণতন্ত্রহীনতাই দেশকে ১৫ আগস্টের বেদনাদায়ক ঘটনার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সত্যি কি তাই? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এই নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ড কি অনিবার্য ছিল? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৫ আগস্টের রক্তপাত দেশে গণতন্ত্র, সুশাসন—কোনোটাই দিতে পারেনি। কোনো দেশেই সামরিক জান্তা স্বেচ্ছায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয় না; নিজেদের ক্ষমতা জায়েজ করতে বড়জোর তারা স্বৈরশাসনের গায়ে গণতন্ত্রের লেফাফা মুড়ে দেয়।১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা সপরিবারে মুজিবকে হত্যা করলেও তাঁর সরকারের সদস্যদের নিয়েই নতুন সরকার গঠন করেন, মুজিবের সেনা ও বেসামরিক প্রশাসন এবং সংসদ বহাল রাখেন। তাঁদের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুজিবকে সরিয়ে দেওয়া এবং সেই কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁরা বুঝতে পারছিলেন না কী করবেন। তাই অভ্যুত্থানকারীরা পরামর্শক হিসেবে বেছে নিলেন আওয়ামী লীগেরই কতিপয় বিতর্কিত নেতা ও পাকিস্তানপন্থী আমলাকে। দীর্ঘ মেয়াদে দেশ শাসনই যদি তাঁদের উদ্দেশ্য হতো, তাঁরা মুজিববিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। অভ্যুত্থানকারীদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিলেও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় ছিলেন ঘোরতর রক্ষণশীল ও সাম্প্রদায়িক। সৈয়দ ফারুকুর রহমান ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত ইসলামি হুকুমত কায়েমের খোয়াব দেখতেন। এই ক্ষুদ্র সামরিক চক্র রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার যে ভয়াবহ ক্ষত তৈরি করেছিল, তার দায় জাতিকে সম্ভবত আরও বহু বছর বয়ে বেড়াতে হবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ব্যর্থতা নিজের নিরাপত্তার বিষয়ে ঔদাসীন্য কিংবা প্রশাসনিক অব্যবস্থা নয়, দলটির নেতা-কর্মীদের আদর্শবাদী হিসেবে গড়ে তুলতে না পারা। সুরক্ষিত ঘরে কিংবা আপন রক্ষীদের হাতে অনেক দেশের নেতা-নেত্রী খুন হয়েছেন। কিন্তু নেতার মৃতদেহ সিঁড়িতে রেখে তাঁর দলের লোকদের এভাবে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার নজির নেই। অস্বীকার করার উপায় নেই যে মুজিব সারা জীবন যে দলের নেতা-অনুসারীদের নিয়ে গৌরব বোধ করতেন, সেই দলের নেতাদের একাংশ তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল, অপরাংশ চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিল।
অন্যদিকে, যে মুজিব একাত্তরে পাকিস্তানি জেলখানায় বসেও জাতির ঐক্য ও স্বাধীনতার প্রতীক হয়েছিলেন, সেই মুজিব বাহাত্তরে দেশে ফিরে নিজ দলকেই ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারেননি। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে চৌকস ও মেধাবী তরুণ কর্মীরা মিলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ নামে নতুন দল করে তাঁর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিলেন এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট তিনি খুন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা থামলেন না। ‘আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ এই দলের মূলমন্ত্র বলা হলেও বরখাস্ত হওয়া দুর্নীতিবাজ আমলা থেকে শুরু করে কট্টর স্বাধীনতাবিরোধীরাও সেখানে ঠাঁই পেয়েছিলেন।
ভূরাজনৈতিক কারণ ছাড়াও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উত্তরাধিকার বহন করা সেনা কর্মকর্তাদের অধিকাংশের মধ্যে যে ভারতবিরোধী মনোভাব জাগ্রত ছিল, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে জাসদের গুপ্ত সংগঠনটি তার জোশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের কথিত অভ্যুত্থানে ভারতবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক স্লোগানের নিচে কথিত সমাজ বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা চাপা পড়ে যায়। মুজিবকে ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হলেও ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ভারতের সঙ্গে তিনি যতটা দর-কষাকষি করেছেন, উত্তরসূরিদের কেউ তা করতে পারেননি। শত সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই মানুষটিই যে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তার সঙ্গে অবিভাজ্য হয়ে গিয়েছিলেন, সে সময়ে আমাদের অনেক বিপ্লবী তাত্ত্বিক, বামপন্থী রাজনীতিক, উচ্চমার্গীয় বুদ্ধিজীবী উপলব্ধি করতে পারেননি। এখন কি পেরেছেন?
সন্দেহ নেই, মুজিব দক্ষ সংগঠক ছিলেন, প্রায় শূন্য থেকে দলকে বিশাল মহিরুহে পরিণত করেছিলেন। কিন্তু তিনি দলে আদর্শবান নেতা ও কর্মী তৈরি করতে পারেননি। পারলে তাঁর মৃতদেহ ৩২ নম্বরে রেখে আওয়ামী লীগের নেতারা কুচক্রী মোশতাকের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে শপথ নিতেন না। সেদিন মন্ত্রিসভার সদস্যদের সবাই বন্দুকের মুখে শপথ নেননি। বঙ্গবন্ধু শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করেছিলেন। নৈতিক স্খলনের দায়ে মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং দুর্নীতির দায়ে নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে বাদ দিলেও বহাল তবিয়তে রাখেন তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ওবায়দুর রহমান প্রমুখকে, যাঁরা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে দ্বিধা করেননি। আনুগত্যের ঘাটতি আছে সন্দেহে মুজিব তাজউদ্দীন আহমদকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিলেও বহাল রেখেছিলেন ধুরন্ধর মোশতাককে, যিনি ১৫ আগস্টের খুনিদের অভিহিত করেছিলেন ‘সূর্যসন্তান’ হিসেবে।
১৫ আগস্টের ঘটনা আমাদের রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবীদের একাংশের প্রবল সুবিধাবাদিতা ও আদর্শহীনতার কথাও মনে করিয়ে দেয়। প্রবীণ রাজনীতিক আতাউর রহমান খান স্বেচ্ছায় বাকশালের সদস্য হয়েও পরবর্তীকালে ১৫ আগস্টকে ‘নাজাত দিবস’ হিসেবে পালন করেছিলেন। যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জুন মাসে সন্তোষে মুজিবের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করেন, তিনিই আবার ১৫ আগস্টের পর মোশতাক সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। যে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে সংবর্ধনা নিয়েছিলেন, তিনিই আবার ১৫ আগস্টের পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন। কেবল তা-ই নয়, সেদিন আরও অনেক প্রগতিশীল লেফাফাধারী সাংবাদিক নেতা, শিক্ষক নেতা ও আইনজীবী নেতা রাতারাতি