পাঁচ আহতের মর্মস্পর্শী বর্ণনা : দুঃসহ যন্ত্রণার নাম ২১ আগস্ট
‘দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। শান্তিতে ঘুমিয়েছি, গত ১০ বছরে এমন একটি রাতও নেই। শরীরে গ্রেনেডের অসংখ্য স্প্লিন্টার। ঠিকমতো হাঁটতে পারি না, বসতে পারি না। ডান পায়ের ঘা কিছুতেই শুকাচ্ছে না। একটা কান আগেই গেছে, পরে একটা কিডিনও নষ্ট হয়েছে। এখন মনে হয়, সেদিন মরে গেলেই ভালো ছিল। এত যন্ত্রণা সইতে হতো না।’
কথাগুলো রাশিদা আক্তার ওরফে রুমার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর সেদিন তাঁকে মৃত ভেবে লাশের সঙ্গে ফেলে রাখা হয়েছিল।
রাশিদা আক্তার জানান, ঢাকা মেডিকেলে জরুরি চিকিৎসার পর তাঁকে বেসরকারি একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপরে ভারতে দুই মাস চিকিৎসা নেন। কিছুটা সুস্থ হলেও এখন বেঁচে আছেন পঙ্গুত্ব নিয়ে।
রাশিদার মতোই যন্ত্রণায় আছেন নাজমুল হাসান, ইয়াসমিন হোসেন, লুৎফুন্নেছা, সিরাজুল ইসলাম, নিহার রঞ্জন কর, নাসিমা ফেরদৌস, মাহবুবা পারভীনসহ অনেকে। সেদিনের হামলায় কমবেশি আহত হয়েছিলেন অন্তত ৩০০ জন। তাঁদের সবার কাছে ২১ আগস্ট দুঃসহ এক যন্ত্রণার নাম।
রাশিদা আক্তার এখন থাকেন রাজধানীর পুরান ঢাকায়। গত রোববার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। ২১ আগস্টের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রাশিদা বলেন, ‘আমি তখন ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক। পুরান ঢাকা থেকে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সমাবেশে গেছি। আইভি (আইভি রহমান) আপা আমার ডান পাশে। নেত্রীর বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ বিকট আওয়াজ। আমি উড়ে গিয়ে কোথায় যেন পড়লাম! সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারাই। আমার দুই পা ভেঙে যায়। একসময় কানে ভেসে আসে কান্না, আর্তনাদ আর চিৎকার। খুব কষ্ট করে চোখ খুলে দেখি, চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। পড়ে থাকা অবস্থায় মুখ ঘুরাতেই দেখি আইভি আপা পড়ে আছেন। এরপর কিছু লোক আমাকে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।’
রাশিদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা আমাকে মৃত মনে করে লাশের সঙ্গে ফেলে রাখেন। সাদা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দেওয়া হয়। পরে শুনেছি, আমি নাকি যন্ত্রণার চোটে আওয়াজ করেছিলাম। সে সময় মিরপুরের চায়না নামের একটি মেয়ে আমার কাছে ছিল। সে সাবের ভাইকে (সাবের হোসেন চৌধুরী) বলেন, ভাই এই মেয়েটা জীবিত। এরপর আমাকে ধানমন্ডির বাংলাদেশ মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকেরা বলেন, এই মেয়ের দুটি পা এখনই কেটে ফেলতে হবে। হাসপাতালে ছিলেন নেত্রীর এপিএস জাহাঙ্গীর ভাই। তিনি পা কাটতে না দিয়ে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় আরেকটি হাসপাতালে নিয়ে যান। তিন দিন পর ভারতের পিয়ারলেস হাসপাতালে নেওয়া হয় আমাকে। সেখানে আমার পা থেকে শত শত স্প্লিন্টার বের করা হয়। আমাকে ২০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। দুই মাস ছিলাম। তিন বছর পর্যন্ত হুইলচেয়ার ব্যবহার করেছি। এখন ক্রাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করি। কিন্তু অসহ্য যন্ত্রণা…।’
সরকার থেকে কোনো সহায়তা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে অসহায় কণ্ঠে রাশিদা বলেন, ‘নেত্রী আমাদের চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দলের যে মন্ত্রী-এমপিরা আছেন, তাঁরা তো আমাদের একটু খোঁজ নিতে পারেন। তাঁরা নেন না। টাকার অভাবে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারি না। স্বামী আগেই মারা গেছে। চিকিৎসার জন্য স্বামীর ভিটা বিক্রি করেছি। দুই মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছি।’
ইয়াসমিন হোসেন: ওই গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসমিন হোসেনও। প্রায় একই রকম যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। সেদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েক ফুট দূরে উড়ে গিয়ে পড়লাম। জ্ঞান ফেরার পর দেখি পুরো শরীর অসাড়। আইিভ আপাকে দেখলাম উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। আমি গড়িয়ে গড়িয়ে আপার কাছে গেলাম। বললাম, আপা আমার পা ভেঙে গেছে। আমি নড়তে পারছি না। আপনি চলে যান। আপা শুধু একটা কথা বললেন, ইয়াসমিন আমার পা নেই। তাকিয়ে দেখি আপার একটা পা উড়ে গেছে। ছেঁড়া মাংস ঝুলছে। আজও সেই ভয়াবহতা ভুলতে পারি না।’
আহত ইয়াসমিনকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর পরিবারের লোকজন এসে তাঁকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেন। সেখান থেকে ভারতে। এখনো তাঁর শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার। ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন নেত্রী (শেখ হাসিনা) ভারতে না পাঠালে হয়তো বাঁচতাম না। তবে ১০টা বছর ধরে কী যে যন্ত্রণায় আছি, সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। মরার আগে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দেখে যেতে চাই।’
লুৎফুন্নেছা: ছোটবেলা থেকেই পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত দেখেছেন মাদারীপুরের শিবচরের মেয়ে লুৎফুন্নেছা সোনালী। ঢাকায় পড়তে এসে যুক্ত হন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। পরে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠিনক সম্পাদক হন।
গ্রেনেড হামলার ২৭ দিন পর লুৎফুন্নেছার জ্ঞান ফেরে। তখন তিনি ভারতে। গত ১০ বছর দেশে আর ভারতে চিকিৎসা নিয়েছেন। কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হননি। প্রায়ই হাত-পা ফুলে যায়। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠেন।
কীভাবে দিন চলছে, জানতে চাইলে লুৎফুন্নেছা বলেন, ‘আমার স্বামী বেসরকারি একটি ফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। অর্থকষ্ট ছিল না। তবে আমার স্বামীর বড় ভাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে স্বামী স্ট্রোক করেন। দুই বছর ধরে খুব যন্ত্রণায় আছি। আরেকটু ভালো চিকিৎসা করা দরকার, করাতে পারছি না। নেত্রীর তহবিল থেকে সবার মতোই মাসে মাসে তিন হাজার টাকা পাই। দল ক্ষমতায়, কিন্তু মাথা গোঁজার কোনো ঠাঁই নেই এই শহরে।’
সিরাজুল ইসলাম: ২৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর লোকজনের পায়ের নিচে পড়ে ফুটবলের মতোই ঘুরছিলেন তিনি। বুকে, কোমরে এখনো অসংখ্য স্প্লিন্টার। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অধিকাংশই আর বের করা যাবে না। সিরাজুল বলেন, ‘মাঝে মাঝে আর যন্ত্রণা সইতে পারি না।’
আজিজুর রহমান: ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক আজিজুর রহমান ওরফে বাচ্চু। ১৯৭১ সালে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় তাঁর বুকে, তলপেটসহ শরীরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য স্প্লিন্টার ঢুকে যায়। শুধু দুই ঊরুর মাঝখান থেকে ৪০০ স্প্লিন্টার বের করা হয়েছে। এখনো ৩৭টি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে যেত চান, কিন্তু অর্থের অভাবে পারছেন না।
ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আজিজুর রহমান বলেন, ‘যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কোনো দিন ভাবিনি স্বাধীন দেশে কেউ গ্রেনেড মেরে নেত্রীকে (শেখ হাসিনা) হত্যার চেষ্টা করবে। শত শত মানুষকে পঙ্গু বানানো হবে।’ তিনি এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচার দাবি করেন।
নিহার রঞ্জন কর: সেদিন মঞ্চের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিহার রঞ্জন করের ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রথমে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল ও পরে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর ভারতে। বর্তমানে তিনি সুধা সদনের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কর্মরত।
নিহার রঞ্জন কর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেঁচে আছি সত্য। কিন্তু হাঁটতে গেলে প্রচণ্ড কষ্ট হয়।’
নাজমুল হাসান: আহত নাজমুল হাসানকে মৃত মনে করে লাশের সঙ্গে ফেলে রাখা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে লাশ সরাতে গিয়ে দেখা যায়, তাঁর শরীর থেকে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে। একজন চিকিৎসক তখনই তাঁকে রক্ত দিলেন। রাতেই তাঁকে নেওয়া হয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে। এরপর ভারতে।
নাজমুল হাসান এখন ‘২১ আগস্ট বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘গ্রেনেড হামলায় তিন শতাধিক বেশি মানুষ আহত হন। সেদিন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তারা একজনেরও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেনি। অবশ্য করবেই বা কেন? তারাই তো জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা করেছিল। একটি সভ্য স্বাধীন দেশে এমন ঘটনা ঘটবে, ভাবাই যায় না।’
আহত ব্যক্তিদের সাহায্য-সহযোগিতা করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নাজমুল হাসান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁকে যেভাবে পেরেছেন ব্যিক্তগত উদ্যোগে সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু আহত ব্যক্তিদের অনেকেরই আরও চিকিৎসা দরকার। আমরা চাই, প্রত্যেকের সুচিকিৎসা, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন।’