হিট্টি: ধূলোয় মিশে যাওয়া এক সুপ্রাচীন সভ্যতা
ইতিহাসে হিট্টিদের কথা হয়তো অনেক শুনেছেন। না, আমি পি. কে. হিট্টির কথা বলছি না, যিনি আরবদের ইতিহাস নিয়ে পুস্তক রচনা করেছেন। আমি হিট্টি সভ্যতার কথা বলছি। কারা ছিলো হিট্টি? আর তাদের আবাসস্থলই বা কোথায় ছিলো? তাও হয়তো আপনাদের জানা। আর যাদের জানা নেই কিন্তু জানতে চান, তারা আমার সাথে এই সামান্য ইতিহাস ভ্রমণে যোগ দিতে পারেন।
‘হিট্টি’ শব্দটা পাওয়া যায় হিব্রু ভাষার বাইবেলে। আপনি যদি বাইবেল পাঠ করেন তবে জানবেন, আব্রাহাম মানে ইব্রাহীম ঈশ্বরের নির্দেশে কেনান দেশে গিয়েছিলেন। কেনান দেশে ছিলো কেনানের রাজত্ব। আর কেনানের সন্তান হেত। হেত এর সন্তানদের বলা হতো ‘হিটটিম’।
বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে পাওয়া যায় হিট্টি শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘হিটটিম’।
আপনি অবশ্য ইচ্ছে করলে উইকিপিডিয়াতেও হিট্টিদের সম্পর্কে জানতে পারেন বিস্তর। তবে সেখান কোন বাংলা নিবন্ধ নেই। ইংরেজি নিবন্ধে বলা হয়েছে, প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আনাতোলিয়ায় হিট্টিদের অনুপ্রবেশ ঘটে।
আনাতোলিয়া? হ্যাঁ, মনে পড়ে গেলো নুরি বিলজে সেইলনের ‘ওয়ান্স আপোন এ্য টাইম ইন আনোতোলিয়ার’ কথা। সিনেমাটাতে দেখতে পারবেন আনাতোলিয়ার খোলা প্রান্তরের সৌন্দর্য। হিট্টিদের নিয়ে ডকুফিল্মও তৈরি হয়েছে। সে যাইহোক, আপনি হয়তো জানেন তুরস্ক দেশটা ইউরোপ এবং এশিয়া উভয় মহাদেশ জুড়ে আছে। তুরস্কের এশিয়া মহাদেশের অংশটুকু আনাতোলিয়া নামে পরিচিত। আর হিট্টিরা ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এই আনাতোলিয়ার বুকেই গড়ে তুলেছিলো চমৎকার এক সভ্যতা।
হিট্টিরা প্রথম বসতি গাড়ে ‘নেসা’য়। এটা বর্তমানে আনাতোলিয়ার কায়সেরিতে পড়েছে। তারপর তারা হাট্টুসাস – এ সাম্রাজ্য স্থাপন করে। হিট্টিদের প্রথম দিকের প্রভাবশালী সম্রাট ছিলেন লাবরানা ১। তার শাসন কাল ধারণা করা হয় ১৬০০ থেকে ১৪৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। তার স্ত্রী ছিলো তাওয়ান্বান্না। তিনিই হিট্টিদের রাজধানী হাট্টুসাস গড়ে তুলেন। সম্রাট লাবরানা সমগ্র আনাতোলিয়া জয় করেন। তাঁর বংশধরেরা উত্তর সিরিয়া দখল করার পর ব্যাবিলন আক্রমন করে। সাপপিলুলিউমা ছিলেন হিট্টিদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট। তাঁর সময়কাল ১৩৪৪ থেকে ১৩২২ খ্রিস্টপূর্ব। তিনি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনি বিদেশি আক্রমন ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। আর জয় করেছিলেন উত্তর মেসোপটেমিয়া ও সিরিয়া। হিট্টিরা ধীরে ধীরে গড়ে তোলে বিশাল সাম্রাজ্য। আর মিশর, ব্যাবিলন আর আসেরিয় সভ্যতার সমকক্ষে পৌঁছে যেতে থাকে।
হিট্টিরা কথা বলতো ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায়। তারা আবিষ্কার করেছিলো চ্যারিয়ট। হিট্টিরাই প্রথম লোহা ব্যবহার করতে শিখেছিলো। কৃষিই ছিলো হিট্টি সভ্যতার ভিত্তি। চাষ করতো গম, বার্লি। পালতো গৃহপালিত পশুপাখি- ভেড়া, বলদ, ষাঁড়। আর তারা পাহাড় কেটে বের করে আনতো খনিজ আকরিক। হিট্টিরা ন্যায় বিচারব্যবস্থা চালু করেছিলো। আর বিচার ব্যবস্থা ছিলো খুব নমনীয়। মৃত্যুদণ্ডতো দূরে থাক শরীরে আঘাত করারও বিধান ছিলো না। শাস্তি হিসেবে ছিলো জরিমানা। অর্থ দণ্ড দিতে হতো।
হিট্টিদের মৌলিক কোন ধর্ম ছিলো না। সুমের, আসুর, ব্যাবিলন প্রভৃতি সভ্যতার প্রভাব ছিলো তাদের। গড়ে ছিলো বহু দেবদেবীর মূর্তি। তাদের অন্যতম দেব-দেবী ছিলো ঝড়ের দেবী, সূর্যের দেবী। সম্রাটই ছিলেন তাদের ধর্মগুরু।
বহু যুদ্ধই করেছে হিট্টিরা। মিশরীয়দের সাথে সিরিয়ার আধিপত্ব নিয়েও যুদ্ধ হয়েছে। তবে হিট্টিদের পতন হয়েছিলো অন্য কারো আক্রমনে। মিশরীয় লেখনিতে পাওয়া যায় হিট্টিদের পতন হয়েছিলো সমুদ্রমানুষের আগ্রাসনে। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে কালের গহ্বরে হারিয়ে যায় হিট্টি সভ্যতা। শুধু সভ্যতার কিছু চিহ্ন পড়ে ছিলো।
চিরঋণ: প্রয়াত লেখক, গবেষক ও জনপ্রিয় ব্লগার ইমন জুবায়ের ভাই।
– See more at: http://www.priyo.com/2014/08/20/97887.html#sthash.bLEn1GlX.dpuf