চূড়ান্ত আন্দালনে বিএনপিতে ত্যাগী নেতাদের কদর বাড়ছে

বিএনপি-লোগো1

চূড়ান্ত আন্দালনের জন্য তৈরি হতে বিএনপিতে সুবিধাবাদী নেতাদের পাশ কাটিয়ে এবার ত্যাগী ও সাংগঠনিক নেতাদের কদর বাড়ছে। দল থেকে বঞ্চিত ও দূরে থাকা নেতাদের একই প্লাটফরমে নিয়ে আসছে দলের হাইকমান্ড। এছাড়া এতদিন যারা দলের মধ্যে কোণঠাসা অবস্থায় ছিলেন তাদেরও গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করছেন দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরিকল্পনায় দলকে ঢেলে সাজানোর অংশ হিসেবে এসব ত্যাগী নেতাকে মূল্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানায়।

দলের মূলমন্ত্র জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যেও উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। তারা মনে করছেন, দলকে পুনর্গঠনের জন্য এবং আগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এসব নেতার বিকল্প নেই।

সূত্র জানায়, এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে এবং দলকে সংগঠিত করতে এবার তৃণমূলের দিকে নজর দিয়েছেন খালেদা জিয়া। ইতিমধ্যে তিনি দলের সিনিয়র নেতাদের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর পরামর্শসহ তাদের ডাটাবেজ সংগ্রহ করার নির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও এর আগে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান হাওয়া ভবনে সারাদেশের তৃণমূলসহ সকল স্তরের নেতাকর্মীর ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী তার সেই উদ্যোগ আর বাস্তবায়ন হয়নি।

এবার তারেক রহমানের নির্দেশনায় এক সময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেলকে রাজনীতি ও আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব করা হয়েছে। এছাড়া জাতীয়তাবাদী যুব দলের অন্যতম সংগঠক দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক করা হয়েছে। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের অন্যতম পুরোধা, রাজপথ কাঁপানো ছাত্রনেতা ও সংগঠক সানাউল হক নীরুকে যুবদলের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। সাবেক ছাত্রনেতা কামরুজ্জামন রতনকেও গুরুত্বপূর্ণ পদে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে দলের। বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা ও সংগঠক সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরীকে জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা জাসাসের সভাপতির দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বলে দলীয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এছাড়া তিতুমীর কলেজের ভিপি, ছাত্রনেতা ও সংগঠক মোহাম্মদ হানিফকেও জাতীয়তাবাদী যুবদলের মহানগর উত্তরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে বিএনপির আগামী আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে দলের নীতিনির্ধারণী হাইকমান্ড। এছাড়া দলে ফিরছেন সাবেক ছাত্রনেতা ও বিএনপির সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক জহির উদ্দিন স্বপনসহ অর্ধশতাধিক নেতা। যারা বিএনপির রাজনীতিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে সক্ষম এবার তাদের হাতেই দলের গুরু-দায়িত্ব দেয়া হবে বলে সূত্র জানায়।

জানা গেছে, এসব নেতার মধ্যে অনেকে দলের অভ্যন্তরীণ নোংরা রাজনীতির শিকার হয়ে দলছুট হয়ে বাইরে ছিলেন।অভিযোগ রয়েছে দলের ভেতর থেকে একটি মোসাহেবী গ্রুপ তাদের স্বার্থের কারণে ত্যাগী ও নিবেদিত প্রাণ নেতাদের কোণঠাসা করে রাখে। এরমধ্যে বিভিন্ন দলছুট মৌসুমি নেতার কারসাজিও ছিল। যারা অন্য রাজনৈতিক দল থেকে বের হয়ে বিএনপিতে যোগদান করেছিল, তারাই বিএনপির গর্ভ থেকে জন্ম নেয়া ত্যাগী নেতাদের সরিয়ে জায়গা দখল করে। পরবর্তীতে এসব মধ্যস্বত্বভোগী নেতাদের অপকর্ম ও অসাংগঠনিক কাজের জন্য জনগণের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে পুরো দলকে।

এসব বিষয়ে রেজাবুদ্দৌলা চৌধুরী বলেন, আই অ্যাম প্রোডাক্ট অব জিয়াউর রহমান। আমি দলের সঙ্গে আছি। দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাকে যে দায়িত্ব দেবেন তা আমি পালন করতে প্রস্তুত। সাবেক ছাত্রনেতা হানিফ জানান, দলের চেয়ারপার্সন আমার মা। তিনি যখন যে দায়িত্ব আমাকে দেবেন সে দায়িত্ব আমার ওপর ফরজ হয়ে যাবে। আমি দলের জন্য আজীবন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি।

দলীয় সূত্র জানায়, তৃণমূল নেতাকর্মীদের কাছে দলকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেয়ারপার্সনের নির্দেশের পর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তথ্য ও যোগাযোগ সেল গঠন করা হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা পর্যায়ের সব নেতার সবধরনের তথ্য চেয়ে কেন্দ্রীয় দফতর থেকে নির্দেশনা সংবলিত চিঠি পাঠানো হয়েছে। খুব শিগগির ইউনিয়ন পর্যায়েও তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হবে। সারাদেশে চেইন অব কমান্ড তৈরি এবং সংগঠন শক্তিশালী করাই এর লক্ষ্য। দলের এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত আট ধরনের তথ্য চেয়ে দলের মহানগর, জেলা, উপজেলা ও পৌর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে একটি চিঠি পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই সেল সারাদেশের নেতাকর্মীরে ডাটাবেজ তৈরিতে কাজ করছে।

এদিকে, সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির পর আন্দোলনের কথা বললেও অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি চৌধুরী) বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ( জেএসডি)-এর কাছ থেকে সেরকম কোনো সাড়া পাচ্ছে না বিএনপি।

সূত্র জানায়, নাম সর্বস্ব কিছু রাজনৈতিক দল ও তাদের ভগ্নাংশ নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ জোটের বাইরে থাকা বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি)- কে জোটে ভেড়াতে গত আড়াই বছর ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি।

কিন্তু দলীয় আদর্শ, কর্মসূচির ধরন সর্বপরি ২০দলীয় জোটে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতের সরব উপস্থিতির কারণে এই তিনটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত সবুজ সংকেত পায়নি বিএনপি। তবে বিরোধী জোটের ওপর সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে সব সময় স্বোচ্চার থেকেছেন তারা। সংকটময় মুহূর্তে খালেদা জিয়ার বাসায় গিয়ে দেখা করেছেন বি চৌধুরী ও কাদের সিদ্দিকী।

জানা গেছে, জোটে ভেড়াতে না পারলেও যুগপৎ আন্দোলনে ওই তিন রাজনৈতিক দলকে পাশে পাওয়ার আশা সব সময়ই ছিল বিএনপির। বিকল্পধারা কাছ থেকে এ ব্যাপারে মৌখিক আশ্বাসও পায় দলটি। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে ও পরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট বি চৌধুরী ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাহি বি চৌধুরী আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপিকে সহযোগিতার কথা সংবাদ মাধ্যমকেও বলেছিলেন।

অন্যদিকে বিএনপির অনুরোধে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দীকির কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল পরোক্ষভাবে বিএনপির আন্দোলনকেই সমর্থন করেছে বলে মনে করেন দল দু’টির শীর্ষ নেতারা।

কিন্তু ৫জানুয়ারির পর উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে প্রার্থী ভাগা-ভাগি করলেও নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার ব্যাপারে ওই তিন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ন্যুনতম যোগাযোগ করেনি বিএনপি। এমনকি টাঙ্গাইলের সখিপুরে বঙ্গবীরের প্রার্থী থাকার পরও নির্দ্বিধায় সেখানে প্রার্থী দেয় দলটি। বিষয়টিকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে নিয়ে তিন দলের নেতারা বলছেন, কেবল বিপদ মুহূর্তে বি চৌধুরী, কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম আব্দুর রবকে স্মরণ করনে খালেদা জিয়া। বিপদ কেটে গেলে জামায়াত-ই তার সব হয়ে যায়।

সূত্র জানায়,উপজেলা নির্বাচনের ক্ষত না শুকাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেওয়া বক্তব্যে যারপরনাই হতাশ হন বঙ্গবীর। ওই সময় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে টাঙ্গাইল-৮ (সখিপুর-বাসাইল) আসনের উপ-নির্বাচনে প্রার্থী হন তিনি। নারয়ণগঞ্জ-৫ উপ নির্বাচনেও দেন দলীয় প্রার্থী।

সূত্র জানায়, তিন দলের মধ্যে এমন ক্ষোভ বিরাজ করলেও এ ব্যাপারে বিএনপি ছিল বে- খেয়াল। তারা ধরে নিয়েছিল, সরকার বিরোধী আন্দোলনে তিন দলকে পাশে পাওয়া যাবে। এ কারণে ঈদের পর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দল তিনটির শীর্ষ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানোর নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। চেয়ারপার্সনের নির্দেশ পেয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। অধ্যাপক ডা. একিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী ও আ স ম আব্দুর রবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি।

সূত্র জানায়,রোজার মধ্যে বেশ কয়েকবার কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে কথা হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। ওই কথোপকথনের বেশিরভাগ জুড়েই ছিল ঈদের পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে শরিক হওয়ার অনুরোধ। কিন্তু তাতে সাড়া মিলেছে বলে এখনও কোনো ঘোষণা বিএনপির পক্ষ থেকে আসেনি।অতীত রেকর্ড বলছে, যখনই এই দলগুলো বিএনপির পাশে দাঁড়িয়েছে তখনই তা ঘটা করে ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী একবার গামছা পেতে বিএনপি কার্যালয়ের সামনেও বসে পড়েছিলেন।

বঙ্গবীরের মুখপাত্র ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল সিদ্দিকী বলেন, বঙ্গবীরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে বিএনপি। কিন্তু ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আন্দোলনে যাওয়ার ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। কারণ, জামায়াতের জ্বালাও- পোড়াও আন্দোলন বঙ্গবীরের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, বিএনপির আন্দোলনে শরিক হওয়ার দাওয়াত তো সব সময় পাই। এ ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। বিষয়টি নিয়ে দলের সঙ্গে বসতে হবে।তবে বিকল্প ধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বললেন ভিন্ন কথা। বিএনপির পক্ষ থেকে সার্বক্ষনিক যোগাযোগের কথা স্বীকার করে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, গণতন্ত্রের মিত্র শক্তি হিসেবে বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে শরিক থাকবে বিকল্পধারা।

যদিও দলটির একাধিক সূত্র বলছে, জামায়াত-বিএনপির সহিংস আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণার কোনো সম্ভবনাই নেই বিকল্প ধারার।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একজন শীর্ষ নেতা বলেন, বিএনপির ইস্যু এবং তার শরিক জামায়াতের ইস্যু এক নয়। এক জনের লক্ষ্য তত্ত্বাবধায়কের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন। আরেক জনের যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানো। সুতরাং যে কারণে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে ভেড়া বিকল্প ধারার পক্ষে সম্ভব হয়নি, ঠিক একই কারণে তাদের আন্দোলনে ভেড়াও সম্ভব হবে না।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com
Send this to a friend